কাতরাতে কাতরাতে বাড়ি ফিরে যেতে চেয়েছিল মনির৷ হরতালের আগুন ঢাকা দেখার সাধ চিরতরে মিটিয়ে দিয়েছিল তার৷ মনির ফিরে গেছে৷ তবে মায়ের আচলের সুশীতল ছায়াতলে নয়৷ পারিবারিক কবরস্থানে শেষ ঠিকানা পেল সে৷
বিজ্ঞাপন
মনিরের গায়ে হরতালের আগুন লাগে সোমবার৷ এরপর টানা তিনদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েছে সে৷ কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না৷ বরং বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার নির্মম শিকারে পরিনত হয়েছে মনির৷ চলে গেছে না ফেরার দেশে৷
সামাজিক যোগাযোগ সাইট ফেসবুক এবং বাংলা ব্লগে মনিরের মৃত্যু নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অনেকে৷ আমার ব্লগ ডটকমে ব্লগার সুমিত কর্মকার লিখেছেন, ‘‘দিনের বেলায় ঢাকা শহরটা ঘুরার আগে বাবার গাড়িতে মনির একটু ঘুমায়৷ বাবার একটা বার চিন্তা হয়নি, হঠাৎ কিছু পশু এভাবে ঘুমের মাঝে এসে গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে যাবে৷ শেষ পর্যন্ত, নিজের ক্লান্ত দেহের ঘুমটা আজ সকালে চিরকালের জন্য ঘুমের দেশে পাঠিয়ে দেয় মনিরকে৷ ''
হরতালের আগুনে জ্বলছে বাংলাদেশ
যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিবাদে চলতি সপ্তাহে হরতালের সূচনা করে জামায়াত-শিবির৷ এএফপির হিসেবে গত ২১শে জানুয়ারি থেকে ৪ই মার্চের মধ্যে বাংলাদেশে সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৮০ ব্যক্তি৷ হরতালের কিছু ছবি নিয়ে ছবিঘর৷
ছবি: Reuters
বরিশালে অগ্নিসংযোগ
জামায়াত-শিবিরের ডাকা হরতালের দ্বিতীয় দিন ৪ই মার্চ বরিশালে মোটর সাইকেলে অগ্নি সংযোগ করছে দলটির সমর্থকরা৷ এভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় হরতালের সময় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, পুলিশের উপর হামলায় অংশ নেয় জামায়াত-শিবিরের সমর্থকরা৷ উদ্দেশ্য, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা৷
ছবি: Reuters
সহিংসতায় নিহত কমপক্ষে ৮০
ঢাকায় ৪ মার্চ হরতাল চলাকালে জামায়াতে ইসলামী কর্মী সন্দেহে এক ব্যক্তিকে আটক করছে পুলিশ৷ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের দাবিতে গত ২১শে জানুয়ারি থেকে জামায়াত-শিবিরের বিভিন্ন সহিংস কর্মসূচিতে প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৮০ ব্যক্তি৷ নিহতদের মধ্যে জামায়াত-শিবিরের সদস্য ছাড়াও পুলিশ, আওয়ামী লীগ কর্মী, নিরীহ পথচারী এবং সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের নাগরিকও রয়েছেন৷
ছবি: Reuters
ট্রেনে আগুন
ঢাকায় হরতাল চলাকালে ৪ মার্চ কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থানরত একটি ট্রেনে আগুন লাগে৷ ছবিতে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন জনতা৷ ঢাকা থেকে নোয়াখালিগামী ট্রেনটির তিনটি বগি আগুনে পুড়ে গেছে৷ রেলমন্ত্রী মাজিবুল হক ট্রেনে অগ্নিসংযোগের জন্য জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করেছেন৷
ছবি: Reuters
মসজিদ থেকে গ্রেপ্তার
হরতাল চলাকালে ৪ মার্চ ঢাকার একটি মসজিদ থেকে জামায়াত কর্মী সন্দেহে কয়েকজনকে আটকে করে পুলিশ৷ জামায়াতের ভাইস-প্রেসিডেন্ট দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়ার পর বাংলাদেশে সহিংসতার তীব্রতা বেড়ে যায়৷ ২৮ ফেব্রুয়ারি এই রায় ঘোষণার পর বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতায় ৪ মার্চ অবধি প্রাণ হারিয়েছেন ৬৪ ব্যক্তি৷
ছবি: Reuters
অব্যাহত অগ্নিসংযোগ
হরতালের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে অগ্নিসংযোগ৷ রাস্তায় টায়ার পোড়ানো, গাড়িতে আগুন, ট্রেনে আগুন, মার্কেটে আগুন – চলতি হরতালে সবই দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ৷ ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে এখন হরতালের সহিংসতার ভিডিও পৌঁছে যাচ্ছে বিশ্বের সব প্রান্তে৷ ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ৩ মার্চ রাস্তায় অগ্নিসংযোগ করছে জামায়াতের সমর্থকরা৷
ছবি: Reuters
‘কপাল পোড়ে’ সাধারণ মানুষের...
জীবিকার তাগিদে রাস্তায় নেমেছিলেন এই অটোরিকশা চালক৷ ২ মার্চ ঢাকায় জামায়াতের কর্মীদের ছোড়া ইটের টুকরায় গুরুতর আহত হন তিনি৷ অটোরিকশাও ভেঙ্গে গেছে৷ রাজনৈতিক সহিংসতায় এভাবেই ‘কপাল পোড়ে’ সাধারণ মানুষের৷
ছবি: Reuters
শরিক জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি’র তাণ্ডব
দুই মার্চ ঢাকায় এভাবেই গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র কর্মীরা৷ সেদিন ঢাকায় মিছিল করেছিল বিএনপি এবং জামায়াতের সমর্থকরা৷ পুলিশ অবশ্য বিরোধীদের কঠোর হাতে মোকাবিলার চেষ্টা করছে৷
ছবি: Reuters
রাবার বুলেট, বুলেট
২ মার্চ ঢাকায় বিএনপি কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলাকালে বন্দুকে রাবার বুলেট ‘লোড’ করছেন এক পুলিশ কর্মকর্তা৷ তবে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, সেদিন সংঘর্ষ চলাকালে সত্যিকারের বুলেটও ব্যবহার করে পুলিশ৷ এছাড়া হরতাল চলাকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ আত্মরক্ষায় বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে৷
ছবি: Reuters
চোখের সামনে জ্বলছে আগুন
২ মার্চ ঢাকায় বিএনপি সমর্থকরা গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে৷ ছবিতে পুলিশ একটি জ্বলন্ত গাড়ি দেখছে৷ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে চলমান সহিংসতাকে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দিয়ে জামায়াত-শিবিরকে সমর্থন জানিয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি৷
ছবি: Reuters
একদিনে নিহত কমপক্ষে ৩৪
২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে ফাঁসির রায় ঘোষণার দিনে সহিংসতায় বাংলাদেশে প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৩৪ ব্যক্তি৷ এদের মধ্যের ২৩ জন পুলিশ এবং ইসলামপন্থিদের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হন৷ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে একদিনে এত সহিংসতা দেখেনি বাংলাদেশ৷
ছবি: AFP/Getty Images
10 ছবি1 | 10
সামহয়্যার ইন ব্লগে রনী মুরাদ লিখেছেন, ‘‘মনির আজ আর একটি নাম নয়৷'' মনিরের উদ্দেশ্যে এই ব্লগার লিখেছেন, ‘‘তুমি আজ আমাদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে প্রমাণ করে দিলে আমরা কতটা হিংস্র, বর্বর৷ তোমার হয়ত জানার বয়স হয়নি যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতার ইতিবৃত্ত এখানেই শেষ নয়, এখানে শেষ হবেও না, তবুও আমরা দিনশেষে হরতালের পক্ষে বিবৃতি দেব! ''
একই ব্লগ সাইটে এস এম মোমিনের লেখার শিরোনাম ‘‘হৃদয়ে রক্তক্ষরন এবং রাজনীতির আগুনে পোড়া একজন মনির৷'' ২০০৭ সালের জুলাই মাস থেকে সামহয়্যার ইন ব্লগে থাকা এই ব্লগার লিখেছেন, ‘‘সরকারি চাকুরে হওয়ায় গত তিনদিনের হরতালে আমাকে বাধ্যতামূলক অফিসে আসতে হয়েছে, গাজীপুরের সেই একই রাস্তায় যেখানে ঘুমন্ত মনিরকে পুড়িয়ে দাহ করা হয়েছে৷ ওই স্থানটা ক্রস করার সময় আমারও ভয় হয় এই বুঝি মানুষরূপি হায়নাদের রোষানলে পড়ছি৷''
ব্লগার তানভীর-বিন-হাসান লিখেছেন, মনিরের বাবা রমযান আলিকে নিয়ে৷ তিনি লিখেছেন, ‘‘রমযান আলির বুকে আর কখনো তার কোনো সন্তানকে নিয়ে ঢাকা শহর বেরুবার ইচ্ছা হবে না৷ এক বুক পৃথিবী বোঝাই করে ঘুরে বেড়ানো সম্ভব হবে না তার৷ দু'দিন ধরে ছেলেকে যে শহর দেখিয়েছেন, যে শহরে বাবার সাথে ঘুরে ঘুরে দুটো দিনের অপার্থিব আনন্দ নিয়ে ভরে উঠেছিল মনির, সেটা জানা হবে না অনাগত কোন ভবিষ্যতের৷