বার্লিনের রাম্বাসাম্বা থিয়েটারে হেরমান মেলভিলের লেখা ‘মবি ডিক' উপন্যাসের মঞ্চায়ন চলছে৷ মৃত্যু, উন্মাদনা ও এক সাদা তিমির কাহিনি৷ কুশিলবদের মধ্যে কয়েকজনের ডাউন সিন্ড্রোম রয়েছে৷
থিয়েটারের প্রধানের নাম ইয়াকব হ্যোনে৷ তাঁর ভাই মরিৎস-এর ডাউন সিন্ড্রোম রয়েছে৷ মরিৎস থিয়েটারের তারকাদের অন্যতম৷ ১৯৯০ সালে এই থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল৷
ডাউন সিন্ড্রোম এক জন্মগত অবস্থা৷ এর ফলে শরীর ও বোধশক্তির ক্ষেত্রে নানা রকম দুর্বলতা দেখা দিতে পারে৷ ইয়াকব হ্যোনে বলেন, ‘‘আসল বিষয় হলো, ডাউন সিন্ড্রোম থাকলে মানুষের নিজস্ব শৈল্পিক অভিব্যক্তি দেখা যায়৷ তারা যেভাবে কোনো চরিত্রকে তুলে ধরে, আমি হয়তো সেভাবে করবো না৷ তাদের সময়জ্ঞান ও আইডিয়া আলাদা৷ আমি হয়ত ভাষার মাধ্যমে কিছু একটা প্রকাশ করবো৷ অন্যদিকে প্রতিবন্ধী অভিনেতা অঙ্গ সঞ্চালনের মাধ্যমে সেই কাজ করবে৷''
সাধারণ তিমি শিকার অভিযান হিসেবে সূচনা হলেও কাহিনিটি প্রতিশোধের মারাত্মক আকাঙ্খায় মোড় নিচ্ছে৷ ২০১৫ সাল থেকে ইয়োনাস সিপেল এই নাট্যদলের সঙ্গে রয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘অভিনয় এমন এক শক্তি, যা ডাউন সিন্ড্রোমসহ মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ থিয়েটারের অনেক সদস্য ঠিকমতো কথাও বলতে পারে না৷ তারা একমাত্র অভিনয়ের মাধ্যমে নিজেদের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে৷''
জার্মানিতে ডাউন সিন্ড্রোম থাকলে বাকি তরুণ-তরুণীদের মতো সুযোগ পাওয়া কঠিন৷ ফ্ল্যাট শেয়ার করে থাকারও তেমন উপায় নেই৷ ইয়োনাস সিপেল-এর ভাগ্য ভালো ছিল৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ভালোবাসি৷ তাদের সঙ্গে কথা বলা, একসঙ্গে কাজ করতে চাই৷ আমি খুব মিশুকে৷ কবিতা লিখতে ভালোবাসি৷ অভিনয় ও শিল্পকলায়ও আগ্রহ রয়েছে৷ সবাই যে সমান নয়, তা স্পষ্ট করে দিতে আমাদের অবশ্যই সংগ্রাম চালাতে হয়৷ তা না হলে বৈচিত্র্য থাকবে না৷ আমাদেরও অধিকার রয়েছে৷''
রাম্বাসাম্বা ২৭ বছর ধরে প্রতিবন্ধীদের সমাজের মূল স্রোতে আনার উদ্যোগ চালাচ্ছে৷ মবি ডিক-সহ বিভিন্ন নাটকে অন্যান্য গ্রুপের অভিনেতারাও অংশ নেন৷ যেমন বরিস ইয়াকোবি৷ তিনি বলেন, ‘‘একবার আমার রিহার্সাল দেখার ইচ্ছা হয়েছিল৷ সকালে তা দেখে দুপুরেই আমি যোগ দিলাম৷ অভিনেতাদের অসাধারণ প্রাণশক্তি আমাকে আকর্ষণ করছিল৷ সাজানো নয়, নিজের ক্ষমতা নিয়ে সংশয়ের বালাই নেই৷ আমাদের মধ্যে অমিলের চেয়ে মিলই বেশি৷''
মবি ডিক নাটকে নাচ ও শারীরিক কসরতের দৃশ্যের জন্য স্পেন থেকে দু'জন নৃত্য পরিচালককে আনা হয়েছে৷ তাঁরাও বলেছেন, যে প্রতিবন্ধী অভিনেতাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার রয়েছে৷ তাঁদেরই একজন সারা লু৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের মতো তাদের কোনো ফিল্টার নেই৷ যেমন আমরা বলি, এটা করতে পারবো না৷ অথচ ওরা কত মুক্ত মনের অধিকারী৷''
সমাজে সব রকম মানুষের সহাবস্থানের পথ আজও দীর্ঘ৷ কিন্তু রাম্বাসাম্বা নিজস্ব লক্ষ্যে অবিচল রয়েছে৷
সমাজ তাদের আলাদা করে দিয়েছে সেই কবেই! অটিজম, সেরিব্রাল পলসি, ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত সন্তানরা নিজেদের মনের খোরাক তবে পাবে কোথায়? তাই কলকাতার ১৩ জন মা নিজেদের সন্তানদের জন্য নিজেরাই ‘উত্তরণ’ নামের সংস্থা তৈরি করেছেন৷
ছবি: DW/P. Samantaসমাজে অন্যদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ হয় না৷ সপ্তাহে ‘উত্তরণ’-এর একটা দিনের অপেক্ষা থাকে সকলের৷ পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং বন্ধুত্বের চাহিদা মেটানোর কাজ উত্তরণ করে চলেছে ১০ বছর ধরে৷ ১৩ জন মায়ের উদ্যোগে এই সংস্থা তৈরি হয়েছিল কোনো সরকারি বা বেসরকারি সাহায্য ছাড়াই৷ শুধু ১৩ জন মায়ের প্রবল ইচ্ছেশক্তি আর কর্মদ্যোগ এখনও সংস্থাটিকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে৷ ছবিতে ‘উত্তরণ’-এর দুই বন্ধু নিশাঞ্জন এবং কৌশিক৷
ছবি: DW/P. Samantaসমাজে অনেকের থেকে পিছিয়ে এরা৷ কিন্তু এদের মধ্যেও প্রতিভার স্ফূরণ লক্ষ্য করা গিয়েছে৷ সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত আইভি চক্রবর্তী রবীন্দ্রসংগীতে বি মিউজ পাশ করেছে৷ শৈশব থেকেই মা শিবানী আইভিকে নিয়ে লড়ে চলেছেন৷ আইভির হাত-পা নাড়ানোয় অসুবিধে৷ তাই তাকে কোলে নিয়েই বহু জায়গায় ছুটেছেন শিবানী৷ এমনকি মেয়ের জন্য গানও শিখেছেন মা৷ আইভি এখন পেশাদার গায়িকা হয়ে মঞ্চেও গাইতে চায়৷
ছবি: DW/P. Samanta‘উত্তরণ’-এ সপ্তাহে একটাদিন শেখানো হয় জীবনের পাঠ৷ এই বিশেষভাবে পারদর্শী ১৩টি শিশুদের জীবনের পাঠ দিতে আসেন প্রশিক্ষকেরা৷ সেখানে ভালো করে কথা বলার প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে ছোটখাটো হাতের কাজও করানো হয়৷ এই সংস্থার যাবতীয় খরচ বহন করেন ১৩ জন মা৷ ‘উত্তরণ’-এর নিজস্ব কোনো ঘর নেই৷ বিভিন্ন জায়গায় চলে এই প্রশিক্ষণ৷ তাই শিক্ষক-শিক্ষিকা সহ মায়েরা সরকারি সাহায্য চান৷
ছবি: DW/P. Samantaশিশুদের সামাজিক মেলামেশায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে স্কুল৷ কিন্তু যাদের তথাকথিত স্কুল নেই, তাদের জন্য ‘উত্তরণ’ স্কুলের ভূমিকা পালন করে৷ শিক্ষক-শিক্ষিকারাই হয়ে ওঠেন শিক্ষার মূর্ত প্রতীক৷ পিতৃহারা নিশাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মা মঞ্জুশ্রী তার একমাত্র অবলম্বন নয়৷ ‘উত্তরণ’-এর শিক্ষক-শিক্ষিকারাও তার মতো অনেকের গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন৷ অটিস্টিক নিশাঞ্জনের সঙ্গে শিক্ষিকা তনুশ্রী দাস৷
ছবি: DW/P. Samantaসমাজে উৎসব একটা বড় ভূমিকা পালন করে৷ তাই ‘উত্তরণ’-এ উৎসবকে গুরুত্ব দেওয়া হয়৷ নববর্ষ, রবীন্দ্রজয়ন্তী, হোলি, স্বাধীনতা দিবস থেকে শুরু করে যাবতীয় উৎসব ‘উত্তরণ’-এ পালন করা হয়৷ বিশেষভাবে পারদর্শীরাও এখানে নিজেদের মতো করে উৎসবের আনন্দ খুঁজে নেয়৷ ছবিতে কৌশিক দাস এবং সনমিত্র শীল ‘উত্তরণ’-এর ক্লাসে মেতে উঠেছে হোলির আনন্দে৷ সঙ্গে রয়েছেন মায়েরা এবং শিক্ষক-শিক্ষিকারা৷
ছবি: DW/P. Samantaসমাজ হয়ত এদের বঞ্চিত করেছে৷ কিন্তু এরা নিজেদের বঞ্চিত করেনি৷ সপ্তাহে একটা দিন এরা হইচই, আনন্দ, মজা করে নিজেদের মধ্যে৷ আইভির মতে, এই একটা দিন অক্সিজেনের মতো৷ গান, উৎসব, খাওয়া দাওয়া, আড্ডা জীবনের সব রঙেই এই একটা দিন রঙিন হয়ে ওঠে৷ ছবিতে আইভির সঙ্গে তার বন্ধু এবং ‘উত্তরণ’-এর সদস্য সৌরভ সাহা৷
ছবি: DW/P. Samanta‘উত্তরণ’-এর সবাই মোটামুটিভাবে হইচই করতে খুব ভালোবাসে৷ কখনও এখানে পুতুল নাচের আয়োজনও করা হয়ে থাকে৷ পুতুল নাচে সবার খুব সক্রিয় ভূমিকা থাকে৷ পুতুল নাচের মতো মজাদার জিনিস খুঁজে দেওয়ার জন্য শিক্ষক-শিক্ষিকারা প্রায়ই ফুচকা পার্টি বা মুড়ি মাখার আয়োজন করেন৷ এতেও সবাই খুব উৎসাহ নিয়ে যোগ দেয়৷
ছবি: DW/Payel Samantaপরিবারের সঙ্গে বাকি দিনগুলো কাটাতে হয়৷ তাই ‘উত্তরণ’-এ একটা দিন বন্ধুবান্ধবদের দেখার জন্য প্রতীক্ষাটা বড়ই দীর্ঘ হয়৷ আবার একটা দিন কেটে গেলে পরিবারে ফিরে যেতে হয়৷ লড়াইয়ের যাবতীয় কষ্ট থেকে ছোটছোট মুহূর্ত ভাগ করে নেয় পরিবার৷ ‘উত্তরণ’-এ পরিবারকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়৷ ছবিতে ক্লাস শেষে পরিবারের সঙ্গে বাড়ি ফিরছে অর্ক৷
ছবি: DW/P. Samanta ভিবকে ফয়ারসেঙার/এসবি