অর্থনৈতিক মন্দার ধাক্কা সামলাতে কোনো কোনো দেশ হিমশিম খাচ্ছে এখনো৷ ইউরোপের এমন কিছু দেশের বেশ কিছু ছবি দেখানো হচ্ছে বার্লিনালেতে৷ ছবিগুলো দেখাচ্ছে হতাশা, আশার আলো জ্বালাচ্ছে একইসঙ্গে৷
বিজ্ঞাপন
ইউরোপের দুটি দেশ স্পেন আর গ্রিস এখনো অর্থনৈতিক মন্দার তীব্র মন্দ হাওয়ার তোড়ে বেসামাল৷ ঋণ সংকট এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে বাধ্য হয়ে দুটি দেশের সরকারকে নিতে হয়েছে ব্যাপক ব্যয়সংকোচনের উদ্যোগ৷ আর তাতেই এক ধরনের সংকট দেয়া দিয়েছে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে৷ বিশেষ করে চলচ্চিত্র জগত আগের মতো আর সরকারি অনুদান পাচ্ছে না৷ স্বাভাবিক কারণেই অনুদানের ছবির সংখ্যা কমেছে৷
নানা রঙে রঙিন বার্লিনালে ২০১৩
‘‘বার্লিনালে আসছে’’– বললেই অনেকে বুঝে নেন জার্মানিতে শুরু হতে চলেছে বিশাল এক চলচ্চিত্র উৎসব৷ বার্লিনালে মানে ভালুকও থাকবে সেখানে৷
ছবি: Brian Deutschmann
ভালুক আসছে...
‘‘বার্লিনালে আসছে’’– বললেই অনেকে বুঝে নেন জার্মানিতে শুরু হতে চলেছে বিশাল এক চলচ্চিত্র উৎসব৷ বার্লিনালে মানে ভালুকও থাকবে সেখানে৷ ৭ই ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে উৎসব চলবে ১৭ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত৷ ১৯ জন পরিচালকের ছবি থাকবে প্রতিযোগিতায়৷ যিনি সেরা হবেন, তাঁর হাতেই উঠবে ভালুক৷ এখানে সেরার পুরস্কারই যে ‘গোল্ডেন বিয়ার’!
ছবি: Reuters
‘প্রেসিডেন্ট’ ওয়ং কার-ওয়াই
হ্যাঁ, তিনিও ‘প্রেসিডেন্ট’, তবে কোনো দেশের নয়, বিচারকদের নেতা তিনি৷ বার্লিনালের ৬৩তম আয়োজনে যে জুরি বোর্ড তারই প্রেসিডেন্ট ওয়ং কার-ওয়াই৷ নিজে পরিচালক৷ হংকং-এর নাগরিক ওয়ং-এর সর্বশেষ ছবি,‘ দ্য গ্র্যান্ডমাস্টার’ এবারের উৎসবেরও দেখানো হবে৷ তবে মূল প্রতিযোগিতায় থাকছে না সেটা৷
ছবি: 2011 Block 2 Productions Ltd.
সেই জাফর পানাহি
দু’বছর আগে তাঁকে ছয় বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল ইরান সরকার৷ শুধু কি তাই, বলা হয়েছিল ২০ বছরের মধ্যে দেশে কোনো কাজই করতে পারবেন না জাফর পানাহি৷ হাত বেঁধে ছেড়ে দেয়ার মতো অবস্থা আর কি! তা পানাহির মতো মানুষ কি কাজ ছাড়া থাকতে পারেন? ছবি নির্মাণের কাজ চলছেই৷ তাঁর নতুন ছবি ‘পার্দে’ বার্লিনালেতে নজর কাড়বেই৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তারার মেলা
বার্লিনালে চলবে আর বার্লিনে তারার মেলা বসবে না তা কি হয়? হলিউড, বলিউড থেকে শুরু করে বলতে গেলে বিশ্বের মোটামুটি সব দেশ থেকেই চলচ্চিত্র তারকারা এ সময়টায় চলে আসেন জার্মানিতে৷ ম্যাট ডেমন, স্টিভেন সনডারব্যার্গরা তো থাকবেনই, আরো অনেকেই আসছেন লাল গালিচার সংবর্ধনা নিয়ে বার্লিনালের আকর্ষণ বাড়াতে৷
ছবি: Scott Green
বার্নিলানের ‘রাজা’
জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল আর বার্লিনালের ‘রাজা’ ডিটার কসলিক৷ ১০ বছর ধরে যিনি বিশ্বের এত বড় এক উৎসবের পরিচালক, যাঁর নেতৃত্বে বার্লিনের এ আয়োজন দিন দিন আরো আলো ছড়াচ্ছে, তাঁকে ‘বার্লিনালের রাজা’ বলা যেতেই পারে, কী বলেন? তা কসলিক যে সমালোচনার ঊর্ধে সেরকম মোটেই নয়৷ তারপরও সত্যি হলো, তাঁর হাত ধরে বার্লিনালে এগোচ্ছে৷
ছবি: dapd
স্বাদে ভরপুর...
বার্লিনালের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে প্রায় নাম না জানা সব দেশের অখ্যাত পরিচালকদের ছবিও পায় দর্শক নন্দিত হওয়ার সুযোগ৷ এ নিয়মের ব্যতিক্রম হচ্ছে না এবারও৷ তাই থাকবে সুইজারল্যান্ডের পাসক্যাল মারসিয়ারের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি ছবি ‘নাইট ট্রেন টু লিসবন’ দেখার সুযোগ৷ দেশের তালিকাতেও থাকবে ‘বিশ্বায়নের যুগ’-কে তুলে ধরার প্রমাণ৷
ছবি: 2012 Concorde Filmverleih/Sam Emerson
জার্মানির প্রতিনিধিত্ব
আয়োজক দেশ জার্মানির প্রতিনিধিত্ব করবে যে ছবিগুলো তার মধ্যে সবার আগে বলতে হবে টোমাস আর্সলানের ‘গোল্ড’-এর কথা৷ অবশ্য দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্ম নেয়া, বার্লিনে চলচ্চিত্র নিয়ে লেখাপড়া করে পরিচালনায় নামা পিয়া মারাইসের ‘লায়লা ফোরি’-র কথাও ভুললে চলবেনা৷ যৌথ প্রযোজনার এ ছবিটি দক্ষিণ আফ্রিকার এক একক মা-কে নিয়ে তৈরি৷
ছবি: Pandora Film
অন্যরকম আকর্ষণ
আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র ফোরাম৷ ‘ফোরাম’ শুনলেই মনে হয় না কোনো বিশেষ ভাবনা নিয়ে কিছু মানুষ এক হয়েছে? হয়েছেও তাই৷ বার্লিনালেতে বাণিজ্যিক সাফল্যের লক্ষ্যকে সামনে রেখে তৈরি হয়নি এমন ছবিগুলোও দেখানো হবে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে৷ তাই সামাজিক প্রয়োজন, খেটে খাওয়া মানুষের বাঁচার লড়াইয়ের মতো বিষয়গুলোও উঠে আসবে রূপালি পর্দায়৷
ছবি: Berlinale 2013
‘এ পৃথিবী আমাদের নয়’
ছবির নাম যদি হয় ‘এ পৃথিবী আমাদের নয়’, দেখতে মন চাইবে কিনা বলুন? ছবিটির পরিচালক ডেনমার্কের মাহদি ফ্লাইফেল৷ এটা অবশ্য পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি নয়, তথ্যচিত্র৷ আরবি এবং ইংরেজি – দুই ভাষাতেই তৈরি হয়েছে ছবিটি৷ দক্ষিণ লেবাননের এক শরণার্থীর দৈনন্দিন যুদ্ধ নিয়ে তৈরি এ তথ্যচিত্রের মতো এমন অনেক তথ্যচিত্রই থাকবে সাধারণ দর্শক সচরাচর যা দেখেন না৷
ছবি: Berlinale 2013
আদিবাসিদেরও উৎসব
আদিবাসিদের নিয়ে ছবি দেখতে চান? বার্লিনালেতে সে সুযোগও থাকছে৷ ওশেনিয়া, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর অ্যামেরিকা এবং আর্কটিক অঞ্চলের ছবিগুলোর দিকে চোখ রাখলেই বুঝতে পারবেন বাকিটা৷
ছবি: Brian Deutschmann
10 ছবি1 | 10
তাই বলে পরিচালকরা বসে নেই৷ ছবি তৈরি ঠিকই চলছে৷ এবার বার্লিনালের ৬৩তম আয়োজনেও বেশ কিছু ছবি এসেছে ইউরোপের সংকটাপন্ন দেশগুলো থেকে৷ চলচ্চিত্র তো সমাজের ছবি মুখ দেখানোরও আয়না৷ তাই এবার দেখা যাচ্ছে ঋণজর্জর দেশগুলোর ছবিগুলোতে ফুটে উঠেছে মানুষের জীবনযুদ্ধের নানা চিত্র৷ স্পেনের নয়েস বাল্লুস তাঁর লা প্লাগা ছবিতে দেখিয়েছেন বার্সেলোনার অদূরে পাঁচ হতদরিদ্রের জীবনযুদ্ধ৷ গ্রিসের পরিচালক থানোস আনাসতোপুলোসের ‘দ্য ডটার' ছবির কাহিনিটা একটু অন্যরকম৷ সেখানে দেখানো হয়েছে এক তরুণী তাঁর বাবার হঠাৎ অর্থনৈতিক দুরবস্থায় পড়ার জন্য যে লোকটি বেশি দায়ী, তাঁকে শায়েস্তা করছেন৷ এলিনা সিকু ‘ দ্য ইটারনাল রিটার্ন অফ আন্তোনিস পারাসকেভাস' ছবিতে তুলে ধরেছেন এক জনপ্রিয় উপস্থাপকের অর্থনৈতিক দুর্দশার বাস্তবতা৷ এক সময়ের সুপারস্টার অর্থাভাবের সবরকমের কষ্ট কীভাবে মোকাবিলা করছেন তা দেখে অনেকেরই মন নিশ্চয়ই কাঁদবে৷
কিন্তু পরিসংখ্যান একটা আশার বার্তাও পাঠিয়েছে ইউরোপের সমস্যাসঙ্কুল দেশগুলোর চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাছে৷ সংকট যত বড়, আশার ইঙ্গিতও ততটাই৷ যাঁরা টাকার অভাবে ভালো কাজ করতে না পারার কথা বলে বলে মুখে ফেলা তোলেন, সরকারি অনুদান না পেলে যাঁদের আজও কর্মস্পৃহার প্রমাণ মেলেনা, তাঁদের লজ্জায় ফেলবে একটি তথ্য৷ ইউরোপে অর্থনৈতিক সঙ্কটে সবচেয়ে বেশি নাজেহাল দেশ গ্রিস৷ সেখানে সুদিনে বছরে ছবি তৈরি হতো বড়জোর ১৩-১৪টি, গতবছর সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২০! গ্রিসের আরেক চলচ্চিত্র নির্মাতা গ্রিগোরি কারানতিনাকিস অবশ্য এতে অবাক হবার মতো কিছুই দেখছেননা৷ তিনি মনে করেন, সংকট শিল্পচর্চায় কিছু সুবিধাও এনে দেয়৷ সাহসী এবং উৎসাহীদের মনে জাগায় প্রতিকূলতা জয় করার জেদ৷ স্পেন এবং গ্রিসের চলচ্চিত্র জগত তেমন কিছু মানুষের হাত ধরেই এখনো এগিয়ে চলেছে৷