সদ্য শেষ হওয়া বিধানসভা ভোটে একটিও আসন পাননি বামপন্থি এবং কংগ্রেস প্রার্থীরা৷ স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গে এহেন ‘অঘটন’ এই প্রথম৷
বিজ্ঞাপন
বিজেপির তাবড় নেতা, অর্থবল, লোকবলের বিরুদ্ধে কেমন ‘একাই একশ’ হয়ে লড়ে গেলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি, সে নিয়ে কথা হচ্ছে অবশ্যই৷ কিন্তু তার থেকেও বেশি কথা হচ্ছে, এতদিন সঙ্ঘ পরিবারের প্রভাবমুক্ত এই রাজ্যে বিজেপির প্রধান বিরোধী দল হয়ে যাওয়া৷ কিন্তু তাকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে আলোচনা, যে এই প্রথম পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বামফ্রন্ট বা কংগ্রেসের একজন বিধায়কও থাকবেন না, যারা এর আগে এই রাজ্যে ক্ষমতায় থেকেছে৷
কংগ্রেসের দিক থেকে এবারের বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে একটা গা–ছাড়া ভাব শুরু থেকেই ছিল৷ আব্বাস সিদ্দিকির ইন্ডিয়ান সেকুলার ফন্ট–এর সঙ্গে জোট বেঁধে, বামেদের সঙ্গে নিয়ে সংযুক্ত মোর্চা তৈরির পরও নজরে পড়েছে কংগ্রেসের উদ্যমহীনতা৷ জাতীয় স্তরের কোনো কংগ্রেসি নেতা প্রচারে আসেননি, এমনকি রাজ্যের নেতাদেরও সেভাবে দেখা যায়নি মিটিং-মিছিল করতে৷ জানা গিয়েছিল, সিদ্দিকির আইএসএফ-এর সঙ্গে জোট নিয়ে কংগ্রেসের উচ্চতম নেতৃত্ব অস্বস্তিতে আছে৷
তুলনায় অনেক বেশি সমালোচিত হচ্ছে বামফ্রন্ট৷ ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পর, মাত্র ১০ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে যাদের শক্তি শূন্যে গিয়ে ঠেকেছে৷ গত লোকসভা ভোটে বামেদের ভোট কমে ছয় শতাংশে দাঁড়িয়েছিল৷ এবার বিধানসভা ভোটে আরো কিছুটা কমে সেটা ৫.৫ শতাংশ৷ এর জন্য ফের সেই সিদ্দিকির দলের সঙ্গে জোট করার সিদ্ধান্তই সমালোচিত হচ্ছে৷ বলা হচ্ছে, নামে সেকুলার ফ্রন্ট হলেও অতীতে আব্বাস সিদ্দিকি যে ধরনের আপত্তিকর কথাবার্তা বলেছেন, তাকে ধর্ম নিরপেক্ষ বলা যায় না৷ তার সঙ্গে হাত মেলানোটা বাম ভোটাররা ভালোভাবে নেননি৷
নির্বাচনি সংখ্যাতত্ত্ববিদ বিশ্বনাথ চক্রবর্তী জোর দিয়ে বলছেন, এবার বামেদের এবং কংগ্রেসের ভোট নিশ্চিত তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে গেছে৷ তিনি বললেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে এবার ভোটের আগে যে ‘নো বিজেপি’ প্রচার হয়েছিল, এটা তারই ফল৷ বাম, কংগ্রেস, তৃণমূল, সেই সঙ্গে বুদ্ধিজীবীরা, বাম লিবারেলরা এই নো বিজেপি প্রচার চালিয়েছিল৷ তার সুফল পেয়েছে তৃণমূল৷ বাম এবং কংগ্রেসের প্রায় সমান সমান ভোট তৃণমূলের পক্ষে পড়েছে৷’’
সোমবার সংযুক্ত মোর্চার পক্ষে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুও কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন যে, মোর্চা যে ভোট পায়নি, সে ভোট সম্ভবত তৃণমূলের পক্ষেই গেছে৷ প্রাক্তন বিধায়ক, সিপিএম নেতা তন্ময় ভট্টাচার্য বলছেন, হতেই পারে৷ কিন্তু বুথভিত্তিক পরিসংখ্যান হাতে না এলে নির্দিষ্টভাবে তেমন কথা বলা যায় না৷ বামেরা যে ভোট পেয়ে আসছে, তার থেকে কত ভোট কমেছে এবং তৃণমূলের কোথায় কত ভোট বেড়েছে, সেটা মিলিয়ে দেখেই এরকম একটা সিদ্ধান্তে আসা যায়৷
তরুণ প্রার্থী দিলেই হয় না, পার্টির ভাবনায় তারুণ্য থাকতে হয়: তন্ময় ভট্টাচার্য, বামপন্থি নেতা, প্রাক্তন বিধায়ক
কিন্তু বামপন্থিরা এবারের ভোটে নিজেদের হারানো জমি ফিরে পেতে যথেষ্ট চেষ্টা করেছে৷ বেশ কয়েকজন নবীন বাম প্রার্থী এবার ভোটে দাঁড়িয়েছেন৷ তারা সারা রাজ্য ঘুরে প্রচার করেছেন৷ সোশাল মিডিয়াতেও তাদের পক্ষে জনসমর্থন দেখা গিয়েছে৷ তা হলে বামেরা শূন্যে গিয়ে পৌঁছল কেন? তন্ময় ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘তরুণ প্রার্থী দিলেই হয় না৷ পার্টির ভাবনায় তারুণ্য থাকতে হয়৷ আমি ১০টা তরুণ প্রার্থী দিলাম, কিন্তু আমরা তারুণ্যকে প্রাধান্য দিলাম না, আমার ভাবনাটা বৃদ্ধ থাকলো, তাহলে সেই তরুণরা যে ভাবনাগুলো মানুষের কাছে নিয়ে যাবে, তার মধ্যে আমার ভাবনাই প্রতিফলিত হবে!’’
তন্ময় ভট্টাচার্যের এই সোজাসাপ্টা কথা পশ্চিমবঙ্গের বাম রাজনীতিতে রীতিমতো আলোড়ন তুলেছে ভোটের পর৷ যেখানে তিনি সাফ বলছেন দলের উচ্চতর নেতৃত্বে বদলের কথা, যেখানে আদ্যিকালের রাজনৈতিক ধারণা নয়, আধুনিক ভাবনা গুরুত্ব পাবে৷ বিতর্ক শুরু হয়েছে৷ হতে পারে, এই বিরোধ থেকেই ভবিষ্যতে নতুন পথে হাঁটতে উৎসাহিত হবেন বাঙালি বামপন্থিরা৷
পশ্চিমবঙ্গে জয়ের প্রতিক্রিয়া, হারের সাফাই
পশ্চিমবঙ্গে তৃতীয়বারের জন্য সরকার গঠন করবে তৃণমূল। তৃণমূলের বিপুল জয়ের পর কে কেমনভাবে হার বা জয়ের প্রতিক্রিয়া দিলেন?
ছবি: AP Photo/picture alliance
বাংলা পারে, বললেন মমতা
মমতা-ঝড়ে উড়ে গেছে মোদী-শাহের বিজেপি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম প্রতিক্রিয়া, ''বাংলা পারে। এটা বাংলার জয়।'' পরে বললেন, ''এই জয় বাংলার মানুষকে বাঁচিয়ে দিল।'' নন্দীগ্রামের খবরে মমতা বললেন, ''আমরা পুনর্গণনা চাই।'' আদালতে যাওয়ার কথাও বললেন। তবে মমতা জানিয়ে দিয়েছেন, এখন বিজয় উৎসব নয়। এখন প্রথম কাজ, করোনার মোকাবিলা করা। তাই সকলের জন্য বিনা পয়সায় মোদীর কাছ থেকে টিকা চেয়েছেন। না দিলে ধরনার হুমকিও।
ছবি: AFP/Getty Images
মোদীর টুইট
পশ্চিমবঙ্গের ফল বেরনোর পর টুইট করে নিজের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মমতাকে অভিনন্দন জানিয়ে মোদী বলেছেন, বিধানসভায় তাদের উপস্থিতি বিপুলভাবে বেড়েছে। বিজেপি এখন রাজ্যের মঙ্গলের জন্য কাজ করে যাবে। অমিত শাহও বলেছেন, বিজেপি শক্তিশালী বিরোধী দল হিসাবে রাজ্যের মানুষের স্বার্থে ও উন্নতির জন্য কাজ করবে।
ছবি: Kuntal Chakrabarty/IANS
দিলীপ ঘোষের সাফাই
বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, তারা যে লক্ষ্য নিয়েছিলেন, সেই তুলনায় তাদের সাংগঠনিক শক্তি ছিল না। তাদের আরো লড়াই করতে হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২৫ বছর লড়াই করে ক্ষমতায় এসেছেন। বিজেপি-কেও রাজ্যে অনেক পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে।
ছবি: Imago Images/Pacific Press Agency/S. Paul
অধীরের যুক্তি
অধীর চৌধুরী বলছেন, ''সাম্প্রদায়িক প্রচারের কাছে হেরেছি। মমতা সাম্প্রদায়িক প্রচার করলেন। মোদীকে ঠেকাতে দিদিকে ভোট দাও। কংগ্রেস যে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে মোদীর বিরুদ্ধে লড়ছে, লড়বে সেই ভরসা মুসলিমরা রাখতে পারলেন না। আমরা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি। শীতলকুচিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে মুসলিমরা মারা গেলেন। প্রচার হলো, মোদী মুসলিমদের মারবে। এর মোকাবিলা আমরা করতে পারলাম না।''
ছবি: Syamantak Ghosh/DW
হার স্বীকার রাহুল গান্ধীর
ভোটে বিপর্যয়ের পর রাহুল গান্ধী বলেছেন, ''আমরা সবিনয়ে হার স্বীকার করে নিলাম। আমাদের নেতা ও কর্মী, যারা কাজ করেছেন এবং লাখ লাখ মানুষ যারা আমাদের সমর্থন করেছেন, সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমরা আমাদের মতাদর্শ ও মূল্যবোধের লড়াই চালিয়ে যাব।''
ছবি: Getty Images/AFP/S. Hussain
বিমান বসুর বক্তব্য
জন্মলগ্নের পরে এই প্রথম বামেদের কোনো প্রতিনিধি বিধানসভায় থাকবেন না। বাম জোটের তরফে বিমান বসু বলেছেন, ''জনগণ বিজেপি-কে পরাস্ত করতে চেয়েছিলেন। তাই তৃণমূল লাভবান হয়েছে। আমরা যৌথ পর্যালোচনা করব। এই হার থেকে শিক্ষা নেব। আমাদের দায়িত্ব আরো বেড়ে গেল।''
ছবি: UNI
আইএসএফ চুপ
ভোটের কিছুদিন আগে দল গঠন করেছিলেন ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকি। ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট বা আইএসএফ। তারা হাত মেলায় বাম ও কংগ্রেসের সঙ্গে। জোটের হয়ে একমাত্র জয় আব্বাসের ভাই নওসাদ সিদ্দিকির। কিন্তু এরপর প্রতিক্রিয়া দেননি আব্বাস। তবে দিল্লিতে কংগ্রেস মুখপাত্র বলেছেন, আইএসএফের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভালো হয়েছে না ভুল হয়েছে, তা পরে পর্যালোচনা করা হবে।
ছবি: Naushad Bhai
পিকে-র প্রতিক্রিয়া
তৃণমূলকে জেতানোর পিছনে তার কৌশলও কাজ করেছে। সেই প্রশান্ত কিশোর বা পিকে-র প্রতিক্রিয়া, ''কঠিন লড়াই ছিল। নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তা আছে বলে বিজেপি সব লড়াই জিতবে তার কোনো মানে নেই।'' পিকে দাবি করেছিলেন, বিজেপি একশ ছুঁতে পারবে না। সেটা মিলেছে। তারপরেও পিকে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে তোপ দেগে বলেছেন, ''আমাদের প্রচার করতে অসুবিধা হচ্ছিল।'' তবে এই জয়ের পর তার ঘোষণা, আর কোনো দলের হয়ে কাজ করবেন না তিনি।