তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অনেকদিন ধরেই কথাটা বলছিলেন৷ এবার বাম নেতারা নিজেরাও এই ভয় পাচ্ছেন যে, বাংলায় বিজেপি এবার বামেদের ভোটও পাবে৷
বিজ্ঞাপন
ভারতের সাধারণ নির্বাচনকে সাতটি দফায় ভেঙে, এক মাস ধরে ভোটপর্ব চালানোর উদ্দেশ্য একটাই– যাতে নরেন্দ্র মোদী পূর্ব ভারতে বারবার এসে প্রচার করতে পারেন৷ এ কথা প্রথমেই বলেছিলেন বিরোধীরা৷ পূর্ব ভারতকে এত গুরুত্ব দেওয়ার একটাই কারণ৷ উত্তরপ্রদেশে গত বিধানসভা ভোটেই মোদী টের পেয়েছেন, সমাজবাদী পার্টি এবং বহুজন সমাজ পার্টির জোট হলে, তার ফল বিজেপির পক্ষে বিষময় হতে পারে৷ এবারেও সেই অলিখিত জোট হয়েছে উত্তরপ্রদেশে এবং সেই জোটে শামিল না হলেও পুরোদস্তুর লড়াইয়ে আছে কংগ্রেস৷ কাজেই ভারতের সবথেকে বেশি লোকসভা আসন যে রাজ্যটিতে, যেখানে ভালো ফল করলে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসা সুনিশ্চিত হয় বলে বলা হয়ে থাকে, সেখানে বিজেপি এবার বেশ বেকায়দায়৷ লোকসভা ভোটে উত্তরপ্রদেশে যে বিজেপি বিশেষ সুবিধে করতে পারবে না, সেকথা শুধু বিরোধীরা বলছে না, বিজেপি নেতৃত্বও বিলক্ষণ জানে৷
ফলে নজর পড়েছে পূর্ব ভারতে ,বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে৷ কেন, পশ্চিমবঙ্গে কেন? কারণ, নরেন্দ্র মোদী দলীয় সূত্রে এবং সম্ভবত কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সূত্রেও জানতে পেরেছেন যে, তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে রাজ্যের সাধারণ মানুষের একাংশ নানা কারণে ক্ষুব্ধ৷ তাঁরা মমতাকে শায়েস্তা করতেই এবার বিজেপিকে ভোট দিতে পারেন৷ এদের পাশাপাশি আছেন বামপন্থি কর্মী–সমর্থকরা, যাঁরা মমতার হাতে পর্যুদস্ত হয়ে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ক্ষোভ, শোক এবং রাগ এখনো হজম করতে পারেননি৷ আজ যখন বিজেপি ছলে-বলে-কৌশলে পশ্চিমবঙ্গে কিছুটা হলেও রাজনৈতিক জমি তৈরি করতে পেরেছে, মমতাকে একটা শিক্ষা দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বাম ভোটাররা৷ ফলে তাঁদের ভোট এবার বিজেপি পেতে পারে৷ এর পাশাপাশি আছেন বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের একটি শ্রেণি, যাঁরা জননেত্রী মমতার প্রশাসনিক কর্তৃত্বে উত্থান থেকে শুরু করে তাঁর ইংরেজি বলতে না পারা, তাঁর ভুল উচ্চারণ, সব কিছুতেই বিরক্ত৷ আর এর পাশাপাশি আছেন সেই গোত্রের লোকেরা, যাঁরা হিন্দুত্ববাদী না হন, অবশ্যই মুসলিম-বিরোধী এবং মনে করেন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা ব্যানার্জি রাজ্যের মুসলিম সম্প্রদায়কে অকারণ, অনাবশ্যক তোষণ করে চলেছেন৷ বাম জমানায় তাঁরা নিজেদের মুসলিম-বিরোধিতা সেভাবে প্রকাশ করতে পারেননি, এখনো পারছেন না, কিন্তু তাঁদের জমে থাকা ক্ষোভ বেরিয়ে আসার একটা রাস্তা তৈরি করে দিয়েছে বিভাজনের রাজনীতিতে পটু বিজেপি৷ এই তিন গোত্রের লোকেরা এবার বিজেপিকে ভোট দেবেন, একসময় যে ভোটটা বামফ্রন্টের দিকে যেতো৷
বিজেপিকে চিনে নিন
ভারতে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি৷ বর্তমানে জাতীয় ও রাজ্যস্তরে সর্বাধিক প্রতিনিধিত্ব রাখা দলটি সদস্য সংখ্যায় বিশ্বের বৃহত্তম৷ ঐতিহাসিকভাবে হিন্দু-জাতীয়তাবাদী অবস্থানের বিজেপির গল্প এই ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/R. K. Singh
আদর্শগত উৎস
বিজেপিকে চিনতে হলে ‘সংঘ পরিবার’-এর অন্তর্গত হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলির উৎস আরএসএস অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘকে জানা দরকার৷ বিশ্বের বৃহত্তম এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা মারাঠি চিকিৎসক কেশব হেডগেওয়ার৷ ১৯২৫ সালে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি৷ ভি ডি সাভারকরের ‘হিন্দুত্ব’ চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণই আরএসএস-এর প্রধান উদ্দেশ্য৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে দূরত্ব
কংগ্রেসের নেতৃত্বে চলা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে দূরে ছিল আরএসএস৷ ১৯৪০-এর দশকে সংগঠনের নেতা হিসেবে এম এস গোলওয়ালকর হিন্দু রাষ্ট্র গড়তে ব্রিটিশ বিরোধিতার বদলে ধর্ম ও সংস্কৃতি রক্ষার ডাক দেন৷ উল্লেখ্য, পরবর্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়া অটলবিহারী বাজপেয়ী ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সময় সত্যাগ্রহীদের সাথে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন৷ লিখিত মুচলেকা দিয়ে আন্দোলনে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে ছাড়া পান তিনি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M.Desfor
দেশভাগ ও আরএসএস
দেশভাগের সময় আরএসএস পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুদের সাহায্য করে৷ আরএসএস ও বর্তমানের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির কর্মীরা মনে করেন, দেশভাগ মুসলিমদের প্রতি নরম আচরণের ফল৷ এজন্য গান্ধী ও নেহরুকে বিশেষভাবে দায়ী মনে করেন তাঁরা৷ স্বাধীনতার পর কংগ্রেসকে ঠেকাতে ১৯৫১ সালে জনসংঘ প্রতিষ্ঠা করেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়৷ সেই জনসংঘই আসলে বিজেপির উৎস৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
জরুরি অবস্থা ও জনতা পার্টির জন্ম
১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করেন৷ বিক্ষোভে অংশ নেয়ার কারণে জনসংঘের অসংখ্য সমর্থককে গ্রেপ্তার করা হয়৷ ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থা শেষে অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন৷ কংগ্রেসকে হারাতে অন্যান্য দলের সঙ্গে মিলে যায় জনসংঘ, জন্ম নেয় জনতা পার্টি৷ নির্বাচনে জিতেও যায় জনতা পার্টি৷ প্রধানমন্ত্রী হন মোরারজি দেশাই৷ স্বাধীন ভারতে সূচিত হয় হিন্দুত্ববাদীদের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ জয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিজেপির জন্ম
১৯৮০’র পর দল ও আরএসএসের দ্বৈত সদস্য হবার বিধান না থাকায় জন্ম নেয় ভারতীয় জনতা পার্টি৷ নতুন দলে নতুন সদস্য যোগ দিলেও, গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিল পুরোনোদের দাপট৷ প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন বাজপেয়ী৷ মূলত, ইন্দিরা হত্যার পর ভোটে খারাপ করার কারণেই নেতৃত্বে এই পরিবর্তন৷ তবে বিজেপির উত্থান শুরু ১৯৮৪ সালে৷ সে বছর দলের সভাপতি হন লালকৃষ্ণ আডবানি৷ রাম জন্মভূমির দাবিকে ঘিরে তাঁর নেতৃত্বেই শক্তিশালী হতে থাকে বিজেপি৷
ছবি: Getty Images/AFP/Raveendran
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও বাবরি মসজিদ
নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই বিজেপি সরাসরি ধর্মের রাজনীতিতে নামে৷ বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির গঠনের দাবিতে সারা দেশ থেকে অযোধ্যার পথে রওয়ানা দেয় হাজার হাজার ‘করসেবক’৷ পুলিশের সাথে সংঘর্ষের ফলে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে উত্তেজিত জনতা বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলে৷ এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিহত হন দু’ হাজারেরও বেশি মানুষ৷
ছবি: Getty Images/AFP/D .E. Curran
সরকার গঠন ও জোটের রাজনীতি
সাম্প্রদায়িক আবেগকে হাতিয়ার করে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিজেপি ১৬১টি লোকসভা আসনে জয়ী হয়৷ প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নেন অটলবিহারী বাজপেয়ী৷ কিন্তু ১৩ দিন পর, লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে ব্যর্থ হওয়ায় সরকার গঠন করতে পারেনি বিজেপি৷ ১৯৯৬ সালে আঞ্চলিক দলগুলির একটি জোট সরকার গঠন করে৷ কিন্তু সেই সরকারের স্থায়িত্ব দীর্ঘ হয়নি৷ ১৯৯৮ সালে আবার নির্বাচন হয়৷
ছবি: UNI
প্রথম এনডিএ সরকার
নির্বাচনে জিতে বিজেপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট (এনডিএ) সরকার গড়ে৷ জোটে অংশগ্রহণ করে সমতা পার্টি, অকালী দল, শিব সেনা, নিখিল ভারত আন্না দ্রাবিড় মুন্নেত্র কড়গম (এআইএআইডিএমকে), বিজু জনতা দল ও শিব সেনা৷ ১৯৯৯ সালে তাঁরা সংসদে ৩০৩টি আসন জিতলে বাজপেয়ী তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন৷ পাঁচ বছরের পূর্ণমেয়াদী এই জোট সরকার প্রতিরক্ষা ও সন্ত্রাসের মোকাবিলার পাশাপাশি নব্য-উদার অর্থনীতির ওপর জোর দেয়৷
ছবি: Imago/photothek/T. Koehler
দুর্নীতি ও দাঙ্গায় কোণঠাসা বিজেপি
বিজেপির জয়রথে প্রথম ‘বাধা’ গোধরা দাঙ্গা৷ তীর্থযাত্রীবাহী ট্রেনে আগুন লাগাকে ঘিরে প্রায় ২০০০ মানুষ মারা যান৷ তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীসহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিজেপি নেতার নাম এই দাঙ্গার সাথে জড়ায়৷ বিজেপি-প্রধান বঙ্গারু লক্ষ্মণের বিরুদ্ধে ওঠে দুর্নীতির অভিযোগ৷ সব মিলিয়ে বিপন্ন বিজেপিকে হারিয়ে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ জোট ২০০৪ সালে নতুন সরকার গড়ে৷ প্রধানমন্ত্রী হন মনমোহন সিং৷
ছবি: AP
নেতৃত্বে কে? মোদী, না আডবাণী?
২০১৪’র লোকসভা নির্বাচনে জেতার পর নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে মনোনীত করে বিজেপি৷ অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, দলের নেতৃত্বের দায়ভার বর্ষীয়ান নেতা এল কে আডবানির ওপর বর্তানোর কথা উঠলেও, বাস্তবে তা হয়নি৷
ছবি: AP
মোদীর উত্থান
বিজেপির ইতিহাসে ব্যক্তিকেন্দ্রীক নির্বাচনী প্রচার মোদীর ক্ষেত্রেই প্রথম৷ পূর্ববর্তী সরকারের দুর্নীতির সুযোগ নিয়ে মোদীর ‘গুজরাট মডেল’-কে আদর্শ হিসেবে তুলে ধরা হয় প্রচারে৷ সুবক্তা মোদী শীঘ্রই হয়ে ওঠেন তরুণ প্রজন্ম থেকে সংবাদমাধ্যম, সকলের প্রিয়পাত্র৷ নির্বাচনের আগে বিজেপি হিন্দু জাতীয়তাবাদকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে গেলেও, মোদীর প্রাক-নির্বাচন বক্তব্যের বড় অংশ জুড়েই ছিল ‘হিন্দুত্ব’৷
ছবি: picture alliance/AA/M. Aktas
মোদী থেকে ‘মোদীজি’
২০১৪ সালে বিজেপি ২৮২টি আসন জিতে ক্ষমতায় আসে৷ ভোটারদের কংগ্রেসের প্রতি অনাস্থার পাশাপাশি বিজেপির সাফল্যের আরেকটি কারণ ছিল আরএসএসের নিঃশর্ত সমর্থন৷ নরেন্দ্র মোদীই হন প্রধানমন্ত্রী৷ পিউ গবেষণা কেন্দ্রের একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে, প্রথম বছরের তুলনায় বর্তমানে মোদীর জনপ্রিয়তা আরো বেড়েছে, যা ২০১৯-র নির্বাচনে কংগ্রেস-সহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলির জন্যও নিঃসন্দেহে ভাবনার বিষয়৷
ছবি: Reuters
12 ছবি1 | 12
একা নরেন্দ্র মোদী বা তাঁর দলই যে পশ্চিমবঙ্গে ভোটারদের এই মেরুকরণের খবর রাখছেন, তা নয়৷ তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জিও পরোক্ষে এই বাস্তবতা স্বীকার করছেন৷ এ কারণে সমস্ত জনসভায় তিনি বলছেন, বিজেপি-বিরোধী ভোট যেন ভাগ না হয়৷ যেহেতু রাজ্যে লড়াইটা মূলত তৃণমূল বনাম বিজেপি, মমতা এমন কথাও বলছেন যে, ‘‘বাম দলগুলো, বা কংগ্রেসকে ভোট দিয়ে ভোটটা নষ্ট করবেন না৷ ভোটটা এবার তৃণমূলকে দিন৷'' অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে প্রচারে এবং প্রভাবে একেবারে পিছনের সারিতে চলে যাওয়া বাম নেতারাও পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝছেন যে, এবার অনেক বাম ভোট বিজেপির দিকে পড়বে৷ এ কথাটা প্রকাশ্যে বলে ফেঁসে গেছেন সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য প্রকাশ কারাট৷ তাঁর মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেছেন সূর্যকান্ত মিশ্র, সুজন চক্রবর্তীর মতো বাম নেতারা৷ তাঁরা মনে করেন, কারাটের এই কথায় ভুল বার্তা পৌঁছবে ভোটারদের কাছে৷ পরিস্থিতি সামাল দিতে মুখ খুলতে হয়েছে রাজনৈতিক সন্ন্যাসে চলে যাওয়া রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে৷ তিনি সম্প্রতি বাম ভোটারদের কাছে আবেদন রেখেছেন যে, বিজেপিকে ভোট দেওয়ার মতো বড় ভুল যেন কোনো বামপন্থি না করেন৷ সেটা গরম কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলোয় ঝাঁপ দেওয়ার মতো ব্যাপার হবে৷ বুদ্ধদেব এমন কথাও বলেছেন যে, রাজ্যে এখন তৃণমূলের থেকেও বড় শত্রু হলো বিজেপি, কাজেই বিজেপিকে একটি ভোটও নয়৷
কিন্তু ঘটনা হলো, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের এই মন্তব্যও পরোক্ষে স্বীকার করছে যে, এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের ভোটারদের মধ্যে এমন একটা প্রবণতা নিশ্চিতভাবেই আছে যে, তাঁরা তৃণমূল কংগ্রেস এবং মমতা ব্যানার্জিকে বেকায়দায় ফেলতে নিজেদের ভোটটা বিজেপিকেই দেবেন৷ এবং তাতেই উৎসাহিত রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব৷ মমতার দাবিমতো ‘বেয়াল্লিশে বেয়াল্লিশ' এবং ‘বিজেপি গোল্লা' না হোক, পশ্চিমবঙ্গে যেখানে বিজেপির একটি-দুটি আসন পাওয়াই হতো অতীতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, সেখানে রাজনৈতিক মহলের কানাঘুষো, ৪২ টির মধ্যে অন্তত ১০টি আসনে এবার গেরুয়া পতাকা উড়বে৷ অতি উৎসাহীরা প্রায় অর্ধেক আসনই দিয়ে রাখছেন বিজেপিকে৷ কারণ, এ রাজ্যের প্রায় ৪০% বাম ভোট এবার কোন দিকে পড়বে, সেটা একটা নির্ধারক বিষয় হয়েই থাকছে৷
ভারতে পরিবারের ভেতর রাজনৈতিক লড়াই!
পারিবারিক রাজনীতি বরাবরই ভারতের অন্যতম চিত্র৷ কিন্তু অনেক রাজনীতিক পরিবার এমনও রয়েছে, যার সদস্যরা একে অন্যের বিপক্ষ আদর্শের রাজনীতিতে বিশ্বাসী৷ দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: AP
দুই বউ দুই দলে
কংগ্রেসের রাশ প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই নেহরু-গান্ধী পরিবারের হাতে৷ জওহরলাল, ইন্দিরা, রাজীবের পর ভার গেছে রাজীব-পত্নী সোনিয়ার কাছে৷ কিন্তু ইন্দিরার আরেক পুত্র সঞ্জয়ের অকাল প্রয়াণে রাজনৈতিক আলোয় এসে পড়েন তাঁর স্ত্রী মানেকা৷ শ্বশুরবাড়ির মানুষের সাথে বনিবনা না হওয়ায় মানেকা প্রতিষ্ঠা করেন ‘সঞ্জয় বিচার মঞ্চ’ নামের একটি কংগ্রেস-বিরোধী দল৷ বর্তমানে তিনি ভারতীয় জনতা পার্টির সদস্য এবং নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রী৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Sharma
দুই ভাইয়ের মধ্যে বিবাদ
সোনিয়া, মানেকা গান্ধী পরিবারের দুই বউ৷ তাঁরা দুজনেই দুজনের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী৷ উত্তরাধিকার মেনে নিয়ে সোনিয়া-পুত্র রাহুল বর্তমানে কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ও সাংসদ৷ মানেকা-পুত্র বরুণ গান্ধীও ভারতীয় জনতা পার্টি, অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দল বিজেপি’র সাধারণ সম্পাদক ও সাংসদ৷ ছবিতে বরুণ, তাঁর মা মানেকা ও স্ত্রী যামিনী৷
ছবি: DW
মহারাষ্ট্রেও একই চিত্র
মারাঠি জাতীয়তাবাদী আদর্শে গঠিত শিব সেনার প্রতিষ্ঠাতা বালাসাহেব ঠাকরে৷ তাঁর পর কে পাবেন দলের দায়িত্ব, এই নিয়ে যখন পুত্র উদ্ধব ও ভাইপো রাজের মধ্যে বচসা বাধে, দলের ভার পান উদ্ধব ঠাকরে৷ রাজ ঠাকরে শিব সেনা ছেড়ে বেরিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন আরেকটি সম-আদর্শের দল ‘মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা’৷ দুই দলের মধ্যে আদর্শিক কোনো দ্বন্দ্ব সেভাবে না থাকলেও, মহারাষ্ট্রের নেতৃত্ব নিয়ে রাজ-উদ্ধব দ্বন্দ্ব আলোচিত৷
ছবি: Imago/Hindustan Times
রাজপরিবারের ভেতরেও দ্বন্দ্ব
গোয়ালিয়রের রাজপরিবারের মধ্যে রয়েছে রাজনীতিতে আসার ঝোঁক৷ কিন্তু সদস্যদের মধ্যে নেই মতের মিল৷ কংগ্রেস-সদস্য ও সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মাধবরাও-এর মা বিজয়রাজে সিন্দিয়া ছিলেন গোয়ালিয়রের শেষ রাজা জিবাজিরাও-এর স্ত্রী৷ প্রথম দিকে বিজয়রাজে সিন্দিয়া কংগ্রেস-বিরোধী স্বতন্ত্র পার্টিতে যোগ দিলেও পরে ভারতীয় জনতা পার্টি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন৷ ওপরের ছবিতে মাধবরাও-এর বোন বসুন্ধরা, যিনি মায়ের মতোই কংগ্রেস-বিরোধী৷
ছবি: DW/J. Sehgal
নতুন প্রজন্মও দুই দলে বিভক্ত
মাধবরাও সিন্দিয়ার পথ ধরে তাঁর পুত্র জ্যোতিরাদিত্য সিন্দিয়াও কংগ্রেসে যোগদান করেন৷ বর্তমানে তিনি দলের অন্যতম জনপ্রিয় যুবনেতা৷ অন্যদিকে তাঁর বাবার দুই বোন, যশোধারা ও বসুন্ধরা যথাক্রমে মধ্য প্রদেশ ও রাজস্থানে ভারতীয় জনতা পার্টির সাংসদ৷ শুধু তাই নয়, পিসি-ভাইপো’র মধ্যে রাজনৈতিক বিবাদের জের এসে পড়েছে পারিবারিক সম্পর্কেও৷ সংসদেও একে অন্যের বিপক্ষে লড়তে দেখা যায় বসুন্ধরা ও জ্যোতিরাদিত্যকে৷
ছবি: AP
বাবার বিরোধী ছেলে
বাবা মুকুল রায় ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্যাবিনেটের গুরুত্বপূর্ণ এই সদস্য যখন ২০১৭ সালের নভেম্বরে দল বদলে বিজেপি’তে যোগদান করেন, প্রশ্ন ওঠে, কী হবে তৃণমূল সাংসদ মুকুল-পুত্র শুভ্রাংশু’র রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ? অবশেষে ২০১৯ সালের মে মাসে এসে তিনিও যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে৷
ছবি: Ians
বলিউড পরিবারেও হলো যা...
বিখ্যাত অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিনহা সম্প্রতি ভারতীয় জনতা পার্টির সাথে তাঁর দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিন্ন করে যোগ দেন কংগ্রেসে৷ তাঁর স্ত্রী পুনম সিনহা যখন এ বছর রাজনীতির ময়দানে আসার ঘোষণা দেন, সবার মনেই ছিল প্রশ্ন– কোন দলে যাবেন তিনি? বিজেপি বা কংগ্রেস, দুই দলে না গিয়েই পুনম যোগ দিলেন সমাজবাদী পার্টিতে৷ ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে সেই দলের হয়েই তিনি লড়বেন বিজেপি’র রাজনাথ সিংয়ের বিরুদ্ধে৷