রেইনট্রি হোটেলে দুই তরুণী ধর্ষণের শিকার হওয়ার রেশ না কাটতেই ঢাকার ওই বনানী এলাকাতেই বার্থডে পার্টিতে দাওয়াত দেয়ার নামে আরেক তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে৷ পুলিশ মামলা নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে৷ তবে আসামি এখনো আটক হয়নি৷
বিজ্ঞাপন
মামলার এজাহার অনুযায়ী, ধর্ষণের ঘটনা ঘটে মঙ্গলবার দিবাগত রাতে বনানীর ২ নম্বর সড়কের একটি বাসায়৷ তরুণী ঘটনার পর বনানী থানায় হাজির হয়ে বাহাউদ্দিন ইভান নামে এক জনকে আসামি করে মামলা করেন৷ আসামির বাবা শিল্পপতি বোরহান উদ্দিন৷ ইভান বিবাহিত এবং তার এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে৷ তরুণী উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী এবং টিভি অভিনেত্রী বলে পুলিশকে জানিয়েছেন৷
থানা মামলা নিয়ে তরুণীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠায়৷ বৃহস্পতিবার পরীক্ষার পর ফরেনসিক চিকিৎসক ডা. সোহেল মাহমুদ জানান, ‘‘ভিকটিমকে ৪৮ ঘন্টার আগেই পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে৷ আমরা ৩৬ ঘন্টার মধ্যে তার প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করেছি৷ ধর্ষণের আলামত পাবো বলে আশা করি৷ তবে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিতে কয়েকদিন সময় লাগবে৷''
আমলাটি পুলিশের উইমেন অ্যান্ড ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার তদন্ত করবে৷ তবে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শুরু হয়নি৷ থানা পুলিশই এখনো তদন্ত অব্যাহত রেখেছে৷
আব্দুল মতিন
এজাহারে তরুণী অভিযোগ করেছেন, ১১ মাস আগে আসামি ইভানের সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে তাঁর পরিচয়৷ এরই সূত্র ধরে মঙ্গলবার রাত ৯টায় আসামি ওই তরুণীকে ফোন করে নিজের জন্মদিনের কথা জানিয়ে বাসায় আমন্ত্রণ জানান৷ ইভান ওই তরুণীকে নিজের পরিবারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কথাও বলেন৷
এরপর ওই তরুণী রাত সাড়ে ১০টার দিকে আসামির বাড়িতে পৌঁছান৷ এ সময় তিনি বাসায় কাউকে না দেখলে আসামির মায়ের কথা জানতে চান৷ জবাবে আসামি জানান, বাবা-মা অসুস্থ বলে ঘুমিয়ে পড়েছেন৷ সকালে তাঁদের সঙ্গে ওই তরুণীর পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে৷ তখন বাসায় জন্মদিনের উৎসবের কোনও ধরনের আয়োজন না দেখতে পেয়ে তরুণী বাসায় ফিরতে চান৷ কিন্তু তাঁকে বাধা দেন ইভান৷ পরে ওই তরুণীকে নেশাজাতীয় দ্রব্য খাওয়ানো হয়৷ রাত দেড়টার দিকে ধর্ষণের শিকার হন তরুণী৷ তিনি চিৎকার করলে রাত সাড়ে ৩টার দিকে তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় ইভান৷
এজাহারে আরো অভিযোগ করা হয়েছে, পরিচয়ের পর এর আগেও ইভান বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করেছে ওই তরুণীকে৷ কাউকে কিছু না বলার জন্য ভয়ভীতিও দেখিয়েছে৷ ধর্ষণের শিকার তরুণীর গোপন ওই ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছে সে৷
মাসুদুর রহমান
বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আব্দুল মতিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তরুণী ঘটনার পর বুধবার ভোররাতেই থানায় এসে অভিযোগ করেন৷ তাঁকে ধর্ষণের পর বাড়ি থেকে বাইরে বের করে দেয়া হয়৷ আমরা এখন আসামিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি৷ তার বনানীর বাসায় অভিযোগ পাওয়ার পরই তল্লাশি চালিয়েছি৷ তাকে পাওয়া যায়নি৷ ধারণা করছি, ঘটনার পরপরই আসামি পালিয়ে গেছে৷ তবে তাকে আটকের সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত আছে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘ফরেনসিক পরীক্ষা ছাড়াও আমরা কিছু আলামত জব্দ করেছি৷ তবে তদন্তের স্বার্থে সেসব আলামত সম্পর্কে এখন বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না৷''
আর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অবশ্যই আসামি গ্রেপ্তার হবে৷ আর ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য কোনো সময়ক্ষেপন করা হয়নি৷ আমরা প্রয়োজনীয় আইনি প্রক্রিয়া শেষে ২৪ ঘন্টার মধ্যেই ভিকটিমকে মেডিকেলে পাঠিয়েছি৷''
প্রসঙ্গত, ওই বনানী এলকারই রেইনট্রি হোটেলে গত ২৮ মার্চ রাতে জন্মদিনের দাওয়াত দিয়ে দুই তরুণীকে আটকে রেখে অস্ত্রের মুখে ধর্ষণ করা হয়৷ ওই ধর্ষণ মামলার আসামি সাফাত আহমদ, নাঈম আশরাফ, সাদমান সাকিফ, সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল ও দেহরক্ষী আবুল কালাম আজাদকে ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে পুলিশ গ্রেপ্তার করে৷ এখন তারা কারাগারে আছে৷ তাদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে৷ এবং বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে৷
কেন এত ধর্ষণ? কী করলে কমবে এ জঘন্য অপরাধ?
নারী স্বাধীনতা, নারী আন্দোলন, নারী অধিকার নিয়ে সর্বত্র আলোচনা, সমালোচনা, বক্তৃতা, অন্যদিকে বেড়ে চলেছে ধর্ষণের সংখ্যা৷ কিন্তু কেন? এর জন্য কারা দায়ী, কী করে ধর্ষণ কমিয়ে আনা সম্ভব? বা ধর্ষিতা নারীদের কী-ই বা করা উচিত?
ছবি: Advocate Tanbir ul Islam Siddiqui
নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট
নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন রিপোর্ট বলছে, বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অহরহ৷ তার ওপর পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধের যেসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, সেটাও যথার্থ নয়৷ এছাড়া বিশ্বের মোট নারীর ৭ শতাংশ নাকি জীবনের যে কোনো সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷
ছবি: Fotolia/DW
উন্নত বিশ্বের নারীরাও রেহাই পান না
ধর্ষণ শব্দটি শুনলেই মনে হয় এ ধরণের অপরাধ হয়ে থাকে শুধু অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে৷ আসলে কিন্তু মোটেই তা নয়৷ সমীক্ষায় দেখা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই শতকরা ৩৩ জন মেয়ে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়৷ এমনকি জার্মানির মতো উন্নত দেশের নারীরাও যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত৷
ছবি: Fotolia/detailblick
ধর্ষিতা নারীরা জানাতে ভয় পান
জার্মানিতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত বা ধর্ষিত নারীদের সঠিক পদ্ধতিতে ‘মেডিকেল টেস্ট’-এর ব্যবস্থা করে, এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত স্ত্রী বিশেষজ্ঞ ডা. সোনিয়া পিলস বলেন, ‘‘ধর্ষণের শিকার নারী লজ্জায় এবং আতঙ্কে থাকেন৷ তিনি পুলিশের কাছে গিয়ে সে অভিজ্ঞতা বা ধর্ষক সম্পর্কে তথ্য জানাতে ভয় পান, কুণ্ঠা বোধ করেন৷ অনেকদিন লেগে যায় ধর্ষণের কথা কাউকে বলতে৷
ছবি: detailblick/Fotolia
ধর্ষককে ধরার জন্য দ্রুত ডাক্তারি পরীক্ষা
ধর্ষণের পর নারীদের কী করণীয় – এ বিষয়ে জার্মানির ধর্ষণ বিষয়ক নির্দেশিকায় কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে৷ যেমন ধর্ষণের পর একা না থেকে কারো সাথে কথা বলা৷ গোসল, খাওয়া, ধূমপান, বাথরুমে যাওয়ার আগে, অর্থাৎ ধর্ষণের চিহ্ন মুঝে না যাবার আগে ডাক্তারি পরীক্ষা করানো৷ এ পরীক্ষা করালে ধর্ষক কোনো অসুখ বা এইচআইভি-তে আক্রান্ত ছিল কিনা, তা জানা সম্ভব৷ নারীর শরীরে নখের আচড় বা খামচি থাকলে ধর্ষকের চিহ্ন সহজেই পাওয়া যায়৷
ছবি: DW/M. Ruettinger
যাঁরা ধর্ষণের শিকার, তাঁদের জন্য জরুরি বিভাগ
ধর্ষক যেসব জিনিসের সংস্পর্শে এসেছে, অর্থাৎ অন্তর্বাস, প্যাড এ সব তুলে রাখুন৷ ছবিও তুলে রাখতে পারেন৷ নিজেকে দোষী ভাববেন না, কারণ যে ধর্ষণের মতো জঘণ্যতম কাজটি করেছে – সেই অপরাধী, আপনি নন৷ জার্মানির বেশ কয়েকটি শহরের হাসপাতালে যৌন নির্যাতন বিষয়ক আলাদা জরুরি বিভাগ রয়েছে৷ তাছাড়া ধর্ষণ সংক্রান্ত নানা প্রশ্নের উত্তর জানতে রয়েছে ‘গেভাল্ট গেগেন ফ্রাউয়েন’, যেখানে ২৪ ঘণ্টাই টেলিফোন করা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গ্রুপ থেরাপি
যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের শিকার নারীদের মানসিক ও শারীরিক সমস্যা সমাধানের জন্য জার্মানিতে রয়েছে গ্রুপ থেরাপি, যার সাহায্যে নারীরা আবার সমাজে সহজভাবে মিশতে পারেন এবং তাঁদের জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটি সহজে ভুলে যেতে পারেন৷
ছবি: dpa
সবচেয়ে বেশি যৌন অপরাধ হয় বাড়িতেই
ভারতের কোথাও না কোথাও প্রতি ২২ মিনিটে একটি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে৷ তাই আদালতের নির্দেশে ভারতের পুলিশ বিভাগ এক সমীক্ষা চালিয়েছিল দিল্লির ৪৪টি এলাকায়৷ চলতি বছরের গত আট মাসে ২,২৭৮টি ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন এবং যৌন অপরাধের তদন্তের ফলাফলে দেখে গেছে: ১,৩৮০টি ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা হলেন পরিবারের লোকজন এবং পরিচিতজনেরা৷ অর্থাৎ নিজের বাড়িতেও মেয়েরা নিরাপদ নয়!
ছবি: Fotolia/Miriam Dörr
সঠিক বিচার চাই
২০১৩ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দিল্লিতে গণধর্ষণ ঘটনার পর, ভারতে ঘটা করে বিচার বিভাগীয় কমিশন বসিয়ে ধর্ষণ, যৌন নিগ্রহ দমনে আইন-কানুন ঢেলে সাজানো হয়৷ শাস্তির বিধান আরো কঠোর করা হয়৷ কিন্তু তাতে যৌন অপরাধের সংখ্যা না কমে বরং বেড়েছে৷
ছবি: picture alliance/abaca
বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার
বাংলাদেশে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১১ সালে ৬২০ জন, ২০১২ সালে ৮৩৬ জন, ২০১৩ সালে ৭১৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ মাত্র ছ’মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৩১টি এবং এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮২ জন৷ তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে অপহরণ করে ধর্ষণ এবং পরে হত্যার ঘটনাও অনেক বেড়েছে৷
ছবি: DW
নারীর পোশাকই কি ধর্ষণের জন্য দায়ী?
বাংলাদেশের একজন পুলিশ কর্মকর্তা একটি মার্কিন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘‘বাংলাদেশের নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেপরোয়াভাবে, বেপর্দায় চলাফেলার কারণে ধর্ষণের শিকার হন৷’’ পুলিশের কর্মকর্তার দাবি, ধর্ষণের দায় প্রধানত নারীদের৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘বখাটে ছেলেরা তো ঘোরাফেরা করবেই৷’’ এ কথা শুধু পুলিশ কর্মকর্তার নয়, ভারত-বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থাই এরকম৷ ধর্ষণ বন্ধ করতে এই মধ্যযুগীয় চিন্তা, চেতনার পরিবর্তন প্রয়োজন৷
ছবি: AFP/Getty Images/M. Uz Zaman
ছোট বেলা থেকে সচেতন করতে হবে
ধর্ষণ সম্পর্কে ছোটবেলা থেকে সঠিক ধারণা দিলে স্বাভাবিকভাবে ধর্ষণের সংখ্যা কমবে৷ তাছাড়া পাঠ্যপুস্তকেও বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া উচিত৷ ধর্ষিতা নারীকে শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার শিকার হতে হয়, সে সম্পর্কেও সচেতনতা দরকার৷ অনেকে যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন৷ গোটা সমাজও নারীকেই দোষ দিয়ে থাকে৷ ডাক্তারি বা মনস্তাত্ত্বিক সাহায্য ছাড়াও প্রয়োজন পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও সমাজের বন্ধুবৎসল আচরণ৷