1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাল্যবিবাহের প্রভাব সুদূরপ্রসারী ও নেতিবাচক

ডয়চে ভেলের অতিথি লেখক রুমা মোদক৷
রুমা মোদক
২০ জুন ২০২৫

প্রথমবার ধাক্কা খেয়েছিলাম কোভিড মহামারির পর যখন সব ধীরে ধীরে খুলতে থাকলো, জনজীবন স্বাভাবিকত্বে ফিরে আসতে লাগলো৷ নিশ্চিত করে জানি না, তবে আমার মনে হয় সবচেয়ে বেশি পারস্পরিক সঙ্গের অভাববোধ করছিলো শিক্ষক আর ছাত্র-ছাত্রীরা৷

কন্যা সন্তানের ভবিষ্যৎকে শুধুমাত্র বিয়ে দেয়ার গন্তব্যে সীমাবদ্ধ করার পেছনে বহুবিধ অর্থনৈতিক, সামাজিক মূল্যবোধ গত কারণ রয়েছে ছবি: Allison Joyce/Getty Images

তারা অভাব বোধ করছিল পারস্পরিক সান্নিধ্যের৷ বন্ধুত্বের উষ্ণতার, শ্রেণিকক্ষের সম্মিলনের,আনন্দময় এবং একইসাথে নিয়মানুবর্তী সময়ের৷ শাসন আর দৈনন্দিন রুটিনের৷ বন্ধুদের আড্ডা আর ইউনিফর্ম৷ আর বাদবাকি সবাই আতঙ্ক আর ছুটির মিলমিশে যে অস্থির সময় কাটিয়েছিলেন, শিক্ষক আর ছাত্র-ছাত্রীদের কাটানো সময়টা ছিল সবার থেকে আলাদা৷ আতঙ্কের সাথে সেখানে যুক্ত ছিল গভীরতর বিষাদ৷

দীর্ঘ এক অস্থির আর অশান্ত আতঙ্কগ্রস্ত মহামারিকাল কাটিয়ে ধীরে ধীরে আমরা যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গেলাম,স্বাভাবিক শ্রেণিকক্ষে প্রথম প্রথম ছাত্রীদের উপস্থিতি ছিল আশঙ্কাজনকভাবে কম৷ সাধারণভাবে প্রান্তিক অঞ্চলের কলেজ হলেও শ্রেণিকক্ষের দুইদিকে ছাত্রদের অবস্থান থাকলেও একদিকে ভরে থাকতো ছাত্রীরা৷ সেখানে তখন একটি বেঞ্চে বসে থাকে মাত্র গোটা কয়েক ছাত্রী৷ কয়েকদিন পরও সব পুরোপুরি স্বাভাবিকত্বের দিকে

যেতে থাকলেও ছাত্রীদের অবস্থার বিশেষ কোনো পরিবর্তন না হলে আমি খোঁজ নেয়া শুরু করলাম৷

শিক্ষকতা জীবনের প্রথম দিকে ছাত্র-ছাত্রীদের নামধাম ঠিকানা, এমনকি হাতের লেখা দেখেও বলে দিতে পারতাম কোনটা কার হাতের লেখা৷ কিন্তু ধীরে ধীরে শ্রেণিকে ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা বাড়তে থাকলে, আমার জীবন পেশাগত জীবনের বাইরে সংসার আর আরো অনেক ব্যস্ততায় ঢুকে যেতে থাকলে আমিও তাদের নাম ধাম আর মুখস্ত রাখতে পারি না৷ তার উপর ছাত্রীদের পোশাকে মুখ ঢেকে রাখার সংস্কৃতি যুক্ত হওয়ায় ক্লাসের ছাত্রীরা রাস্তাঘাটে আদাব সালাম দিলেও চিনতে পারি না৷

এই আশঙ্কাজনক ছাত্রীসংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ জানতে আমি তাদেরই ডাকলাম টিচার্স রুমে৷ প্রযুক্তির কল্যাণ ওরা পরস্পর সংযুক্ত৷ নামধাম-সহ ওরা গোটা বিশেক ছাত্রীর তথ্য আমাকে বলে দিলো, যাদের প্রায় সবার বিয়ে হয়ে গিয়েছে৷ অস্বীকার করার উপায় নেই, ছাত্রীদের বিনা বেতন, উপবৃত্তি ইত্যাদি কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েদের হার এক দশকে উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল৷ শ্রেণিকক্ষের প্রায় অর্ধেকই ভরে থাকা ছাত্রীরা প্রায় শূন্যে নেমে গেল এক মহামারির ধাক্কায়

আমার শিক্ষকতা জীবনের প্রথম দিকে ছাত্রীদের যে সংখ্যা ছিল, তা নগন্য তো ছিলই, লক্ষ্য করতাম একাদশ থেকে দ্বাদশ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যেতো৷ কো-এডুকেশন কলেজ হওয়ার কারণে আমার আরো করুণ অভিজ্ঞতাও আছে৷ দেখা যেতো ভাইবোন একইসাথে পড়ছে৷ ভাইটির চেয়ে বোন সহস্রগুন মনোযোগী এবং মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও অভিভাবক মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে পড়াশোনা অব্যাহত না রেখে৷ অথচ ভাইটির পিছনে খরচ করে শহরের বাইরে বড় কোনো প্রতিষ্ঠানে পড়াতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করছে না৷ এই অবস্থাটা অর্থনৈতিক স্বচ্ছল পরিবারের জন্য যেমন সত্য,দরিদ্র পরিবারের অবস্থা তো আরো করুণ৷ আমি অভিজ্ঞতায় দেখেছি, মেয়েদের বিয়ে দেয়ার প্রবণতা এতটাই বেশি যে,গায়ে পড়ে এর বিপরীতে কিছু বলতে গেলে বরং নিজেকেই হেনস্থা হতে হয়৷ দ্রুত পাত্রস্থ করা ছাড়া কন্যা সন্তানকে নিয়ে আর কিছু ভাবার দরকার আছে বলেই মনে করে না৷ এই ভাবনার শিকড় পুরুষানুক্রমে এতই দৃঢ় যে, সহজে সেই বিশ্বাসে চিড় ধরানো প্রায় অসম্ভব মনে হয়৷

মূলত আমাদের প্রান্তিক পরিবারগুলোতে নারী সন্তানকে পড়াশোনা করানো দরকার,স্বাবলম্বী করা দরকার এই বোধটিরই জন্ম হয়নি৷ তারা মেয়েদের একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত বড় করে শুধুমাত্র পাত্রস্থ করার প্রয়োজনেই৷ এবং পাত্রস্থ করার মাধ্যমেই কন্যা সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালন শেষ করা হয়৷ পারিবারিক সহিংসতা বা নিগ্রহের শিকার হয়ে কন্যা সন্তানেরা আবার ফিরে এলে শুরু হয় আসল সংকট৷ যে সংকট খুবই স্বাভাবিক ঘটনা এই সমাজে, কিন্তু একে মোকাবিলা করার কোনো প্রস্তুতি পরিবারগুলোর থাকে না৷

কন্যা সন্তানের ভবিষ্যৎকে শুধুমাত্র বিয়ে দেয়ার গন্তব্যে সীমাবদ্ধ করার পেছনে বহুবিধ অর্থনৈতিক, সামাজিক মূল্যবোধ গত কারণ রয়েছে৷ অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্রতা একটি অন্যতম কারণ৷ এখনো মেয়ে বিয়ে দেয়া পরিবারের সবচেয়ে বৃহৎ অর্থনৈতিক খরচের একটি বিষয়৷ এই বৃহত্তম ব্যয়ের ব্যাপারটি যত দ্রুত সেরে ফেলা যায়, ততই পরিবারগুলো বিরাট একটা দায় ও দায়িত্ব থেকে রক্ষা পায়৷

সামাজিক মূল্যবোধগত কারণে কন্যা সন্তানকে শিক্ষিত করার তেমন কোনো বাস্তব উপযোগিতা দেখে না পরিবারগুলো৷ সামাজিক দৃষ্টিতে কন্যা সন্তান শিক্ষিত হলে, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলে পিতা-মাতার লাভ কী? কন্যার অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, কন্যা সন্তানের আত্মমর্যাদা ইত্যাদি বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়ার মতো দূরদর্শিতা কিংবা যুগোপযোগী চিন্তা অভিভাবক মহলে থাকে না৷

সামাজিক মূল্যবোধ সংক্রান্ত আরেকটি সংকট তৈরি হয় কন্যাসন্তান যদি কোনো মানবিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে কারো সাথে৷ সামাজিক শ্রেণি পরিচয়, অর্থনৈতিক অবস্থান বিবেচ্য না হলেও প্রেমের মতো মানবিক সম্পর্কের ব্যাপারে এই সমাজ এতই নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে যে, অনেক ক্ষেত্রে সন্তান নির্যাতন পর্যন্ত পৌঁছে৷ কোনো পরিবারই সাধারণত মেয়ের এই ‘ধৃষ্টতা' সহ্য করার আগেই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চায়৷

সামাজিক নিরাপত্তার অভাবও অল্পবয়স্ক মেয়েদের বিয়ে দেয়ার অন্যতম একটি কারণ৷ উচ্চবিত্ত, কিংবা মধ্যবিত্ত, কিংবা নিম্নবিত্ত কোনো নারী তার অবস্থান থেকে নিরাপদ নয়৷ ইভ টিজিং থেকে শুরু করে ধর্ষণ, হত্যার ঝুঁকিমুক্ত থাকতে পারে না কেউ৷ সে ট্রান্সকম গ্রুপের মালিক লতিফুর রহমানের মেয়ে শাজনীন হোক, কিংবা গরিবের মেয়ে তনু৷ উচ্চবিত্তরা ব্যাপারটি সামর্থ্য আর অর্থ দিয়ে মোকাবেলা করতে পারলেও মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত শ্রেণি কন্যা সন্তানকে বিয়ে দিয়েই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে৷

আমি বৃহত্তর সিলেট এলাকার মানুষ৷ এই এলাকায় ধনী,দরিদ্র পরিবার নির্বিশেষে প্রবাসী পাত্রের সাথে কন্যা সন্তান বিয়ে দেয়ার বিষয়টি স্বপ্নের মতো লালন করে৷ প্রবাসী পাত্ররা অধিকাংশই কি ইউরোপ-আমেরিকা, কি মধ্যপ্রাচ্য বলতে গেলে শ্রমসাপেক্ষ জীবন যাপন করে৷ বিয়ের ক্ষেত্রে তাদের শিক্ষিত মেয়ে পছন্দ বা প্রয়োজন কোনোটাই নয়৷ ফলে শহুরে মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত তো বটেই, প্রবাসী পাত্র পেলে শুধু সিলেট কেন অনেক এলাকাতেই মেয়েকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই পাত্রস্থ করে নিজেদের বিরাট দায়িত্বমুক্ত আর নির্ভার মনে করে৷ তবে বৃহত্তর সিলেটে বাল্যবিবাহের এটি একটি বিরাট কারণ৷

আমাদের সামাজিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধে অধিকাংশ পরিবার কিন্তু বাল্যবিবাহকে অপরাধই মনে করে না৷ তাদের ধারণা, ‘‘আমার মেয়ে আমি বিয়ে দেবো, এতে অন্যের বলার কী আছে!'' শুধু কন্যা সন্তান কেন, আমি তো প্রান্তিক সমাজে ছেলেদের বাল্যবিবাহও প্রচুর দেখি৷ রাষ্ট্রের আইন সেখানে ভূমিকা রাখতে পারে খুবই কম৷ তাদের বেশিরভাগই আইনের খবরই রাখে না৷

এই বাল্যবিবাহের ফলে অধিক সন্তান, মাতৃমৃত্যুর হার বৃদ্ধি পায় তো বটেই, বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় পারিবারিক সংকট৷ যে কোনো কারণেই হোক, সমাজে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদের হার এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে, বাল্যবিবাহের ফলে শিক্ষা, প্রশিক্ষণহীন নারীরা সমাজের বোঝা হয়ে ওঠে৷ তাদের জন্য অপেক্ষা করে করুণ অন্যের গলগ্রহ জীবন, অন্যের বাড়ি গৃহকর্মী কিংবা অল্প টাকায় যে কোনো শ্রম বিক্রির অসম্মানজনক জীবন৷এর প্রভাব পড়ছে প্রজন্মান্তরে৷ শিক্ষা এবং যথোপযুক্ত লালন-পালনের অভাবে তাদের সন্তানরাও হয়ে উঠছে সমাজের বোঝা, যার সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সমাজে৷

আইনের কঠোর প্রয়োগ ছাড়া আরেকটি বিষয় এই বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে,সেটি হলো জনসচেতনতা৷ আর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এই জনসচেতনতা সৃষ্টি করা কঠিন৷

বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে দোলার যুদ্ধ

04:26

This browser does not support the video element.

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ