জার্মানিতে বড়দিন উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ক্রিসমাস মার্কেট বা ক্রিসমাসের বাজার৷ তবে এটা যদি নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা থাকে তাহলে আনন্দ অনেকটাই ম্লান হয়ে যায়৷
বিজ্ঞাপন
২০১৬ সালে বার্লিনের একটি ক্রিসমাস মার্কেটে ভয়াবহ ট্রাক হামলা হয়েছিল৷ ১২ জন নিহত হয়েছিলেন ওই হামলায়৷ এ কারণে সেসব এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হচ্ছে৷ এ বছর ক্রিসমাস মার্কেটে ঢোকার প্রতিটি প্রবেশমুখে থাকবে তল্লাশির ব্যবস্থা৷
জার্মানিতে ক্রিসমাস মার্কেট একদিকে যেমন নিজেদের সংস্কৃতি, সম্প্রদায় ও এলাকাভিত্তিক গৌরবের অংশ, তেমনি এই মার্কেট সব বয়সি মানুষকে তাদের শৈশবের আস্বাদ দেয়৷ আর এ কারণেই ২০১৬ সালের ঐ হামলা জার্মানদের মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে৷
এ বছর প্রত্যেকটি শহরের পুলিশ বাহিনী সব ধরনের হামলা প্রতিরোধে সতর্ক অবস্থায় থাকবে৷ সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তা থাকবে রাজধানী বার্লিনে৷ যে ক্রিসমাস মার্কেটে হামলা হয়েছিল, এবার সে এলাকাটির নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বালি ও পাথরের বস্তা এবং বাঁশের খুঁটি দিয়ে সব প্রবেশ পথে বিশেষ কাঠামো বানানো হয়েছে৷ ফলে একসাথে অনেক মানুষ প্রবেশ করতে পারবে না৷ যানবাহনও ঢুকতে পারবে না৷
মার্কেট যতক্ষণ খোলা থাকবে, ততক্ষণ টহল দেবে বিশেষ বাহিনী৷ ইউনিফর্ম পরা পুলিশ ছাড়াও সাদা পোশাকে থাকবে নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা৷ কর্তৃপক্ষ আশা করছেন, এ বছর যেভাবে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, তা ভবিষ্যতে যে কোনো ধরনের হামলা মোকাবেলায় সহায়ক হবে৷ একটি ব্রিটিশ কোম্পানি ব্যারিকেড সরবরাহ করছে৷ ব্যারিকেডগুলো যে কোনো ধরনের সামরিক ইনস্টলেশন প্রতিরোধ করতে পারে এবং ক্রিসমাস মার্কেট শেষ হওয়ার পরও তা ব্যবহার করা যাবে৷
তবে স্থানীয়দের অনেকেই মনে করছেন, এত বেশি নিরাপত্তা ও তল্লাশি এবারের ক্রিসমাস মার্কেটের আনন্দ অনেকটাই কমিয়ে দেবে৷ অন্যদিকে, স্থানীয় গির্জার যাজক মার্টিন গ্রেমের মনে করেন, এ ধরণের নিরাপত্তার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে৷
জার্মানিতে বড়দিনের ১০টি প্রথা
অ্যাডভেন্টের মোমবাতি আর ফুলের স্তবক এলো কোথা থেকে? বড়দিনের বাজারই বা প্রথম কবে শুরু হয়? বড়দিনে জার্মানরা কী খায়? এসব প্রশ্নের উত্তর পাবেন আমাদের ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/PIXSELL/N. Pavletic
অ্যাডভেন্টের স্তবক
অ্যাডভেন্টের গোলাকৃতি স্তবকটায় আজকাল চারটি মোমবাতি লাগানো থাকে; বড়দিনের আগের প্রতি রবিবারে একটি করে জ্বালানো হয়, শেষ রবিবারে সবগুলো মোমবাতি জ্বলে৷ অ্যাডভেন্টের স্তবকের স্রষ্টা হিনরিশ ভিশার্ন ১৮৩৯ সালে তাঁর ছেলেমেয়েদের জন্য যে স্তবকটি তৈরি করেছিলেন, সেটি ছিল কাঠের ও তাতে ২৪টি মোমবাতি লাগানো ছিল৷ ক্রিসমাস ইভ অর্থাৎ ২৪শে ডিসেম্বর অবধি ডিসেম্বরের প্রত্যেকটি দিনের জন্য একটি করে মোমবাতি৷
ছবি: picture-alliance/PIXSELL/N. Pavletic
বড়দিনের বাজার
মধ্যযুগেই ক্রিসমাসের আগে বড়দিনের বাজার বসত ও লোকে ভিড় করে সেখানে যেতো৷ সে আমলে মশলাদার গরম ওয়াইন পান করার প্রথা ছিল না, শীতের মরশুমে মানুষজন খাবার-দাবার কিনতেই বড়দিনের বাজারে যেতেন৷ পরে আর সব দেশের মতো জার্মানিতেও কামার, কুমোর, ময়রা বা পুতুল-নাচিয়েরা মেলায় দোকান দিতে শুরু করে৷ বড়দিনের বাজার আজ দুনিয়ার সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/W. Thieme
হোয়াইট ক্রিসমাস
শীত এককালে ছিল একটি নির্মম, কষ্টদায়ক ঋতু৷ উনবিংশ শতাব্দীতে তার উপর রোম্যান্টিক চেতনার প্রলেপ পড়ে শীত হয়ে ওঠে একদিকে নান্দনিক ও অপরদিকে ধর্ম ও পারিবারিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ৷ স্নোম্যান বা বরফের কাকতাড়ুয়ারা আর কাকতাড়ুয়া না থেকে, ছোটদের বন্ধু হয়ে ওঠে৷ কাঠের স্নোম্যানরা আজ ক্রিসমাস ট্রি-তে পর্যন্ত ঝোলে৷
ছবি: picture-alliance/beyond/J. Fankhauser
ক্রিসমাস ট্রি
বড়দিনে সুন্দর করে সাজানো ক্রিসমাস ট্রি’র নীচে পরিবারের সকলের জন্য উপহারগুলি ছড়ানো থাকবে, এই না হলে জার্মানিতে বড়দিন! এককালে বড়লোকদেরই ক্রিসমাস ট্রি কেনার সামর্থ্য ছিল; উনবিংশ শতাব্দীতে ফার ও স্প্রুস গাছের বড় বড় আবাদ হওয়ার ফলে আপামর জনতার জন্যও ক্রিসমাস সুলভ হয়ে ওঠে৷ ক্রিসমাস ট্রি সাজানোর প্রথা জার্মানি থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে, যেমন ছবিতে ২০১৫ সালে টোকিওর একটি ক্রিসমাস ট্রি৷
ছবি: Reuters/Y. Shino
শিশু যিশু, নাকি সন্ত নিকোলাস?
মধ্যযুগে জার্মানির কচিকাঁচারা তাদের বড়দিনের উপহার পেতো ডিসেম্বরের ৬ তারিখে, সন্ত নিকোলাসের কাছ থেকে৷ কিন্তু খ্রিষ্টান সন্তদের নিয়ে ক্যাথলিকদের এত বাড়াবাড়ি জার্মান প্রটেস্টান্টদের ভালো লাগেনি৷ শোনা যায়, প্রটেস্টান্ট ধর্মমতের প্রতিষ্ঠাতা মার্টিন লুথার নাকি স্বয়ং বড়দিনের উপহার দেবার তারিখ বদলে ২৪শে ডিসেম্বর করেন৷ সেই থেকে ‘ক্রিস্টকিন্ড’ বা শিশু যিশু স্বয়ং ছোটদের জন্য বড়দিনের উপহার এনে থাকেন৷
ছবি: Fotolia/ChaotiC_PhotographY
‘বেশেরুং’
বড়দিনের আগের দিন হলো ক্রিসমাস ইভ; ছোটরা তাদের বড়দিনের উপহার পায় এই দিনে – তবে স্যান্টা ক্লস বা ফাদার ক্রিসমাসের কাছ থেকে নয়, ‘ক্রিস্টকিন্ড’ বা শিশু যিশুর কাছ থেকে৷ এই উপহার প্রদানের প্রাচীন প্রথাটির জার্মান নাম হলো ‘বেশেরুং’৷ এককালে কোনো কোনো পরিবারে ‘বেশেরুং’-এর আগে ছোটদের কোনো কবিতা আবৃত্তি করে কিংবা গান গেয়ে শোনাতে হতো – ভাগ্যক্রমে আজকালকার বাবা-মায়েরা আর অতোটা নির্মম নন৷
ছবি: picture alliance/chromorange/E. Weingartner
মিডনাইট মাস
২৪শে ডিসেম্বরের সন্ধ্যায় প্রথম তারা ফোটার পর ‘বেশেরুং’ ও খাওয়া-দাওয়া, কিন্তু তার পরেও একটি গুরুত্বপূর্ণ আচার বাকি থেকে যায়: সেটি হলো মধ্যরাত্রে গির্জায় ‘মাস’ বা প্রার্থনাসভা৷ মজা হলো এই যে, অষ্টাদশ শতাব্দী অবধি এই মিডনাইট মাস সংঘটিত হত ২৫শে ডিসেম্বর বা বড়দিনের সকালে কাকডাকা ভোরে৷ সেটা কি নিরাপত্তার কথা ভেবে?
ছবি: picture alliance / Bildagentur Huber
নেটিভিটি
আস্তাবলে খ্রিষ্টের জন্ম নিয়ে গল্পকাহিনী যেমন আদিগন্ত কাল থেকে চলে আসছে, তেমন সেই সব গল্পকাহিনী নিয়ে নাটক ও যাত্রা জার্মানি তথা ইউরোপের জনজীবন ও লোকসংস্কৃতির একটা অক্ষত ধারা৷ অতীতে খ্রিষ্টের জন্মকাহিনীর সঙ্গে বাইবেলের অন্যান্য দৃশ্যও যোগ হতো; পরে নেটিভিটি প্লে একটা নিজস্ব ধার হয়ে দাঁড়ায়৷ অপরদিকে রয়েছে যিশুখ্রিষ্টের ক্রুশবিদ্ধ হওয়া নিয়ে ওবারআম্যারগাউ-এর ‘প্যাশন প্লে’-র মতো যাত্রাপালা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/H. Schmidt
ক্রিসমাস ডিনার
মার্কিনিদের কাছে তাদের ক্রিসমাস টার্কি যা, জার্মানদের কাছে তাদের ক্রিসমাস গুজ বা হাঁস হলো তাই – ও ছাড়া বড়দিনের ভোজ হতেই পারে না৷ অবশ্য অনেকে আবার সসেজ আর একটা সাদামাটা আলুর স্যালাড দিয়েই কাজ চালিয়ে নেন৷ হাঁস না আলু, সেটা আজকাল রুচির ব্যাপার৷ অতীতে কিন্তু বড়লোকরা খেতেন বড়দিনের হাঁস, আর গরীব-গুর্বোরা আলুর ভর্তা দিয়েই ভোজ সারতেন৷
ছবি: Fotolia
টুয়েল্ফথ নাইট
ক্রিসমাস থেকে ৬ই জানুয়ারি হলো ১২টি দিন৷ সেই কারণে ৬ই জানুয়ারি তারিখটিকে বলে টুয়েল্ফথ ডে বা দ্বাদশ দিবস৷ এই ১২টা দিন আবার ইউরোপ জুড়ে ভয়ানক শীত – সেই শীতের রাত্রে নাকি দত্যি-দানোরা ধু ধু করা বরফের উপর দিয়ে ঘুরে বেড়ায়! কাজেই ধূপধুনো জ্বালিয়ে সেই সব অপদেবতাকে তাড়াতে হয়...৷