বাল্যবিবাহ রোধ কত দূর?
২০ জুন ২০২৫
জাতিসংঘের জনসংখ্যাবিষয়ক সংস্থা-ইউএনএফপি-র বার্ষিক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে৷ ইউএনএফপিএ-র বৈশ্বিক জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২৫ বিষয়ক প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সি এক হাজার মেয়ের মধ্যে ৭১ জন এক বা একাধিক সন্তানের মা৷
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ১০ শতাংশ দম্পতি প্রয়োজনের সময় জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী হাতের কাছে পায় না৷ ৩০ শতাংশ নারী সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তা পায় না৷ আর বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার এক লাখে ১১৫৷ ২৩ শতাংশ নারীর এক বছরের মধ্যে তার স্বামীর হাতে মারধর বা নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা আছে৷
আর বাংলাদেশে মোট প্রজনন হার এখন ২.১৷ অর্থাৎ, একজন বিবাহিত প্রজননক্ষম নারী সারা জীবনে দুটি সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন৷ কিন্তু ৫০ বছর আগে পরিস্থিতি এমন ছিল না৷ তখন একজন নারী গড়ে পাঁচটি সন্তানের জন্ম দিতেন৷ ওই সময় বাংলাদেশকে বলা হতো ‘জনসংখ্যা বিস্ফোরণের' দেশ৷
ঢাকার জাতীয় শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. লুনা লাবিবা ডয়চে ভেলেকে বলেন, "অপ্রাপ্ত বয়স্ক নারীদের বিবাহ এবং গর্ভধারণ জটিল সমস্যা তৈরি করে৷ ১৮ বছরের আগে একটি মেয়ে গর্ভধারণের জন্য শারীরিকভাবে উপযুক্ত থাকেন না৷ আর তার ওপর মানসিক চাপ পড়ে৷ ফলে এখানে মাতৃমৃত্যুর হার এখনো বেশি৷”
‘‘আর একই কারণে আমরা অপুষ্ট শিশু পাই৷ অনেক শিশুর মানসিক গঠনও ঠিক মতো হয় না,” বলেন তিনি৷
বাড়ছে বাল্যবিবাহ
২০২১ সালে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা যায় , দেশে করোনার কারণে বাল্যবিয়ে শতকরা ১৩ ভাগ বেড়েছে৷ যা ছিল ২৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ৷ ওই সময়ে দেশে প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার শতকরা ১৭ ভাগ৷ আর মাধ্যমিক পর্যায়ে শতকার ৩৭ ভাগ৷
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-র সর্বশেষ প্রতিবেদনে বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স ২০২৩-এর ফলাফলে দেখা যায় দেশে নারীদের ক্ষেত্রে ১৫ বছর বয়সের আগে বিবাহের হার বাড়ছে৷
বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে বয়স ১৫ হবার আগেই বিবাহিত নারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮.২ শতাংশে, যা ২০২২ সালে ছিল ৬.৫ শতাংশ৷ এক বছরের ব্যবধানে বাল্যবিবাহ বেড়েছে ১.৭ শতাংশ৷
সরকারি হিসাবে রক্ষণশীলতার অভিযোগ আছে৷ তারপরও ওই প্রতিবেদনে বাল্যবিবাহ বাড়ার তথ্য উঠে এসেছে৷ তাদের হিসাবে ২০২০ সালে ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ের হার ছিল ৩১.৩ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৪১.৬ শতাংশ৷
২০২৩ সালের পর বিবিএসের জরিপ আর হয়নি৷ ওই জরিপে স্পষ্ট যে,বাল্যবিবাহ দেশে বাড়ছে৷
গত ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলা হয় , বাংলাদেশে ৫১ .৪ শতাংশ নারীর বিয়ে হচ্ছে ১৮ বছর হওয়ার আগে৷ইউনিসেফ, ইউএন উইমেন ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত 'গার্ল গোলস: হোয়াট হ্যাজ চেঞ্জড ফর গার্লস? অ্যাডলোসেন্ট গার্লস রাইটস ওভার ৩০ ইয়ার্স' শীর্ষক প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়৷ তাতে আরো বলা হয়, বিশ্বের যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে বা শিশুবিয়ে রয়েছে, সেসব দেশের তালিকায় অষ্টম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ৷ আর শিশুবিয়ের দিক থেকে এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান সবার উপরে৷
২০২৪ সালের জুন মাসে ঢাকায় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ নিয়ে এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে ইউএনএফপিএ-র তখনকার প্রতিনিধি ক্রিস্টিন বলেন, ‘‘বাংলাদেশে প্রতিবছর দুই শতাংশ হারে বাল্যবিবাহ কমছে৷ এই গতিতে বাংলাদেশ থেকে বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে ২১৫ বছর লেগে যাবে৷’’ তার মতে, বাংলাদেশকে বাল্যবিবাহ নির্মূলের চেষ্টা এখনকার চেয়ে ২২ গুণ বাড়াতে হবে৷
বাল্যবিবাহের গল্প
বাংলাদেশের যেসব জেলায় বাল্যবিবাহের উচ্চ হার রয়েছে, তার একটি বগুড়া৷ বগুড়ার খাটিয়ামারী গ্রামকে বলা হয় ‘ডিভোর্সের গ্রাম'৷ ওই গ্রামে বাল্যবিবাহের হারও বেশি৷ আবার তালাকের পরিমাণও বেশি৷ সেই এলাকায় সরেজমিন কাজ করেন বগুড়ায় বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান রেসকিউ আওয়ার পিপল এভার (রোপ)-এর প্রধান তাহমিনা পারভিন শ্যামলী৷ তিনি বলেন, ‘‘ওই গ্রামে ১০-১২ বছর বয়সের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়৷ ছেলেরাও থাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়স্ক৷ মেয়ের পরিবার মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে তার একটা ‘ব্যবস্থা' করতে চায়৷ আর ছেলেটিকেও তার পরিবার যৌতুক এবং অর্থ পাওয়ার আশায় বিয়ে করায়৷ কিন্তু পরে এক পর্যায়ে গিয়ে তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়৷ আবার বিয়ে হয়৷ এইভাবে চলতে থাকে৷”
তিনি বলেন, "বাল্যবিবাহের একটি বড় কারণ দারিদ্র্য৷ আরেকটি কারণ, শিক্ষার অভাব৷ আর সামাজিক ব্যবস্থা তো আছেই৷”
তাহমিনা গত ১০ বছরে অন্তত ১০০ বাল্যবিবাহ ঠেকিয়েছেন৷ কিন্তু তা করতে গিয়ে তাকে অনেক খারাপ পরিস্থিতি মলাতে হয়েছে৷ তিনি বলেন, " অভিভাবকরা বলেন, আপনারা বিয়ে বন্ধ করবেন, কিন্তু আমার মেয়েকে পরে দেখবে কে?”
"বাংলাদেশের উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত বাল্যবিবাহ রোধে কাজ হচ্ছে৷ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা ও পুলিশ বাল্যবিবাহ ঠোকাতে কাজ করেন৷ সহায়তা করেন৷ কিন্তু অনেক বিবাহের খবর তো তারা জানেনই না৷ আর অধিদপ্তরের যে হটলাইন আছে, তার তেমন প্রচার নেই,” বলেন তিনি৷
ব্র্যাক বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে এখন দেশের ৩১ জেলায় ৬০ হাজার পরিবারের সঙ্গে কাজ করছে৷ ওই প্রকল্পের সহযোগী পরিচালক শাশ্বতী বিপ্লব বলেন, "বাল্যবিবাহ নিয়ে একটা প্রচলিত ধারণা আছে যে, দারিদ্র্যের কারণে এটা হচ্ছে৷ অথবা নিরাপত্তার কারণে৷ সেটা তো আছেই৷ কিন্তু আমরা ২০২২ সালে গবেষণায় দেখেছি, তাদের বিবেচনায় ( বাল্যবিবাহ যারা দেয়) তারা ভালো পাত্র হাতছাড়া করতে চান না৷ বর পক্ষের দিক থেকে অল্পবয়স্ক মেয়েকে বিয়ে করার একটা প্রবণতা আছে৷ আর সেই পাত্র যদি কনে পক্ষের বিবেচনায় ভালো পাত্র হয়, তাহলে তারা অল্প বয়সেই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেয়৷ তারা ভালো পাত্র হাতছাড়া করতে চায় না৷”
তার কথা, ‘‘এই প্রবণতা আমরা উচ্চবিত্ত বা শিক্ষিত পরিবারের মধ্যেও সমানভাবে দেখেছি৷ কারণ, তারা মনে করেন, মেয়েদের প্রতিষ্ঠা পাওয়া মানে হচ্ছে, ভালো বিয়ে হওয়া, যোগ্য পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হওয়া৷ তাই তাদের বিবেচনায় যোগ্য পাত্র পেলে আর মেয়ের বয়স বিবেচনা করে না৷ যেমন, অ্যামেরিকা প্রবাসী, ক্যানাডা প্রবাসী পাত্র৷’’
তিনি বলেন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করেও অনেক সময় কাজ হয় না৷ তখন হয়তো বিয়েটা বন্ধ করা যায়, কিন্তু কয়েকদিন পরেই আবার বিয়ে হয়৷ অন্য গ্রামে নিয়েও বিয়ে দেয়া হয়৷ আর এই ধরনের বিয়ে অনেকটাই আনরেজিষ্টার্ড থাকে৷ বিয়ের কাজীরা নিজেরা বিয়ে না পড়িয়ে তাদের প্রতিনিধি দিয়ে বিয়ের কাজ করেন৷ ফলে ধরাও কঠিন৷ আইন থাকলেও তার প্রয়োগ নেই৷
সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় ‘প্রেরণা নারী উন্নয়ন সংগঠন' ২০২২ সালে এক পর্যবেক্ষণে দেখিয়েছে, ওই উপজেলায় এক বছরে বন্ধ করা বাল্যবিবাহের ৭৪ শাতাংশই কিছুদিন পরে আবার বিয়ে হয়েছে৷ ওই এক বছরে তালা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর ৮৮টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছিল৷ এর মধ্যে ৬৫টি বিয়েই পরে হয়ে গেছে৷ সাতক্ষীরায়ও বাল্য বিবাহের হার বেশি৷
আইন ও বাস্তবতা
বাংলাদেশের আইনে নারীদের বিবাহের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ আর ছেলেদের ২১৷ ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন’-এ এই বয়সের আগে বিয়ে দণ্ডনীয় অপরাধ৷ সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, ‘‘এই আইনে সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে৷ আইনে বাল্যবিয়ের সঙ্গে যুক্ত যারা থাকবেন, তারা এবং যদি বর প্রাপ্তবয়স্ক হন, তাহলে বরও দণ্ডের আওতায় পড়বেন৷ কিন্তু বিয়ে হয়ে গেলে বিয়ে ঠিকই বৈধ থাকবে৷ মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর সে চাইলে আদালতের মাধ্যমে বিয়ে অবৈধ ঘোষণা করাতে পারবে৷”
কিন্তু বিয়ে যদি যখন অবৈধ হয়, তখন যদি সন্তান থাকে তাহলে তার অভিভাবকত্ব, উত্তরাধিকার নিয়ে জটিলতা হয়৷ তাই ওই পথে কেউ আইনি প্রতিকার পেতে চেষ্টা করে না বলে ইসরাত হাসান জানান৷
বাংলাদেশের ‘নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইন’-এ স্ত্রীর বয়স যদি ১৬ বছর বা তার নীচে হয়, তাহলে তার সম্মতি বা অসম্মতিতে যেভাবেই হোক না কেন, স্বামীর যৌন সম্পর্ক ধর্ষণ হিসাবে গণ্য হবে৷ কিন্তু বিয়ে টিকে থাকলে সেটা প্রতিরোধ করা যাবে কীভাবে?
ইশরাত হাসান বলেন, ‘‘আমাদের আইনেই নানা ফাঁক-ফোকর আছে, যার সুযোগে বাল্যবিবাহ হচ্ছে৷ তবে আইনের সংশোধন ছাড়াও ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন৷”
তবে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নাঈমা হোসেন বলেন, ‘‘সারাদেশে আমাদের কর্মকর্তারা বাল্যবিবাহ নিরোধে কাজ করছেন৷ তারা এই ধরনের বিবাহ বন্ধে পদক্ষেপ নিচ্ছেন৷ ৫১ শাতাংশ বাল্যবিয়ের যে তথ্য বলা হচ্ছে, আমার কাছে মনে হচ্ছে এটা নিয়ে আরো তারা খোঁজ-খবর নিলে ভালো করবেন৷ বাল্যবিয়ের হার কমে আসছে৷”
তার কথা, " বাল্য বিয়ে প্রতিরোধে আইন আছে৷ হটলাইন নাম্বার আছে৷ একদম গ্রাম পর্যন্ত আমাদের কাজ আছে৷ ইউএনও, ম্যাজিষ্ট্রেট, পুলিশ সবাই কাজ করছেন৷ তারপরও আমাদের সচেতনতা আরো বাড়াতে হবে৷”