কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তরে ছাত্র-ছাত্রীদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ‘ওপেন বুক এক্সাম’ বা বাড়ি থেকে পরীক্ষা দেওয়ার পদ্ধতি আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত৷ ভারতেও কোনো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়৷ কিন্তু মোটের উপর এদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে অতীতের পদ্ধতিই চলে৷ অর্থাৎ পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে পরীক্ষার্থী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রশ্নের উত্তর দেন৷ প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষায় একই ছবি৷ কিন্তু করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছে৷ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীর পরীক্ষা নেওয়া কষ্টসাধ্য হওয়ায় জোর দেওয়া হচ্ছে ডিজিটাল ব্যবস্থায়৷

পরীক্ষা ও ফলপ্রকাশ নিয়ে দীর্ঘ অনিশ্চয়তার পর রাজ্য সরকার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে বলেছে, অক্টোবরে পরীক্ষা নিয়ে সেই মাসেই ফল প্রকাশ করতে হবে৷ কিন্তু একটি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার্থীকে অন্য প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষায় বসিয়ে, তাঁদের উত্তরপত্রের বহির্মূল্যায়ন করে এক মাসের মধ্যে ফল বার করা সম্ভব নয়৷ তাই অনলাইন বা অফলাইন পরীক্ষার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে৷ বুধবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করেছে, তারা পরীক্ষা নেবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে৷ উপাচার্য সোনালী চক্রবর্তী বন্দোপাধ্যায় জানিয়েছেন, স্নাতক স্তরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশ্ন তৈরি করে পাঠাবে কলেজকে৷ সেই প্রশ্ন কলেজ দেবে পড়ুয়াদের৷ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উত্তরপত্র তৈরি করে অনলাইনে জমা দিতে হবে৷ প্রয়োজনে কেউ অফলাইনে বা কলেজে এসে উত্তরপত্র জমা দিতে পারেন৷

উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে নিয়মে বদল আসছে৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত, কোনো কলেজ সেখানে পাঠরত ছাত্র-ছাত্রীদের খাতা দেখবে৷ স্নাতকোত্তর স্তরের ক্ষেত্রেও পরীক্ষা গ্রহণে যেমন একই পদ্ধতি নেওয়া হবে, তেমনই উত্তরপত্র মূল্যায়ন করবেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় শিক্ষকরা৷ অর্থাৎ ফলাফলের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার স্বার্থে অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের খাতা দেখা বা বহির্মূল্যায়নের সুযোগ থাকছে না৷ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও পরীক্ষা গ্রহণের পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে আলোচনা চালাচ্ছে৷ সিদো কানহু বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাসমূহের নিয়ামক সুবল দে ডয়চে ভেলেকে জানান, তাঁরা এবার পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষাকেন্দ্রে এসে পরীক্ষা দিতে বলবেন না৷ বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাসমূহের নিয়ামক অনিন্দ্যজ্যোতি পাল জানিয়েছেন, তাঁরা পদ্ধতি নির্ধারণের জন্য আলোচনা করছেন৷

বাড়িতে বসে পরীক্ষা দিলে সব পরীক্ষার্থী বই দেখে উত্তর দেওয়ার সুযোগ পাবে৷ এই ওপেন বুক এক্সাম-এ কি পরীক্ষার্থীর সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব? অধ্যাপকদের সংগঠন ওয়েবকুপা-র সভাপতি কৃষ্ণকলি বসু বলেন, ‘‘আমরা যখন উন্নত দেশের শিক্ষাদানের পদ্ধতি অনুসরণ করছি, তখন পরীক্ষা পদ্ধতি কেন নেব না৷ যিনি প্রশ্ন তৈরি করবেন, তাঁকে মাথায় রাখতে হবে, মুখস্থ বিদ্যা বা রেডিমেড নোট কাজে লাগিয়ে যেন উত্তর দেওয়া না যায়৷ যে পড়ুয়া বিষয়ের গভীরে পড়াশোনা করেছেন, এই পদ্ধতিতে তাঁর সঠিক মূল্যায়ন হবে৷ তাছাড়া সংক্রমণের সময় পরীক্ষাকেন্দ্রে ছেলেমেয়েদের টেনে আনা নিরাপদ নয়৷’’ একই মত আশুতোষ কলেজের বিএ তৃতীয় বর্ষের ছাত্র সম্রাট গোস্বামীর৷ তিনি বলেন, ‘‘চিরাচরিত ধাঁচে সাধারণ প্রশ্ন হলে মূল্যায়ন ঠিক হবে না৷ এমন প্রশ্ন করা দরকার যার উত্তর হবে ক্রিটিক্যাল অর্থাৎ বিষয় না বুঝে লেখা যাবে না৷’’

কিন্তু যে দেশে শিক্ষা মূলত কোচিং সেন্টার, সাজেশন ও নোটবুক-নির্ভর সেখানে হঠাৎ ওপেন বুক এক্সাম কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে৷ জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্বের অধ্যাপক অভিজিৎ পাঠক এই পদ্ধতিতে পড়ুয়াদের পরীক্ষা নেন৷ তবে তিনি বলেন, ‘‘ওপেন বুক এক্সাম-এর জন্য ছাত্রকে প্রস্তুত করতে হলে শিক্ষককে অনেক পরিশ্রম করতে হয়৷ আমাদের শিক্ষকদের সেই প্রশিক্ষণ নেই, আমরা শর্টকাট নিই৷ তাই পড়াশোনা এখন গাইডবুকের উপর নির্ভরশীল৷ এর ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের দশটি কারণ মুখস্থ করে যায়, এ নিয়ে পর্যালোচনার ক্ষমতা তাদের গড়ে ওঠে না৷ ব্ল্যাক মানির মতো এটা ব্ল্যাক এডুকেশন৷ এতে শিক্ষারই অপমান৷’’