ভুল করে বা সজ্ঞানে আবু সালেকের জায়গায় দুদকের মামলা গ্রেফতার করা হয় পাটকল শ্রমিক জাহালমকে৷ তিন বছর বিনা বিচারে জেল খাটার পর উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে ছাড়া পেয়েছেন৷ কিভাবে জড়ালেন এই মামলায়?
জাহালম : ২০১৪ সালের দিকে আমাদের চেয়ারম্যান হঠাৎ করে আমাকে ডাকেন৷ আমি তো ঘোড়াশালে বাংলাদেশ জুট মিলে চাকরি করি৷ আমি বাড়িতে গেলে তিনি আমাকে আমার ছবি দেখান আর আবু সালেকের ছবি দেখান৷ আমি তাকে বলি, এটা আমার ছবি, আর অন্যটা আমি চিনি না৷ আমার জীবনে আমি কোট টাই পরিনি৷ তখন তিনি বলেন, একরকমই তো দেখা যায়? আমি বলি কত পার্থক্য! এরপর আমি ঘোড়াশাল চলে আসি৷ হঠাৎ করে একদিন দুদকের লোক আমার মিলে আসে৷ তারা আমার ছবি তোলে৷ এর কয়দিন পর আমার কাছে চিঠি আসে৷
‘‘চ্যানেল ২৪ এর কারণে আমি নতুন জীবন পেয়েছি’’
এইচিঠিকিদুদকথেকেআসেনাআদালতথেকে?
এটা দুদক থেকে আসে৷ আমি ভাইকে জানাই৷ পরে আমি গুলিস্তান যাই, ভাইও আসে৷ আমরা তিনভাই তখন একসঙ্গে দুদকে যাই৷
এটাকতসালেরঘটনা?
এটা ২০১৪ সালের ঘটনা৷ পরে সেখানে গেলে তারা সালেকের ছবি দেখায় আর আমার ছবি দেখাই৷ আমি তাদেরও বলি, এটা আমার ছবি, আর অন্যটা আমি চিনি না৷ কোন ব্যাংকে আমার একাউন্ট নেই৷ তারা বারবার বলে ওটা আমার ছবি, আমি তাদের বারবার না করেছি৷
দুদকেরকোনকর্মকর্তাএটাকরেছেন?
দুই তিন জন কর্মকর্তা ছিলেন৷ এভাবে কয়েকবার সেখানে যাই৷ তারা আমারে প্রশ্ন করে আপনি ঢাকা ভার্সিতে পড়েছেন? আমি বলি কোন স্কুলেই আমি যাইনি৷ তারা আমারে জুট মিল থেকে কাগজ আর মার আইডি কার্ড আনতে বলে৷ সেগুলোও তাদের দেখাই৷ সালেক যে স্বাক্ষর দিয়েছে আমারে ইংরেজিতে সেই স্বাক্ষর দিতে বলে৷ কিন্তু আমি তো জীবনেও ইংরেজিতে স্বাক্ষর দেইনি৷ কেমনে দেব? আমারে কয় গুলশানে বাড়ি আছে, চারটি কোম্পানীর মালিক আমি, সবই অস্বীকার করি৷ এরপর হঠাৎ করে একদিন ঘোড়াশাল থেকে আমারে এ্যারেস্ট করে পুলিশ৷
এটাকতসালেরঘটনা?
২০১৬ সালের দুই মাসের ৫ তারিখে৷ তারা কোন কথাই শোনে না৷ সালেক বলে ধরে নিয়ে যায়৷ সেখান থেকে টাঙ্গাইল নিয়ে যায়৷ সেখানে আট দিন রাখে৷ সেখান থেকে ডান্ডা বেড়ি পরায়ে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠায়৷ সেখানে ৪ মাস খুব কষ্টে ছিলাম৷ আমি তো গরীব মানুষ, সপ্তাহে ৩৬০০ টাকা তাদের কোথা থেকে দেব?
জীর্ণ আদালতে দীর্ঘ বিচার
মামলার অনুপাতে বিচারক আর বিচারিক অবকাঠামোর সংকট বাংলাদেশের৷ এ কারণে বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা চরম৷ আদালত অবকাঠামোর জীর্ণ-শীর্ণ পরিস্থিতি দেখে নিন ছবিঘরে৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
বিচারের অপেক্ষা
আদালতের বারান্দায় মানুষের এমন দীর্ঘ সারিই প্রমাণ করে, কতোটা মামলাজট নিয়ে চলছে বাংলাদেশের বিচারিক কার্যক্রম৷ বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের দুই বিভাগে বিচারাধীন মামলা পাঁচ লাখ ৩৭ হাজার ৯৪টি৷ আর নিম্ন আদালতে বিচারাধীন মামলা ৩০ লাখ ৩২ হাজার ৬৫৬টি৷ গত বছর চার লাখ ৪৭ হাজার ৮৫৪টি মামলা দায়েরের বিপরীতে নিষ্পত্তি হয়েছে দুই লাখ ৮৪ হাজার ১৩১টি৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
বিচারক সংকট
বিচারাধীন মামলার তুলনায় বিচারকের অপর্যাপ্ততার একটি চিত্র উঠে এসেছে সুপ্রিম কোর্টের জুডিশিয়াল রিফর্ম কমিটি ও জার্মান উন্নয়ন সংস্থা (জিআইজেড)-এর এক প্রতিবেদনে৷ তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি দশ লাখ লোককে মাত্র ১০ জন বিচারক বিচারিক সেবা দিচ্ছেন৷ যুক্তরাষ্ট্রে এই সংখ্যা ১০৭, কানাডায় ৭৫, ব্রিটেনে ৫১, অস্ট্রেলিয়ায় ৪১, ভারতে ১৮ জন৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
ফাইলের স্তুপ
মামলাজটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে নথিপত্রের স্তুপ৷ আর বছরের পর বছর চাপা পড়ে থাকে একেকটি ফাইল৷ আধুনিক ব্যবস্থা না থাকায় সেকেলে পদ্ধতিতে চলছে নথিপত্র সংরক্ষণ৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
জামিনে কারসাজি
মামলাজটের মধ্যে আদালতে জামিন কারসাজির বহু ঘটনা ঘটে৷ আইনজীবীদের পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িত এসবের সঙ্গে৷ ২০১৫ সালে বিচারকের জাল স্বাক্ষরে ভুয়া জামিননামা তৈরি করে শতাধিক দাগি আসামিকে আদালত থেকে ছাড়ানোর ঘটনা ঘটেছিল৷ তদন্তে নেমে দুদক জানতে পারে, এরসঙ্গে আদালতের পেশকার, উমেদার ও পিয়ন জড়িত ছিল৷
আদালতপাড়ায় অনেক সময় প্রতারণার ফাঁদ পাতে একদল প্রতারক৷ কখনো আইনজীবী, কখনো সাংবাদিক কিংবা মানবাধিকারকর্মীর ভুয়া পরিচয়ে বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয় তারা৷ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি না হলে মামলার ফাঁদে ফেলাসহ বিভিন্ন হয়রানি করে তারা৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
ঘিঞ্জি পরিবেশ
বেশিরভাগ আদালতে ঘিঞ্জি পরিবেশে কাজ করেন আইনজীবী এবং আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা৷ এমন আলোছায়ার কক্ষে কাজ চলে ঢাকার আদালতে৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
বিচারের আগেই শাস্তি!
কারাগার কিংবা থানা থেকে এসব প্রিজন ভ্যানে আসামি আনা হয় আদালতে৷ সংকীর্ণ এসব প্রিজন ভ্যানে বেশির ভাগ সময়ে গাদাগাদির কারণে বিচার শেষ হওয়ার আগেই যেন শাস্তি পেয়ে যান আসামিরা৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
অন্ধকারে রেকর্ড রুম
অন্ধকার ও ঘুপচি এই কক্ষই ঢাকা মহানগর ও দায়রা জর্জ আদালতের রেকর্ড রুম৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
নোংরা শৌচাগার
আদালত বিশৃঙ্খল অবস্থাই শুধু নয়, সেখানে আসলে নানা রকম প্রতিবন্ধকতার শিকার হন বিচার প্রার্থীরা৷ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভাবে শৌচাগারে এমন বেহাল অবস্থার চিত্র ঢাকা আদালতের৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
নথিপত্রের জায়গা সিঁড়ির তলা
নথিপত্র সংরক্ষণের আধুনিক ব্যবস্থা নেই আদালত কর্তৃপক্ষের৷ এর মধ্যে ভেতরে জায়গা নাই৷ জীর্ণ আদালত ভবনের সিঁড়ির নীচে জায়গা পেয়েছে এসব নথিপত্র৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
11 ছবি1 | 11
কারাগারেকতদিনছিলেন?
তিন বছরের তিন দিন কম ছিলাম৷
মামলাচালাতেপরিবারেরখরচহয়েছেকেমন?
আমরা তো একবেলা ভাত খাই, অন্য বেলা না খেয়ে থাকি৷ এখন তো মানুষের জ্বলায় বাড়িতে থাকতেই পারি না৷ সবাই টাকা পবে? কেমনে দিমু?
কেমনধারেরমধ্যেপড়েছেআপনারপরিবার?
কত টাকা ভাই বলতে পারবে৷ তবে বাড়ি গেলে খালি দেখি, লোকজন আসছে, আর টাকা চাচ্ছে৷
আপনিকিচাকরিফিরেপেয়েছেন?
ঘোড়াশালে জুটমিলে চাকরি ফিরে পেয়েছি৷
এখনওকিকোর্টেহাজিরাদিতেহয়?
হাইকোর্টে বিচারক আমাকে দেখতে চেয়েছিলেন, আমি সেখানে গিয়েছিলাম৷ এছাড়া ৪/৫ বার কোর্টে গেছি৷
দুদকথেকেকিকেউযোগাযোগকরেছে?
একজন কমিশনার হয়তো তদন্ত করতে আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন৷
আপনিকোনআর্থিকসহায়তাপেয়েছেন?
একজন গার্মেন্ট মালিক ২০ হাজার টাকা চেক, আর ৫ হাজার টাকা দিয়েছিলেন৷ আরো কয়েকজন ২/৫ হাজার টাকা দিছেন৷
আপনিবিয়েকরেছেন?
হ্যাঁ, ৬ বছরের একটা মেয়ে আছে৷
আপনিযখনজেলেছিলেন, পরিবারকিভাবেচলেছে?
আমার বউ চাকরি করেছে৷ আমারে দু'এক মাস পর ৫০০ টাকা দিত তাই দিয়ে চলতাম৷
হাইকোর্টেকিভাবেপৌঁছালেন?
আমি তো জেলে ছিলাম, ভাই জানে৷ তবে চ্যানেল ২৪ এর কারণে আমি নতুন জীবন পেয়েছি৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷