ঢাকায় পরীক্ষামূলকভাবে বাস রুট রেশনালাইজেশন শুরু হয়েছে৷ এর লক্ষ্য হলো ঢাকার গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে যাত্রী হয়রানি কমানো৷ একইসঙ্গে বাসের মান ও সেবা উন্নত করা৷
বিজ্ঞাপন
প্রাথমিকভাবে রোববার ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোারেশন দুইটি কোম্পানির ৫০টি বাস নিয়ে রাজধানীর ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর রুটে এই সার্ভিস শুরু করেছে৷ আগামী দুই বছরের মধ্যে ঢাকা ও আশপাশের এলকার সব রুট রেশনালাইলেজশন করার পরিকল্পনা আছে বলে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন ঢাকা পরিবহন সম্বয় কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক নীলিমা আখতার৷
রেশনালাইজেশন কমিটির সদস্য পরিবহন বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের অধ্যাপক ড. এস এম সালেহ উদ্দিন জানান, ‘‘রেশনালাইজেশনের মাধ্যমে ঢাকা ও আশপাশের জেলায় বাসের রুট মোট ৪২টিতে নামিয়ে আনা হবে৷ বাসগুলো ওই ৪২টি রুটের সরকারনিয়ন্ত্রিত ২২টি কোম্পানির অধীনে থাকবে৷ অপ্রয়োজনীয় বাস রুট বন্ধ করে দেয়া হবে৷ এখন শত শত রুট রয়েছে যার কোনো প্রয়োজন নাই৷ যেমন গাজীপুর থেকে ঢাকায় ৪০-৫০টি রুট আছে৷ একেকটি কোম্পানি তাদের সুবিধা অনুযায়ী রুট তৈরি করে নিয়েছে৷ ফলে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে৷ যাত্রীরা বেশি ভাড়া গুনতে বাধ্য হচ্ছেন৷''
এই রুট রেশনালাইজেশন হলে ২০১৯ এবং এর পরে ২০২১ সালের মডেলের বাস চালাতে হবে৷ ভাড়া নেয়া হবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে৷ আর ঢাকাকে মোট ছয়টি অঞ্চলে( ক্লাস্টার) ভাগ করা হয়েছে৷ পরিবহন মালিকেরা রুটে বাস দিয়ে সরাসরি ভাড়া পাবেন না৷ তারা মাস শেষে ঢাকা পরিবহন সমম্বয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্ধারিত হারে ভাড়া নেবেন৷ চালক ও বাসের স্টাফেরা হবেন নিয়োগপ্রাপ্ত৷ ট্রিপ ভিত্তিক ও চুক্তিভিত্তিক কোনো বাস চলবে না৷ আর ঢাকা থেকে মিনিবাস উঠে যাবে৷
অবশ্য ২০০৪ সাল থেকে এই রেশনালাইজেশনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে৷ রোববার পরীক্ষামূলকভাবে একটি রুটে এই সার্ভিস চালু করা গেল৷ ১০০ বাস দিয়ে শুরু করার কথা থাকলেও ৫০টি বাস দিয়ে শুরু করা হয়েছে৷ তারমধ্যে ৩০টি বিআরটিসির বাস৷ আর নতুন বাস দিয়ে শুরু করার কথা থাকলেও পুরনো রঙ করা বাস দিয়েই শুরু করা হয়েছে৷ বাসের শতভাগ ফিটনেস থাকার কথা থাকলেও সেটা মানা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে৷
ড. এস এম সালেহ উদ্দিন বলেন, ‘‘আমরা এই পরীক্ষামূলক রুট দিয়ে ত্রুটি বিচ্যুতি বোঝার চেষ্টা করব৷ তারপর পুরো কাজ শুরু করব৷ এতদিনে আমরা আমাদের পুরো পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছি৷ এখন বাস্তবায়ন করার পালা৷ যাতে পরিবহন মালিকেরা নতুন বাস নামাতে পারেন সেজন্য আমরা শতকরা পাঁচ ভাগ সূদে ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা করেছি৷''
ঢাকা শহর এবং আশপাশ এলাকায় এখন মোট সাড়ে পাঁচ হাজারের মত বাস মিনিবাস চলাচল করে৷ আর বাস কোম্পানি আছে ২৭৫টির মত৷ তারা তাদের খেয়াল খুশি মত বাস চালান৷ কোনো নিয়মনীতি মানতে চান না৷ রেশনালাইজেশন হলে পরিবহন মালিক ও কোম্পানিগুলো ইচ্ছেমত কিছু করতে পারবে না বলে জানান ঢাকা পরিবহণ সম্বয় কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক নীলিমা আখতার৷ ভাড়াও কমে যাবে কারণ, ডিজিটাল পদ্ধতিতে কিলোমিটার হিসাব করে ভাড়া রাখা হবে৷ আর বাস ছাড়ার সময় নির্ধারিত থাকবে৷ অতিরিক্ত যাত্রী তোলা যাবে না৷ টিকেট ছাড়া যাত্রী থাকবে না৷
এরজন্য ঢাকায় বাস টার্মিনাল, বাস স্টপেজ এগুলোও তৈরি হচ্ছে বলে জানান,অধ্যাপক সালেহ উদ্দিন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের পরিকল্পনা আছে অধিকাংশ বাস ঢাকা শহরের বাইরে রাখার ব্যবস্থা করার৷''
এদিকে এই বাস রুট রেশনালাইজেশনে বাস মালিকেরা বিরোধিতা করছেন বলে অভিযোগ আছে৷ তবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েতুল্যাহ বলেন, ‘‘এই অভিযোগ সঠিক নয়৷ আমরা সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই৷ তবে এটা ভালো না খারাপ হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না৷ একটি রুট শুরু হয়েছে দেখি কী হয়৷''
তার কথা," নতুন বাস আমরা কোথায় পাব৷ আমাদের বাস নিলে পুরনো বাসই নিতে হবে৷ তারা তো একটি রুট পুরানো বাস দিয়েই শুরু করেছে আর সরকার ঋণ দিলে যার পোষাবে সে নতুন বাস কিনবে৷”
ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর রুট রেশনালাইজেন আরো আগে শুরু হওয়ার কথা ছিলো৷ কিন্তু তখন মালিকেরা যে বাস দিয়েছিলেন তার অধিকাংশেরই ফিটনেস ছিল না৷ চালকদের বৈধ লাইসেন্স ছিল না৷ তাই তখন চালু করা যায়নি৷ এবার ৫০টি বাস দিয়ে চালু হলেও তা বাড়িয়ে ১০০ করা হবে৷
ঢাকা শহরকে ছয়টি অঞ্চলে ভাগ করে বাসগুলো যখন চালু হবে তখন বাসগুলোর ছয় ধরনের রঙের হবে৷ এখন যে বাসগুলো চালু হয়েছে তার রঙ সবুজ৷ এই রুটে অন্য বাস সব বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷
নীলিমা আখতার
অধ্যাপক ড. এস এম সালেহ উদ্দিন
চালু হল ঢাকা নগর পরিবহণ
রাজধানীর গণপরিবহণে যাত্রী হয়রানি রোধে এবং শৃঙ্খলা ফেরাতে রোববার থেকে ৫০ টি বাস নিয়ে চালু হলো ‘ঢাকা নগর পরিবহণ’৷ কেরাণীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার চলবে এই বাস৷ ভাড়া কিলোমিটার প্রতি ২ টাকা ১৫ পয়সা৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বাসে চড়ে উদ্বোধন
এই বাস সেবার উদ্বোধন করেছেন সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের৷ তিনি সচিবালয় থেকে অনলাইনে যুক্ত হন৷ আর মোহাম্মদরপুরের বাস ডিপোতে বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকার দুই মেয়র৷ পরে মেয়রদ্বয় একটি বাসে চড়ে মোহাম্মদপুর থেকে শংকর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত গিয়ে এ কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
আপাতত জোড়াতালি দিয়ে
ঢাকার মাতুয়াইলসহ একাধিক ওয়ার্কশপ ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন বেসরকারি বাস কোম্পানির পুরাতন বাসগুলো রং করে এ প্রকল্পে যুক্ত করা হচ্ছে৷ এছাড়া বিআরটিসির সব বাসও একদম নতুন না৷ ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত প্রথমে ১৫৫টি বাস চলার কথা থাকলেও আপাতত ২০টি ট্রান্স সিলভা ও ৩০টি বিআরটিসির দোতলা বাস দিয়ে চালু হয়েছে এ পরিবহণ সেবা৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ভবিষ্যত পরিকল্পনা
ঢাকা নগর পরিবহণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘‘২০২৩ সালে যখন মেট্রোরেল চালু হবে, তখন ঢাকার রাস্তাতেও সু-শৃংখলভাবে গণপরিবহণ চলবে৷ ২০২৩ সালের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে ঢাকা শহরে ঢাকা নগর পরিবহণ চালু করতে পারবো৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
পৃথক যাত্রী ছাউনি-স্টপেজ
ফ্রাঞ্চাইজি নিয়মের আওতায় এ পাইলট প্রকল্পে রয়েছে পৃথক যাত্রী ছাউনি ও বাস স্টপেজ৷ সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, টিকেট ছাড়া ও যত্রতত্র এ বাসে যাত্রী উঠানামা করতে পারবেন না৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
যেসব রুটে বাস চলবে
ঘাটারচর থেকে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড, শংকর, জিগাতলা, সায়েন্সল্যাব, শাহবাগ, প্রেসক্লাব, শাপলা চত্বর, টিকাটুলি, যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, মাতুয়াইল, সাইনবোর্ড, মৌচাক হয়ে চিটাগং রোড পর্যন্ত মোট ২৫ কিলোমিটার চলাচল করবে বাসগুলো৷ ভাড়া কিলোমিটার প্রতি ২ টাকা ১৫ পয়সা৷ অর্থাৎ সর্বনিম্ন ১০ টাকা থেকে ৫৫ টাকা পর্যন্ত ধরা হয়েছে৷ এছাড়া টিকেট ই-টিকেটিং পদ্ধতির মাধ্যমে বিক্রি করা হবে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
চালক ও সহকারির পৃথক পোশাক
বিভিন্ন সময়ে গণপরিবহণে চালকের বেপরোয়া গাড়ি চালনা, চালকের সহকারীর দূর্ব্যবহার, হয়রানিসহ নানা অভিযোগের প্রেক্ষিতে এই সেবায় চালক ও সহকারিকে সবুজ রংয়ের পৃথক পোশাক ও পরিচয়পত্র দেয়া হয়েছে৷ এছাড়া বাসগুলোকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে ৬টি ভিন্ন রঙ দেয়া হবে বলে জানা গেছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘রেশনালাইজেশন’ প্রকল্পের অংশ
রাজধানী ঢাকার গণপরিবহণ সমস্যা নিরসনে এবং এ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে ২০০৪ সালে বাস রুট ‘রেশনালাইজেশনের’ পরিকল্পনা নেয়া হয়৷ মূল ধারণা ছিল ঢাকার সব গণপরিবহণকে এক ছাতার নীচে নিয়ে আসা৷ এ পরিকল্পনা অনুযায়ী, বর্তমানের ২৯১টি রুটের পরিবর্তে ৪২টি রুটে নিয়ে আসা হবে৷ কোম্পানির মালিকেরা পাবেন লভ্যাংশ৷ বর্তমানে এ পরিকল্পনাই বাস্তবে রুপ পাচ্ছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সমন্বিত প্রকল্প
‘ঢাকা নগর পরিবহণ’ নামের এ ‘রেশনালাইজিং’ পরিবহণ সেবাটি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সমন্বিত উদ্যোগ৷ এ পরিবহণ সেবায় যুক্ত হতে আটটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আবেদন করে৷ এরমধ্যে বিআরটিসি, ট্রান্স সিলভাসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ দেয়া হয়৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘প্রশংসনীয়’, কিন্তু টিকবে কি?
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আলতাফ হোসেন নতুন এ বাস সেবার টিকেট কাটতে গিয়ে বলেন, ‘‘সরকার তো অনেক বিষয়েই অনেক উদ্যোগ নেয়, কিন্ত সেগুলি বেশিদিন জনবান্ধব থাকে না৷ এই নগর পরিবহন অবশ্যই একটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষ এর কতটা সুফল পায়, সেটাই দেখার বিষয়৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
প্রক্রিয়ায় সন্দেহ
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ সামছুল হক বলেন, ‘‘এটি একটি সিস্টেম৷ তারা শুধু একটি কমিটি করেছে যা দিয়ে এ ধরনের রুট ফ্রাঞ্চাইজি কখনো করা যায় না৷ ধারাবাহিকভাবে কাজের দূর্বলতা থাকায় এ সেবা খুব বেশিদিন টেকসই হবে না বলে আমার ধারণা৷’’
ছবি: Private
আনিসুল হকের উদ্যোগ
রাজধানীর গণপরিবহণের বিশৃংখলা দূর করার এই উদ্যোগ ছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের যার উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর৷ তার নেয়া পদক্ষেপ বিবেচনায় ১০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ মূলত প্রয়াত মেয়রের উদ্যোগটিকেই বাস্তবে রুপ দেয়ার জন্য নেয়া হয়েছে এ প্রকল্প৷