বার্লিনে নগ্নতার দেখা পাবেন সর্বত্র, ভানজে হ্রদ থেকে শুরু করে মেট্রো স্টেশন অবধি৷ চলতি নির্বাচনি প্রচার অভিযানে ‘স্ট্রিকিং' পর্যন্ত ঘটেছে, যা কিনা হঠাৎ কোনো উলঙ্গ ব্যক্তির আবির্ভাব৷
ছবি: Chris Phillips
বিজ্ঞাপন
প্রথমেই খেয়াল রাখা দরকার,বার্লিনে নগ্নতা মানেই কিন্তু যৌনতা নয়– অন্তত বার্তা হিসেবে নয়৷ অপরদিকে নগ্নতা যেখানে, সেখানে কি যৌনতা অল্পস্বল্প উঁকি মারে না? ডয়চে ভেলের কলামনিস্ট গেরো শ্লিষ-এর দার্শনিক প্রশ্ন৷
‘টপলেস'
ঠিক ঐ নামেই বার্লিনের কেন্দ্রে একটি মিউজিক ফেস্টিভ্যাল অনুষ্ঠিত হয়৷ শহরের বহু ওপরে ‘স্কাই লাইভ' ক্লাবে গরমে ঠান্ডা হবার মতো মিউজিক বাজান ‘ব্রিটিশ অ্যান্ড আইরিশ মডার্ন মিউজিক ইনস্টিটিউট'-এর শিল্পীরা৷ তবে শিল্পী কিংবা শ্রোতাদের মধ্যে ‘টপলেস' অবস্থায় কেউ নেই, নামটাই শুধু টপলেস ও সেটা এই কারণে যে, একটি বহুতল ভবনের ন্যাড়া ছাদের ওপর জলসা, শামিয়ানা পর্যন্ত নেই৷
জার্মানির যেখানে নগ্ন ঘুরতে বাধা নেই
জার্মানির কিছু কিছু জায়গায় একেবারে নগ্ন হয়ে ঘোরাফেরা করা যায়৷ হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন৷ এ সব জায়গায় নারী, পুরুষ স্বেচ্ছায় নগ্ন হয়ে থাকেন৷ এতে নাকি স্বাস্থ্যও ভালো থাকে৷ চলুন দেখি ঠিক কোথায় কোথায় প্রকাশ্যে নগ্ন হতে বাধা নেই৷
ছবি: AP
নুড স্পোর্টস ক্লাব
জার্মানিতে ‘নুড স্পোর্টস ক্লাব’ বা নগ্ন ক্রীড়াসংঘের সংখ্যা কম নয়৷ এ সব ক্লাব ফ্রি বডি কালচারে বিশ্বাসী, অর্থাৎ একান্ত দরকার না হলে শরীর কাপড়ে ঢেকে রাখার পক্ষে নয় তারা৷ বিভিন্ন বয়সের প্রায় ৪০ হাজার মানুষ নগ্ন ক্রীড়াসংঘের সদস্য৷ তারা নিয়মিত জার্মানিতের বিভিন্ন শহরে মিলিত হন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সাওনায় সবাই নগ্ন থাকেন
সাওনা বা স্টিম বাথ জার্মানিতে বেশ জনপ্রিয়৷ প্রায় সব শহরেই সাওনার ব্যবস্থা রয়েছে৷ আর সেখানে নারী, পুরুষ একসঙ্গে, নগ্ন অবস্থায় স্টিম বাথ নেন৷ তবে কেউ চাইলে শুধু নারী বা শুধু পুরুষের সাওনাও ব্যবহার করতে পারেন৷ এটা ব্যক্তিস্বাধীনতার ব্যাপার!
ছবি: Fotolia/Kzenon
নিজের বাগান বা বারান্দায়
না, খোলা রাস্তায় হঠাৎ করে নগ্ন হয়ে হাঁটাহাটি জার্মানিতে চালু নেই৷ তবে নিজের বাড়ির বাগানে বা বারান্দায় নগ্ন হয়ে ঘোরাফেরায় বাধা নেই৷ বাড়ি যদি রাস্তার পাশে আর সেই রাস্তা দিয়ে যদি আপনাকে বারান্দায় দেখা যায়, তাহলে জার্মান আইনে সেটা যারা দেখছে তাদের সমস্যা, আপনার নয়৷ বারান্দা আপনার, নগ্ন থাকার স্বাধীনতাও আপনার৷
‘নগ্ন বিচ’
জার্মানিতে কিছু সমুদ্রতট আছে, যেখানে পুরোপুরি নগ্ন হয়ে থাকা যায়৷ অর্থাৎ বিকিনি বা শর্টস পরারও কোনো বাধ্যবাধ্যকতা নেই৷ এ সব বিচে ‘এফকেকে’ লেখা থাকে৷ যে কেউ সেখানে যেতে পারেন৷ তবে অসংখ্য নগ্ন মানুষের মধ্যে পোশাক পরা কাউকে দেখতে খানিকটা বেমানান লাগে৷ তাই সেখানে যেতে চাইলে, নগ্ন হয়ে গেলেই উত্তম৷
ছবি: sabelfoto13 - Fotolia.com
নুড পার্ক
শুধু সমুদ্রতট নয়, নগ্নতায় বিশ্বাসীদের জন্য আছে পার্কও৷ মিউনিখের ইংলিশ গার্ডেন এবং বার্লিনের টিয়ারগার্ডেনের কিছু অংশে নগ্নভাবে ঘোরাফেরা করা যায়৷ তাই গ্রীষ্মে সেখানে নগ্নদের দেখলে বিস্মিত হবেন না৷ তবে সব পার্কে নগ্ন হয়ে ঘোরা যায় না৷ এ সংক্রান্ত সাইন দেখার পর কাপড় খুললে উত্তম৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
প্রাইম-টাইমে নিষিদ্ধ
জার্মান টেলিভিশনে প্রাইম-টাইমে নগ্ন কিছু প্রদর্শন কার্যত নিষিদ্ধ৷ তবে কথা আছে, যদি কোনো সিনেমার কাহিনির প্রয়োজনে একান্তই স্তনবৃত্তসহ নগ্ন স্তন প্রদর্শন প্রয়োজন পড়ে, তবে সেটা সম্ভব৷ সেসব সিনেমার আগে অবশ্য কোন বয়সিরা তা দেখতে পারবে, তা জানানো হয়৷ আর রাত এগারেটা থেকে সকাল ছ’টা অবধি ‘সফট পর্ন’ টিভিতে প্রচারে বাধা নেই, তবে বাড়াবাড়ি কিছু দেখানো যাবে না৷
ছবি: AP
6 ছবি1 | 6
‘নগ্ন প্রচার'
টিম রেনার এককালে বার্লিনের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সচিব ছিলেন৷ আজ তিনি জার্মান সংসদে আসন পাবার জন্য ভোটে নামছেন৷ তিনি তাঁর একটি নির্বাচনি প্রচার ভিডিওতে নিজেকে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় দেখিয়েছেন৷ কাজটা নিঃসন্দেহে সাহসের, কেননা, তাঁর নির্বাচনি এলাকা শার্লটেনবুর্গ-ভিলমার্সডর্ফের মানুষজন অতটা ‘মডার্ন' কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ থাকতে পারে৷ রেনার বলেছেন, তিনি ‘সুইং' ভোটার, অর্থাৎ অনিশ্চিত ভোটারদের দলে টানার চেষ্টা করছেন৷
ন্যুডিজম
সাবেক পূর্ব জার্মানির ক্ষেত্রে নগ্নতা একটা পুরাতন ধারা, যা কমিউনিস্ট আমল থেকে চলে আসছে – যদিও এই এফকেকে অর্থাৎ ‘ফ্রাইক্যোর্পারকুলটুর' বা ‘মুক্ত শরীর সংস্কৃতি', এক কথায় নগ্ন অবস্থায় সৈকতে সময় কাটানো, তা সে জলেই হোক আর সূর্যস্নান করতে করতেই হোক, এই বস্তুটিতে সাবেক পশ্চিম জার্মানি সাবেক পূর্ব জার্মানির ধারেকাছেও আসতে পারতো না৷ সেই কারণেই হয়তো বামদলের প্রবীণ নেতা, ৬৯ বছর বয়সি গ্রেগর গিজি জার্মানিতে নগ্নতার সংস্কৃতি বজায় রাখা নিয়ে আন্দোলন করছেন৷
নগ্নতার ভক্ত
বার্লিনে সে ধরণের মানুষেরও কোনো কমতি নেই৷ সম্প্রতি বার্লিন আন্ডারগ্রাউন্ডের চার নম্বর আর এক নম্বর ট্রামগুলিতে এক পুরোপুরি নগ্ন যাত্রীকে নিঃশব্দে কামরা থেকে কামরায় যেতে দেখা গেছে৷
যাঁরা নগ্ন সন্তরণে আগ্রহী, তাঁরা ‘নাক্টবাডেন.ডিএ' গোত্রীয় ওয়েবসাইটগুলি ঘেঁটে দেখতে পারেন, কেননা সেখানে বলে দেওয়া আছে, রাজধানীর চারপাশের হ্রদগুলিতে সেরা নিউডিস্ট সৈকতগুলি কোথায়৷ লেক ভানজে থেকে লেক হেলেনজে অবধি নগ্ন সন্তরণের সুযোগ আছে – শুধু গাড়ি কিংবা ট্রামে করে সেখানে গেলেই হলো৷
বিছানা: আমাদের কাছে, শিল্পীদের চোখে...
ঘুম কাতুরে বাঙালির কাছে বিছানা বা শয্যা মানেই ঘুম৷ ভাত-ঘুম, শীত-ঘুম বা শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখা৷ কিন্তু বিছানার জগৎটা তো আরো বিশাল, আরো বড়, তাই না? জন্ম, মৃত্যু, ভালোবাসা, একাকিত্ব অথবা যৌথ জীবন – সবই যে এই বিছানাকে ঘিরে৷
ছবি: Detail/The Cecil Beaton Studio Archive at Sotheby`s
তোমার সঙ্গে একা...
আজকাল বিছানাতেই চলছে অফিসের কাজ, খাওয়া-দাওয়া, টিভি দেখা, স্মার্টফোনে গান শোনা, ল্যাপটপ বা ট্যাব নিয়ে ফেসবুক অথবা স্কাইপে আলাপচারিতা৷ তার সঙ্গে বিছানায় তোলা বিখ্যাত ব্যক্তিদের ‘সেল্ফি’ এখন ভক্তসমাজে দারুণ ‘পপুলার’৷ এই যেমন জার্মান আলোকচিত্রী ইয়ুর্গেন টেলারের তোলা বিখ্যাত মডেল কেট মস-এর এই ছবিটি৷ সাদা চাদরে মোড়ানো কেট মস-এর এই ছবি এখন অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় আয়োজিত একটি বিছানা প্রদর্শনীর অংশ৷
ছবি: Juergen Teller und Christine König Galerie
পপ আর উত্তেজনার মাঝে
বিছানা যেন আজ শিল্পীর ক্যানভাসে পরিণত হয়েছে৷ তাই তো প্রদর্শনীতে উঠে এসেছে বিশ্বখ্যাত পপ সংগীত তারকা ম্যাডোনার এই ছবিটি৷ ১৯৯৪ সালে তোলা এ ছবির ফোটোগ্রাফার বেটিনা রাইমস৷ আলুথালু পোশাক, পেছনে গোলাপের সমাহার আর মোহিনী হাসিতে ম্যাডোনাকে এ ছবিতে যেন প্রেম আর যৌবনের প্রতীক বলে মনে হচ্ছে৷ মজার বিষয়, ছবিটা যে সময় তোলা ঠিক সে সময়েই ‘বেডটাইম স্টোরিজ’ নামে নিজের অ্যালবামটি বের করেছিলেন ম্যাডোনা৷
ছবি: Detail/Bettina Rheims, Jérôme de Noirmont – Art & Confrontation
বিছানা থেকেই শুরু
ভিয়েনায় বিছানা নিয়ে প্রদর্শনীটিতে জায়গা করে নিয়েছে মধ্যযুগীয় বেশ কিছু চিত্রকর্ম এবং প্রাচীন দেওয়াল-লিখন বা ‘ফ্রেস্কো’৷ ওপরের চিত্রকর্মটির নাম ‘মাস্টার অফ দ্য ডিভিসিও আপোস্টোলোরুম’৷ শিল্পীর নাম অজানা হলেও, এটুকু জানা যায় যে তিনি সিরিয়ার মানুষ ছিলেন এবং ১৫ শতকে যিশু খ্রিষ্টের মা, ‘মাদার মেরির জন্ম’ নামের বিখ্যাত চিত্রশিল্পটিও তাঁরই আঁকা৷ বিছানা থেকেই যে জীবনের শুরু, এ ছবি তার একটি উদাহরণ তো বটেই!
ছবি: Detail/Belvedere, Wien
মন খারাপ করা...
বিছানা – এই শব্দটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে জন্ম, মৃত্যু, ভালোবাসা, যন্ত্রণা, সুখ, দুঃখ আরো কত কী! তাই ভিয়েনা শহরের হাউস আর্ট মিউজিয়ামের ‘কিউরেটর’ মারিও কডো গনাটো চিত্রকর্ম, স্থাপত্য, আলোকচিত্র, ভিডিও – সব কিছুকেই বিষয় এবং মনের ভাব অনুযায়ী ভাগ করেছেন৷ যেমন প্রদর্শনীর ‘বিষন্ন’ পর্যায়ে রয়েছে পিয়ের বোনার্দ-এর অন্যতম এই তেলচিত্রটি৷
ছবি: Detail/U. Edelmann - Städel Museum - ARTOTHEK/Bildrecht, Wien, 2015
অসুখ আর যন্ত্রণার সাথি
বিছানা নিয়ে আলোচনা শুধু ঘুম এবং সেক্সের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না৷ কারণ এখানেই যে জন্মজন্মান্তর ধরে আমরা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করছি৷ অসুখ-বিসুখ হলেও বিছানার গুরুত্ব বাড়ে৷ সদ্য প্রয়াত অস্ট্রিয়ান চিত্রকর মারিয়া লাসনিগ-এর শিল্পকর্ম এটি, নাম ‘হাসপাতাল’৷ ৮৬ বছর বয়সে তিনি যখন এ ছবি এঁকেছিলেন, তখন জরা তাঁকে প্রায় গ্রাস করেছে৷
বিছানা বলতেই আমাদের কাছে হয়ত নরম, তুলতুলে তোষক-বালিশ বোঝায়৷ কিন্তু জেলখানা বা কারাগারের কথা একবার ভাবুন তো! মার্কিন শিল্পী লুসিন্ডা ডেভলিন ১৯৯০ সালে সেই ভাবনা থেকেই মার্কিন কারাগারগুলির ছবি তুলেছিলেন, বিশেষ করে সেই সব জেলখানার, যেখানে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো৷ ছবিতে সে রকম বিভৎস মনে না হলেও, এখানে কিন্তু বিষাক্ত ইনজেকশনও দেওয়া হয়েছে একটা সময়৷ ভিয়েনার প্রদর্শনীতে গেলে এমন আরো বিছানার ছবি দেখতে পাবেন৷
ছবি: Detail/Lucinda Devlin und Galerie m Bochum
যুদ্ধের ক্ষতও থেকে গেছে বিছানায়
স্যার সেসিল বেটন যে শুধু রাজা-রাজরা আর বিখ্যাত মানুষের ছবি তুলে নাম কুড়িয়েছিলেন, তা কিন্তু নয়৷ অসাধারণ সব যুদ্ধের ছবিও তুলেছিলেন তিনি৷ ১৯৪০ সালে জার্মান আকাশবোমায় আহত এই তিন বছরের বাচ্চাটির ছবি তুলেছিলেন তিনি৷ ‘টেডি বেয়ার’ হাতে বাচ্চাটির এ ছবি তৎকালীন যুদ্ধবিরোধী ছবিগুলির মধ্যে অন্যতম৷ ২৩শে সেপ্টেম্বরের ‘লাইফ’ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদেও স্থান পেয়েছিল ছবিটি৷
ছবি: Detail/The Cecil Beaton Studio Archive at Sotheby`s
7 ছবি1 | 7
নগ্ন নৃত্য
বার্লিন হলো পার্টির শহর৷ এখানে ‘ব্যার্গহাইন' টেকনো মিউজিক নাইট ক্লাবে নাচতে গিয়ে হঠাৎ কোনো পেশিবহুল নগ্ন নর্তককে দেখতে পাওয়াটা আশ্চর্যের কিছু নয়৷
বলতে কি, বার্লিনের নাইট লাইফে নগ্নতা একটি বড় উপাদান৷ ‘পর্নসেপচুয়াল' নামের একটি পার্টিতে ঢোকার জন্য মাঝরাতেও মাইল খানেক লম্বা লাইন পড়ে কেন? কারণ, সেখানে লেদার, ফেটিশ বা কোনো কিছুই না পরে নাচানাচিতে কোনো বাধা নেই৷
বার্লিন মনোরঞ্জনের শহর, তথাকথিত ‘রোরিং টোয়েন্টিস' বা গত শতাব্দীর বিশের দশক থেকেই এখানে নাচ-গান-নগ্নতা চলে আসছে৷ হালে পৌরকর্তারা বার্লিনের জন্য একটি নতুন বিজ্ঞাপনি প্রচার অভিযান চালাচ্ছেন, যার স্লোগান হলো, ‘‘স্বাধীনতার রাজধানী৷'' আর নগ্নতা কি এক ধরণের স্বাধীনতা নয়?