1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাল্যবিবাহ রোধ কত দূর?

২০ জুন ২০২৫

বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ রোধে আইন আছে৷ আছে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে নানা উদ্যোগ৷ তারপরও ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই৷ খুব কম বয়সে মা-ও হচ্ছেন অনেকে, যা তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে৷

বিয়ের সাজে মোংলার ১৪ বছর বয়সি মেয়ে হাফসা
২০২৩ সালে ১৫ বছর বয়সের আগে বিয়ে হওয়া মেয়েদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮.২ শতাংশে, যা ২০২২ সালে ছিল ৬.৫ শতাংশছবি: Sultan Mahmud Mukut/Zuma Wire/imago images

জাতিসংঘের জনসংখ্যাবিষয়ক সংস্থা-ইউএনএফপি-র বার্ষিক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে৷ ইউএনএফপিএ-র বৈশ্বিক জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২৫ বিষয়ক প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সি এক হাজার মেয়ের মধ্যে ৭১ জন এক বা একাধিক সন্তানের মা৷

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ১০ শতাংশ দম্পতি প্রয়োজনের সময় জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী হাতের কাছে পায় না৷ ৩০ শতাংশ নারী সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তা পায় না৷ আর বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার এক লাখে ১১৫৷ ২৩ শতাংশ নারীর এক বছরের মধ্যে তার স্বামীর হাতে মারধর বা নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা আছে৷

আর বাংলাদেশে মোট প্রজনন হার এখন ২.১৷ অর্থাৎ, একজন বিবাহিত প্রজননক্ষম নারী সারা জীবনে দুটি সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন৷ কিন্তু ৫০ বছর আগে পরিস্থিতি এমন ছিল না৷ তখন একজন নারী গড়ে পাঁচটি সন্তানের জন্ম দিতেন৷ ওই সময় বাংলাদেশকে বলা হতো ‘জনসংখ্যা বিস্ফোরণের' দেশ৷

ঢাকার জাতীয় শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. লুনা লাবিবা ডয়চে ভেলেকে বলেন, "অপ্রাপ্ত বয়স্ক নারীদের বিবাহ এবং গর্ভধারণ জটিল সমস্যা তৈরি করে৷ ১৮ বছরের আগে একটি মেয়ে গর্ভধারণের জন্য শারীরিকভাবে উপযুক্ত থাকেন না৷ আর তার ওপর মানসিক চাপ পড়ে৷ ফলে এখানে মাতৃমৃত্যুর হার এখনো বেশি৷”

‘‘আর একই কারণে আমরা অপুষ্ট শিশু পাই৷ অনেক শিশুর মানসিক গঠনও ঠিক মতো হয় না,” বলেন তিনি৷

বাড়ছে বাল্যবিবাহ

২০২১ সালে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা যায় , দেশে করোনার কারণে বাল্যবিয়ে শতকরা ১৩ ভাগ বেড়েছে৷ যা ছিল ২৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ৷ ওই সময়ে দেশে প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার শতকরা ১৭ ভাগ৷ আর মাধ্যমিক পর্যায়ে শতকার ৩৭ ভাগ৷

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-র সর্বশেষ প্রতিবেদনে বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স ২০২৩-এর ফলাফলে দেখা যায় দেশে নারীদের ক্ষেত্রে ১৫ বছর বয়সের আগে বিবাহের হার বাড়ছে৷

বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে বয়স ১৫ হবার আগেই বিবাহিত নারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮.২ শতাংশে, যা ২০২২ সালে ছিল ৬.৫ শতাংশ৷ এক বছরের ব্যবধানে বাল্যবিবাহ বেড়েছে ১.৭ শতাংশ৷

সরকারি হিসাবে রক্ষণশীলতার অভিযোগ আছে৷ তারপরও ওই প্রতিবেদনে বাল্যবিবাহ বাড়ার তথ্য উঠে এসেছে৷ তাদের হিসাবে ২০২০ সালে ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ের হার ছিল ৩১.৩ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৪১.৬ শতাংশ৷

২০২৩ সালের পর বিবিএসের জরিপ আর হয়নি৷ ওই জরিপে স্পষ্ট যে,বাল্যবিবাহ দেশে বাড়ছে

গত ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলা হয় , বাংলাদেশে ৫১ .৪ শতাংশ নারীর বিয়ে হচ্ছে ১৮ বছর হওয়ার আগে৷ইউনিসেফ, ইউএন উইমেন ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত 'গার্ল গোলস: হোয়াট হ্যাজ চেঞ্জড ফর গার্লস? অ্যাডলোসেন্ট গার্লস রাইটস ওভার ৩০ ইয়ার্স' শীর্ষক প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়৷ তাতে আরো বলা হয়, বিশ্বের যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে বা শিশুবিয়ে রয়েছে, সেসব দেশের তালিকায় অষ্টম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ৷ আর শিশুবিয়ের দিক থেকে এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান সবার উপরে৷

২০২৪ সালের জুন মাসে ঢাকায় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ নিয়ে এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে ইউএনএফপিএ-র তখনকার প্রতিনিধি ক্রিস্টিন বলেন, ‘‘বাংলাদেশে প্রতিবছর দুই শতাংশ হারে বাল্যবিবাহ কমছে৷ এই গতিতে বাংলাদেশ থেকে বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে ২১৫ বছর লেগে যাবে৷’’ তার মতে, বাংলাদেশকে বাল্যবিবাহ নির্মূলের চেষ্টা এখনকার চেয়ে ২২ গুণ বাড়াতে হবে৷

বাল্যবিবাহের গল্প

বাংলাদেশের যেসব জেলায় বাল্যবিবাহের উচ্চ হার রয়েছে, তার একটি বগুড়া৷ বগুড়ার খাটিয়ামারী গ্রামকে বলা হয় ‘ডিভোর্সের গ্রাম'৷ ওই গ্রামে বাল্যবিবাহের হারও বেশি৷ আবার তালাকের পরিমাণও বেশি৷ সেই এলাকায় সরেজমিন কাজ করেন বগুড়ায় বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান রেসকিউ আওয়ার পিপল এভার (রোপ)-এর প্রধান তাহমিনা পারভিন শ্যামলী৷ তিনি বলেন, ‘‘ওই গ্রামে ১০-১২ বছর বয়সের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়৷ ছেলেরাও থাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়স্ক৷ মেয়ের পরিবার মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে তার একটা ‘ব্যবস্থা' করতে চায়৷ আর ছেলেটিকেও তার পরিবার যৌতুক এবং অর্থ পাওয়ার আশায় বিয়ে করায়৷ কিন্তু পরে এক পর্যায়ে গিয়ে তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়৷ আবার বিয়ে হয়৷ এইভাবে চলতে থাকে৷”

তিনি বলেন, "বাল্যবিবাহের একটি বড় কারণ দারিদ্র্য৷ আরেকটি কারণ, শিক্ষার অভাব৷ আর সামাজিক ব্যবস্থা তো আছেই৷”

তাহমিনা গত ১০ বছরে অন্তত ১০০ বাল্যবিবাহ ঠেকিয়েছেন৷ কিন্তু তা করতে গিয়ে তাকে অনেক খারাপ পরিস্থিতি মলাতে হয়েছে৷ তিনি বলেন, " অভিভাবকরা বলেন, আপনারা বিয়ে বন্ধ করবেন, কিন্তু আমার মেয়েকে পরে  দেখবে কে?”

"বাংলাদেশের উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত বাল্যবিবাহ রোধে কাজ হচ্ছে৷ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা ও পুলিশ বাল্যবিবাহ ঠোকাতে কাজ করেন৷ সহায়তা করেন৷ কিন্তু অনেক বিবাহের খবর  তো তারা জানেনই না৷ আর অধিদপ্তরের যে হটলাইন আছে, তার তেমন প্রচার নেই,” বলেন তিনি৷

ব্র্যাক বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে এখন দেশের ৩১ জেলায়  ৬০ হাজার পরিবারের সঙ্গে কাজ করছে৷ ওই প্রকল্পের সহযোগী পরিচালক শাশ্বতী বিপ্লব  বলেন, "বাল্যবিবাহ নিয়ে একটা প্রচলিত ধারণা আছে যে, দারিদ্র্যের কারণে এটা হচ্ছে৷ অথবা নিরাপত্তার কারণে৷ সেটা তো আছেই৷ কিন্তু আমরা ২০২২ সালে গবেষণায় দেখেছি, তাদের বিবেচনায় ( বাল্যবিবাহ যারা দেয়) তারা ভালো পাত্র হাতছাড়া করতে চান না৷ বর পক্ষের দিক থেকে অল্পবয়স্ক মেয়েকে বিয়ে করার একটা প্রবণতা আছে৷ আর সেই পাত্র যদি  কনে পক্ষের বিবেচনায় ভালো পাত্র হয়, তাহলে তারা অল্প বয়সেই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেয়৷ তারা ভালো পাত্র হাতছাড়া করতে চায় না৷”

তার কথা, ‘‘এই প্রবণতা আমরা উচ্চবিত্ত বা শিক্ষিত পরিবারের মধ্যেও সমানভাবে দেখেছি৷ কারণ, তারা মনে করেন, মেয়েদের প্রতিষ্ঠা পাওয়া মানে হচ্ছে, ভালো বিয়ে হওয়া, যোগ্য পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হওয়া৷ তাই তাদের বিবেচনায় যোগ্য পাত্র পেলে আর মেয়ের বয়স বিবেচনা করে না৷ যেমন, অ্যামেরিকা প্রবাসী, ক্যানাডা প্রবাসী পাত্র৷’’

তিনি বলেন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করেও অনেক সময় কাজ হয় না৷ তখন হয়তো বিয়েটা বন্ধ করা যায়, কিন্তু কয়েকদিন পরেই আবার বিয়ে হয়৷ অন্য গ্রামে নিয়েও বিয়ে দেয়া হয়৷ আর এই ধরনের বিয়ে অনেকটাই আনরেজিষ্টার্ড থাকে৷ বিয়ের কাজীরা নিজেরা বিয়ে না পড়িয়ে তাদের প্রতিনিধি দিয়ে বিয়ের কাজ করেন৷ ফলে ধরাও কঠিন৷ আইন থাকলেও তার প্রয়োগ নেই৷

সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় ‘প্রেরণা নারী উন্নয়ন সংগঠন' ২০২২ সালে এক পর্যবেক্ষণে দেখিয়েছে, ওই উপজেলায় এক বছরে বন্ধ করা বাল্যবিবাহের ৭৪ শাতাংশই কিছুদিন পরে আবার বিয়ে হয়েছে৷ ওই এক বছরে তালা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর ৮৮টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছিল৷ এর মধ্যে ৬৫টি বিয়েই পরে হয়ে গেছে৷ সাতক্ষীরায়ও বাল্য বিবাহের হার বেশি৷

আইন ও বাস্তবতা

বাংলাদেশের আইনে নারীদের বিবাহের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ আর ছেলেদের ২১৷ ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন’-এ এই বয়সের আগে বিয়ে দণ্ডনীয় অপরাধ৷ সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, ‘‘এই আইনে সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে৷ আইনে বাল্যবিয়ের সঙ্গে যুক্ত যারা থাকবেন, তারা এবং যদি বর প্রাপ্তবয়স্ক হন, তাহলে বরও দণ্ডের আওতায় পড়বেন৷ কিন্তু বিয়ে হয়ে গেলে বিয়ে ঠিকই বৈধ থাকবে৷ মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর সে চাইলে আদালতের মাধ্যমে বিয়ে অবৈধ ঘোষণা করাতে পারবে৷”

কিন্তু বিয়ে যদি যখন অবৈধ হয়, তখন যদি সন্তান থাকে তাহলে তার অভিভাবকত্ব, উত্তরাধিকার নিয়ে জটিলতা হয়৷ তাই ওই পথে কেউ আইনি প্রতিকার পেতে চেষ্টা করে না বলে ইসরাত হাসান জানান৷

বাংলাদেশের ‘নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইন’-এ স্ত্রীর বয়স যদি ১৬ বছর বা তার নীচে হয়, তাহলে তার সম্মতি বা অসম্মতিতে যেভাবেই হোক না কেন, স্বামীর যৌন সম্পর্ক ধর্ষণ হিসাবে গণ্য হবে৷ কিন্তু বিয়ে টিকে থাকলে সেটা প্রতিরোধ করা যাবে কীভাবে?

ইশরাত হাসান বলেন, ‘‘আমাদের আইনেই নানা ফাঁক-ফোকর আছে, যার সুযোগে বাল্যবিবাহ হচ্ছে৷ তবে আইনের সংশোধন ছাড়াও ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন৷”

তবে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নাঈমা হোসেন বলেন, ‘‘সারাদেশে আমাদের কর্মকর্তারা বাল্যবিবাহ নিরোধে কাজ করছেন৷ তারা এই ধরনের বিবাহ বন্ধে পদক্ষেপ নিচ্ছেন৷ ৫১ শাতাংশ বাল্যবিয়ের যে তথ্য বলা হচ্ছে, আমার কাছে মনে হচ্ছে এটা নিয়ে আরো তারা খোঁজ-খবর নিলে ভালো করবেন৷ বাল্যবিয়ের হার কমে আসছে৷”

তার কথা, " বাল্য বিয়ে প্রতিরোধে আইন আছে৷ হটলাইন নাম্বার আছে৷ একদম গ্রাম পর্যন্ত আমাদের কাজ আছে৷ ইউএনও, ম্যাজিষ্ট্রেট, পুলিশ সবাই কাজ করছেন৷ তারপরও আমাদের সচেতনতা আরো বাড়াতে হবে৷”

বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে দোলার যুদ্ধ

04:26

This browser does not support the video element.

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ