জার্মানির দক্ষিণের রাজ্য বাভেরিয়ায় সরকারি ভবনে প্রকাশ্যে ক্রসচিহ্ন ঝোলানোর নির্দেশ জারি হয়েছে৷ তবে যে কারণে এই নির্দেশ জারি হয়েছে, তা বাভেরিয়ার মানুষ ও স্থানীয় প্রশাসনের কাছে মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
প্রশাসনিক দপ্তর হোক বা থানা কিংবা আদালত, বাভেরিয়ার বাসিন্দারা এবার কোনো সরকারি ভবনে গেলেই ক্রশচিহ্ন দেখতে পাবেন৷ শুক্রবার থেকে এই নয়া নিয়ম কার্যকর হচ্ছে৷ এবং এই নির্দেশকে কঠোরভাবে কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে৷ বাভেরিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের মুখপাত্র মার্টিন শলটিসিক বলেন, শুক্রবার থেকে এই নয়া নিয়ম কার্যকর হবে৷ এই নির্দেশকে হালকাভাবে নিলে চলবে না৷
তবে মুখপাত্র এটা স্পষ্ট করে জানাননি যে ক্রস না ঝোলালে কোনো জরিমানা হবে কিনা৷ তবে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, নয়া নিয়ম কার্যকর করতে বাভেরিয়ার প্রশাসন চেষ্টার ত্রুটি রাখবে না৷
প্রয়োজন স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান ক্রস
বাভেরিকার নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, বাভেরিয়ার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবের কথা স্মরণ করে প্রতিটি ভবনের প্রবেশদ্বারে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান ক্রস ঝোলাতে হবে৷ বাভেরিয়ার প্রাদেশিক প্রধান মার্কুস স্যোডার গত এপ্রিলে নতুন এই নিয়মের ঘোষণা করেছিলেন৷ এই ঘোষণার সময় যখন তিনি নিজে চিত্রসাংবাদিকদের সামনে স্টেট চ্যান্সেলারিতে একটি ক্রস ঝুলিয়ে ছিলেন, তখনই বোঝা গিয়েছিল এই নির্দেশের তাৎপর্য কতটা৷
এই পদক্ষেপ জার্মানিতে তুমুল বিতর্কের জন্ম দিয়েছে৷ শুধু পড়ুয়ারাই এর বিরোধিতা করেননি, ধর্মীয় নেতারাও এর বিরোধিতা করেছেন৷ প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ এবং ক্যাথলিক বিশপস কনফারেন্স এই পদক্ষেপের সমালোচনা করে বলেছে, এর ফলে ধর্মীয় প্রতীকের অপব্যবহার হবে৷
যদিও বাভেরিয়ার প্রোটেস্ট্যান্ট প্রধান স্যোডার শুক্রবার তাঁর ঘোষণা কার্যকর হওয়ার দিন জার্মানিতে নেই৷ তিনি গিয়েছেন ভ্যাটিকানে, পোপ ফ্রন্সিসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে৷
বাংলাদেশের কিছু গির্জা
বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় আছে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বেশ কিছু গির্জা৷ যীশু খৃষ্টের জন্মোৎসব ‘বড়দিন’ উপলক্ষ্যে এ সব গির্জায় থাকে নানান আয়োজন৷ বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য কিছু গির্জা নিয়ে এ ছবিঘর৷
ছবি: bdnews24.com
আর্মেনিয়ান গির্জা
পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় অবস্থিত প্রাচীন গির্জা৷ আর্মেনীয়রা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরুর পর এ গির্জাটি নির্মিত হয়েছিল ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে৷ গির্জাটি লম্বায় সাড়ে ২৭ ফুট৷ এর পাশেই ছিল একটি ঘড়িঘর৷ এটি নির্মাণ করেছিলেন জোহানস কারু পিয়েতে সার্কিস৷ ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ঘড়িঘরটি ভেঙে যায়৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
সেন্ট থমাস চার্চ
ঢাকার পুরোনো গির্জাগুলির মধ্যে অন্যতম একটি সেন্ট থমাস চার্চ৷ শাঁখারি বাজরের পূর্ব পাশে এবং বাহাদুর শাহ পার্কের উত্তর পাশে অবস্থিত এটি৷ ১৮১৯ সালে ঢাকা জেলের কয়েদিদের শ্রমের বিনিময়ে নির্মিত হয়েছেল এ গির্জা৷ প্রধান আর্কষণ হলো চূড়ায় অবস্থিত বড় আকারের একটি ঘড়ি৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
হোলি রোজারিও চার্চ
রাজধানীর ফার্মগেইটের কাছেই তেজগাঁও এলাকায় হোলি রোজারিও চার্চ৷ নতুন এবং পুরোনো, দু’টি গির্জা এখানে আছে৷ পুরোনোটি ১৬৭৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পর্তুগিজরা৷ আর নতুনটি তৈরি করা হয় ১৯৯৭ সালে৷ এটি ক্যাথলিক চার্চ৷
ছবি: bdnews24.com
সেন্ট মেরিস ক্যাথিড্রাল
ঢাকার ১ নং কাকরাইল সড়কে অবস্থিত সেন্ট মেরিস ক্যাথিড্রাল গির্জা৷ এটি নির্মিত হয়েছিল ১৯৫৬ সালে৷ বড়দিন উপলক্ষ্যে এ গির্জাটি সাজানো হয় আকর্ষণীয়ভাবে৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
সেন্ট সিকোলাস চার্চ
গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী গ্রামে সাধু নিকোলাসের গির্জা৷ ১৬৬৩ সালে নির্মিত হয়েছিল৷ এখানকার সবচেয়ে পুরোনো যে গির্জা ভবনটি আছে, সেটির নির্মাণ কাল ১৬৯৫ সাল৷ এরপরে বেশ বড় আকারে আরেকটি গির্জা ভবন তৈরি করা হয় ২০০৯ সালে৷ ভবনের সামনে স্থাপন করা হয়েছে হস্ত প্রসারিত যীশুর দণ্ডায়মান মূর্তি৷ এই এলাকায় আরও একটি গির্জা আছে, নাম সেন্ট অ্যান্টোনিস চার্চ৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
অক্সফোর্ড মিশন চার্চ
খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের এ উপসনালয়টি বরিশাল শহরের বগুড়া সড়কে অবস্থিত৷ খোলা প্রান্তরের মাঝে বিশাল আকারের এ গির্জা সহজেই সবার দৃষ্টি কাড়ে৷ গ্রিক স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত গির্জার ভেতর আছে সুবিশাল প্রার্থনা কক্ষ৷ নির্মাণকাল ১৯০০ সাল৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
আওয়ার লেডি অফ দ্য হোলি রোজারিও ক্যাথিড্রাল চার্চ
চট্টগ্রাম শহরের পাথরঘাটা এলাকার বান্ডেল সড়কে অবস্থিত আওয়ার লেডি অফ দ্য হলি রোজারিও ক্যাথিড্রাল চার্চ৷ চট্টগ্রাম শহরের অন্যতম প্রধান এ গির্জাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৬০০ সালে৷
ছবি: bdnews24.com/Asaduzzaman Pramanik
7 ছবি1 | 7
দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও সমালোচনা
ঘোষণার পর থেকেই বাভেরিয়ার বিভিন্ন স্থানের প্রশাসন ভাবছিল, কবে পয়লা জুন আসবে ও এই নির্দেশ কার্যকর করার প্রথম দিনটি নিরুপদ্রবে মিটে যাবে৷ সরকারি আধিকারিকরা এ নিয়ে ধন্দে ছিলেন৷ ক্রসের মাপ, আকার সহ কোনো কিছুই নির্দিষ্ট করে বলা নেই সরকারি নির্দেশিকায়৷ মুখপাত্র মার্টিন এই ধোঁয়াশা দূর করে বলেন যে, এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনই সিদ্ধান্ত নেবে৷
প্রশাসনের মুখপাত্রের এই মন্তব্যের অর্থ, খুব ছোট আকারের ক্রসও ঝোলানো যেতে পারে প্রবেশপথে৷ নির্দেশিকায় যেখানে ক্রস ঝোলানোর কথা বলা হয়েছে, সার্ভিস বিল্ডিং-এর ব্যাখা নিয়েও ধন্দ রয়েছে৷ এর মধ্যে বাভেরিয়া সরকারের অধীন সব প্রশাসনিক ভবনই পড়ে৷ এছাড়া রয়েছে থানা ও ট্যাক্স অফিস৷ এর মধ্যে পড়ে মিউজিয়াম, থিয়েটার, স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ও৷ প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি এ সব জায়গাতেই দৃশ্যমান ক্রস বাধ্যতামূলক?
এখানেই আপত্তি উঠেছে৷ মিউজিয়াম বা অন্যান্য সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ক্রস নিয়ে আপত্তি তুলছে৷ তারা তাদের প্রবেশদ্বার বা হলে ক্রস ঝোলাতে রাজি নয়৷ তাদের বক্তব্য, এর ফলে তাদের কাজের প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে৷
নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া
প্রথম প্রতিবাদ এসেছে নুরেমব্যার্গের মিউজিয়াম ফর কনটেম্পরারি আর্ট থেকে৷ এই প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর এভা ক্রাউস বলেছেন, তিনি নির্দেশিকা মানবেন না৷ প্রতিষ্ঠানের এক মুখপাত্রের মতে, ক্রসের নিয়ম তাঁদের ক্ষেত্রে কার্যকর নয়৷
ধর্মীয় গ্রন্থে পরিবেশের কথা
ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সব ধর্মের পবিত্র গ্রন্থেই পরিবেশ রক্ষার জন্য অনুসারীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ ছবিঘরে থাকছে সেসব কথাই৷
ছবি: Jody McIntryre / CC-BY-SA-2.0
ঈশ্বরের সৃষ্টিকে রক্ষা
বাইবেলের প্রথম বই ‘জেনেসিস’এ বলা আছে, ঈশ্বর আদম আর ঈভকে ‘গার্ডেন অফ ইডেন’ অর্থাৎ ‘ঈশ্বরের বাগান’ বলে যেটা পরিচিত, সেখানে পাঠিয়ে বাগানের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়েছিলেন৷
ছবি: Jonathan Linczak / CC BY-NC-SA 2.0
ধর্মীয় বেস্টসেলার
বিশ্বের সবচেয়ে বেশিবার পঠিত ও প্রকাশিত বই খ্রিস্টানদের বাইবেল৷ এই বইয়ে সৃষ্টিজগতের কথা বেশ গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে৷
ছবি: Axel Warnstedt
বাইবেল এর সবচেয়ে পরিচিত শ্লোক বা পঙক্তি
ঈশ্বর তাদের আশীর্বাদ করেন এবং বলেন: ‘‘ফলপ্রসু হও এবং সংখ্যায় বেড়ে ওঠ৷ পৃথিবীকে ভরিয়ে দাও ও তাকে নিয়ন্ত্রণে আনো৷ সাগরের মাছ, আকাশের পাখি আর ভূমিতে যত জীবন্ত প্রাণী আছে তাদের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা কর৷’’ (জেনেসিস ১:২৮)৷ এটা বাইবেলের সবচেয়ে পরিচিত পঙতির মধ্যে একটি৷
ছবি: Axel Warnstedt
আল্লাহর সৃষ্টি ব্যবহারে সতর্ক হও
ইসলাম ধর্মেও আল্লাহর সৃষ্টিকে রক্ষার জন্য অনুসারীদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে৷ সূরা আর রহমান-এ বলা আছে, মানুষের ব্যবহারের জন্যই পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি করা হয়েছে, তবে সেটা করতে হবে সতর্ক হয়ে৷
ছবি: AP
মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক
কোরানের অনেক আয়াতেই প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে৷ যেমন সূরা আল বাক্বারাহ’য় বলা আছে, ‘‘তোমরা পৃথিবীর অনিষ্ট করো না৷’’
ছবি: Axel Warnstedt
ভারসাম্য বজায় রাখা
হিন্দুদের ভগবত গীতার তৃতীয় অধ্যায়ের ১২ নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে, ‘‘...ভগবান তোমাকে তোমার প্রয়োজনীয় খাবার দেবেন৷ যারা এই উপহার গ্রহণ করবে কিন্তু বিনিময়ে কিছু দেবে না তারা চোর, এর কমও নয় বেশিও নয়৷’’
ছবি: Axel Warnstedt
নিজেকে সৃষ্টির অংশ মনে করা
বৌদ্ধ ধর্ম বলে, সত্যিকার অর্থে দীক্ষা লাভ করতে হলে একজন মানুষের নিজেকে অবশ্যই অন্যান্য সৃষ্টির মতোই একটি অংশ মনে করতে হবে এবং তাদের দুঃখ, কষ্ট ভাগ করে নিতে হবে৷
ছবি: Jody McIntryre / CC-BY-SA-2.0
7 ছবি1 | 7
বাভেরিয়ার বিজ্ঞান ও কলা মন্ত্রকের মুখপাত্র বিষয়টি স্পষ্ট করে বলেছেন, নয়া নিয়ম মিউজিয়াম থিয়েটার, বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এখন কেবলই প্রস্তাব বা পরামর্শ, প্রয়োজন নয়৷ এ কথা সরাসরি এ সব প্রতিষ্ঠানকে জানানো হয়েছে কিনা, তা বোঝা যাচ্ছে না৷
প্রচার কৌশল নাকি ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান?
সরকারি পদক্ষেপ সংবিধান অনুযায়ী কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে৷ ধর্মনিরপেক্ষতা ও চার্চের থেকে রাজ্যকে আলাদা রাখার যে নীতি সংবিধানে রয়েছে, ক্রসের নির্দেশিকা তাকে লঙ্ঘন করছে বলে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন৷
কিন্তু স্যোডার ও বাভেরিয়ার সরকার এই বক্তব্য খারিজ করে বলেছে, ক্রস বাভেরিয়ার পরিচয়৷ যদিও বাভেরিয়ার পরিচয় বলতে কী বোঝায়, তা নিয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মত৷ প্রসঙ্গত, এই বিতর্ক তখন তৈরি হলো যখন জার্মান সমাজে ইসলামের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা চলছে৷ স্যোডার ও তাঁর দল রাজ্য নির্বাচনের আগে এই ঘোষণার মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে চাইছে৷
আগামী ১৪ অক্টোবর প্রাদেশিক নির্বাচন৷ জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের বাভেরিয়ার শাখা বা সহযোগী দল স্যোডারের ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যাল ইউনিয়ন (সিএসইউ) অতি দক্ষিণপন্থি অলটারনেটিভ ফর জার্মানির (এএফডি) বিরুদ্ধে ভোটে জয় পেতে চাইছে৷