বারবার পুলিশের তলব কেন, প্রশ্ন চিকিৎসকদের
৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
কলকাতার আরজিকর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে গত বছর পথে নেমেছিলেন বহু ডাক্তারসহ লক্ষাধিক মানুষ। প্রতিবাদের আঁচ ছড়িয়ে পরেছিল সারা দেশে। এক বছরে তীব্রতা কমলেও, বিচার চেয়ে আন্দোলন আজও চলছে। সেই সময় অজস্র মিছিল, মিটিং-এর সাক্ষী থেকেছে কলকাতা। তার পর থেকেই আন্দোলনে সামিল হয়েছেন এমন বহু মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠায় পুলিশ। সম্প্রতি, চার ডাক্তার -- সুবর্ণ গোস্বামী, মানস গুমটা, দেবাশিস হালদার ও পরিচয় পণ্ডাকে বউবাজার থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ চালায় পুলিশ। সরকার বা কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করার কারণেই কি বারবার তলব? প্রশ্ন তুলেছেন ডাক্তাররা।
চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদ
বুধবার বউবাজার থানায় এই চার চিকিৎসককে ঘণ্টা দেড়েক ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। তাদের দাবি, তাদেরকে ৪২টি করে প্রশ্ন করা হয়েছে।
গত বছর উৎসবের সময়ে ধর্মতলায় ডোরিনা ক্রসিং লাগোয়া এলাকায় চিকিৎসকদের অনশন ও প্রতিবাদ কর্মসূচি ছিল। সেই জমায়েত বেআইনি বলে অভিযোগ তুলে পুলিশ কয়েকটি মামলা করে চিকিৎসকদের নামে। তাদের বিভিন্ন সময়ে বউবাজার ও হেয়ার স্ট্রিট থানায় তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
আরজি কর আন্দোলনে প্রথম সারির মুখ জুনিয়র চিকিৎসক দেবাশিস হালদার বুধবার এই জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়েন। তিনি সংবাদ মাধ্যমে বলেন, "৪২ দফা প্রশ্ন করা হয়েছে। বেশিরভাগ প্রশ্ন মিছিল সংক্রান্ত। এই মিছিল বেআইনি কার্যকলাপ বলে আমরা স্বীকার করছি কি না। আমরা বলেছি, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করা আমাদের অধিকার। এটা কে অপরাধ বলা যায় না। আমাদের ব্যাঙ্ক একাউন্ট নম্বর জানতে চাওয়া হয়, যেটা এই তদন্তের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে আমার ধারণা।"
আন্দোলনকারী চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামীর ডিডাব্লিউকে বলেন, "গত বছরে আট অক্টোবর মেডিক্যাল কলেজ থেকে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে ধর্মতলা পর্যন্ত চিকিৎসকদের মিছিল হয়েছিল। এটাকে অপরাধ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এটাকে সামনে রেখে নানারকম প্রশ্ন করা হয়েছে। এমনকী, আরজি করের ঘটনার বর্ষপূর্তির দিনে কোথায় ছিলাম জানতে চেয়েছিল পুলিশ।"
তিনি বলেন, "পুলিশকে বলেছি আপনারা কোনো অপরাধী খুঁজে পাচ্ছেন না, চিকিৎসকদের তলব করছেন। যে নেতা পুলিশের বাড়ির মহিলাদের অপমানজনক কথা বলেন, তাকে স্পর্শ করতে পারেন না। অথচ পুলিশ ডেকে পাঠায় চিকিৎসকদের, যেহেতু তারা একটি নৃশংস হত্যার প্রতিবাদে মিছিল করেছেন।"
চিকিৎসকদের পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের প্রতিবাদে ফের মিছিল হয়েছে শহরের রাজপথে। মেডিক্যাল কলেজ থেকে বউবাজার থানা পর্যন্ত মিছিল করে জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টর্স ও অভয়া মঞ্চ।
আগেও তলব চিকিৎসকদের
তবে এই চার জন ডাক্তার প্রথম নন। ইতিমধ্যে তলব করা হয়েছে সিনিয়র চিকিৎসক কৌশিক চাকী, জুনিয়র চিকিৎসক অনিকেত মাহাতো ও আসফাকুল্লা নাইয়াকে। চাকীর বিরুদ্ধে একাধিক এফআইআর রয়েছে। থানার তলব প্রসঙ্গে আইনজীবী শীর্ষেন্দু সিংহ রায় সংবাদমাধ্যমে বলেন, "ব্যস্ত চিকিৎসকদের একই দিনে আলাদা আলাদা সময়ে তলব করা হচ্ছে। একই দিনে দুপুর একটার সময়ে তলব করে আবার বিকেল চারটেয় আসতে বলা হচ্ছে। রোগীদের ফেলে রেখে চিকিৎসকরা থানায় আসছেন সহযোগিতা করতে।"
গত আগস্টে কলকাতার হেয়ার স্ট্রিট থানায় জুনিয়র চিকিৎসক অনুষ্টুপ মুখোপাধ্যায়কে ডাকা হয়েছিল। বউবাজার থানায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় ইন্টার্ন ঋতব্রত ঘোষকে। তলব করা হয়েছিল জুনিয়র চিকিৎসক অঞ্জন মণ্ডল এবং অনিন্দ্যসুন্দর মণ্ডলকেও।
একের পর এক চিকিৎসককে পুলিশি তলবের প্রতিবাদে ইতিমধ্যে নগরপালকে চিঠি দিয়েছেন চিকিৎসকরা। তাদের যৌথ মঞ্চের পক্ষ থেকে কলকাতার পুলিশ কমিশনার মনোজকুমার ভার্মাকে ই–মেল পাঠানো হয়। পুলিশি হেনস্থার অভিযোগ তুলে অবিলম্বে মামলা দায়ের ও জিজ্ঞাসাবাদের কার্যকলাপ বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। একইভাবে সাধারণ নাগরিকদের পক্ষেও তারা আওয়াজ তুলেছেন। যদিও এর দু'দিনের মধ্যেই ফের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়েছেন সুবর্ণ গোস্বামী, দেবাশিস হালদাররা।
শাসক দলের প্রতিনিধিরা অবশ্য পুলিশের এই আচরণকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসেবে দেখছেন না। বরং তৃণমূল কংগ্রেস যুক্তি দিয়েছে, নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পরলে হাজিরা দিতেই হবে। শাসক দলের মুখপাত্র মৃত্যুঞ্জয় পাল ডিডাব্লিউকে বলেন, "অনেকে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য একাংশের চিকিৎসকরা এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। এরা মানুষকে ভুল বুঝিয়ে চলেছেন। বাম ও অতি বামেরা এর পিছনে রয়েছে। এছাড়া আন্দোলনের জন্য কিউআর কোড দিয়ে টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে যার হিসাব পাওয়া যায়নি। নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে যদি রাজ্য সরকারের সংস্থা চিকিৎসকদের ডেকে থাকে, তারা হাজিরা দিতে যাবেন। এর মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কোনো বিষয় নেই। আরজি কর আন্দোলনে যুক্ত থাকা মানেই যা খুশি করা যাবে, এটা ভাবা ঠিক নয়।"
আরজিকরের ঘটনার সম্পর্কে তিনি বলেছেন, "এই তদন্ত এখন সিবিআইয়ের হাতে রয়েছে। তারাই পারে সঠিক তদন্ত করে বিচার পাইয়ে দিতে।"
যদিও শাসক দলকে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়া চিকিৎসকরা। সিনিয়র চিকিৎসক কৌশিক চাকী ডিডাব্লিউকে বলেন, "গত বছরের ২০ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট আরজি কর মামলার প্রথম শুনানিতে স্পষ্ট বলে দিয়েছিল, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করার অধিকার নাগরিকের আছে, তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রয়োগ করা চলবে না। তা সত্ত্বেও এক বছর আগে, কে কোন মিছিলে হেঁটেছিলেন, এ সব নিয়ে থানায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রেখে চিকিৎসকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাদের পরিষেবা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে।"