বাড়ি ফেরা মানুষের ঢল, বাস চালু করতে শাজাহান খানের হুমকি
হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৮ মে ২০২১
নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশে পণ্যবাহী ট্রাক পারাপারের জন্য ফেরি চলার কথা সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত৷ কিন্তু শনিবার যাত্রীদের চাপে রাতদিন ২৪ ঘণ্টার জন্যই ফেরি খুলে দেয়া হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
সাবেক নৌমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খান দ্রুত দূরপাল্লার বাসও চালুর দাবি জানিয়েছেন৷ অন্যথায় ঈদের দিন এবং ঈদের পরে আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন৷
ঈদে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে শুক্রবার রাত থেকেই হাজার হাজার মানুষ মাওয়া ও পাটুরিয়া ফেরিঘাটে হাজির হতে থাকেন৷ তারা ঢাকা থেকে বিভিন্ন ছোট ও ব্যক্তিগত পরিবহণে ও পায়ে হেঁটে ফেরিঘাটে হাজির হন৷ রাতেই তাদের চাপে মাওয়া ফেরি চালু হয়৷ আর শনিবার দুপুর ১২টার পর চালু হয় পাটুরিয়ার ফেরি৷ পাটুরিয়া ফেরিঘাটের মহাব্যবস্থাপক জিল্লুর রহমান ডয়চে ভেলেকে জানান, এখানকার ১৬টি ফেরিই এখন পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার জন্য চালু থাকবে৷ মানুষের চাপে এটা করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না বলে দাবি করেন তিনি৷ মন্ত্রণালয়ও চাপ সামলাতে ফেরি চালুর অনুমতি দেয়৷ তিনি বলেন, ‘‘আগেই মাওয়া ফেরি চালু হওয়ায় আমরাও চালু করতে বাধ্য হয়েছি৷’’
ফেরিঘাটে সকাল থেকে হয়রানির অভিযোগ করেন সেখানে উপস্থিত কয়েকজন৷ তারা বলেন ফেরি বন্ধ থাকলেও ভিআইপি ও বিশেষ সুবিধায় অনেকের জন্যই ফেরি চলছিল৷ যা সাধারণ মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে৷ এক পর্যায়ে তাদের বেশ কয়েকবার ফেরিতে তুলে আবার নামিয়ে দেয়া হয়৷
দূরপাল্লার বা আন্তঃজেলা বাস না চললেও মানুষ মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, পিকআপ, জেলার মধ্যে চলাচলরত বাস ও ভ্যানে করে গ্রামের বাড়ি রওনা হয়েছেন৷
জিল্লুর রহমান
কেন বাড়ি ছুটছেন মানুষ?
ঢাকার মিরপুরের আলাউদ্দিন আহমেদ ছোট ব্যবসা করেন৷ থাকেন মিরপুরে৷ করোনায় তার ব্যবসা বন্ধ৷ গ্রামের বাড়ি বরিশালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন তিনি৷ কেন করোনার মধ্যেও গ্রামের বাড়ি যেতে হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘ব্যবসা বন্ধ৷ পরিবার পরিজন নিয়ে ঢাকায় থাকার কোনো উপায় নেই৷ এখানে থাকলে না খেয়ে মরব৷ করোনায় মরব৷’’
তিনি জানান, মিরপুর থেকে ছয়-সাত বার যানবাহন পরিবর্তন করে পাটুরিয়া ফেরিঘাটে পৌঁছান৷ ফেরি পার হয়ে এভাবেই যানবাহন পরিবর্তন করে করে বাড়ি যাবেন৷ জেলার ভেতরে যে বাস চলছে সেগুলোই তার ভরসা৷ তবে এজন্য অতিরিক্ত খরচ গুণতে হচ্ছে তাকে৷
মোহাম্মদ কাওসার থাকেন কল্যাণপুরে৷ সকালেই তিনি অনেক কষ্ট করে ফেরিঘাটে স্ত্রীকে নিয়ে হাজির হয়েছেন৷ তার চাকরি চলে গেছে করোনায়৷ ঢাকায় থাকার মত কোনো উপায় নাই৷ বাসাভাড়াও দিতে পারছেন না৷ ‘‘করোনা হোক আর যাই হোক ঢাকায় থাকার উপায় নেই৷ ঢাকায় থাকলে না খেয়ে মরতে হবে,’’ বলেন কাওসার৷
তবে সবাই যে এই পরিস্থিতিতে ঢাকা ছাড়ছেন তা নয়৷ অনেকই ব্যক্তিগত গাড়ি বা ২৫-৩০ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে মাইক্রোবাসে ঢাকা ছাড়ছেন৷ তারা আসলে গ্রামে সবার সাথে ঈদ করতে যাচ্ছেন৷ সেরকমই একজন সোহরাব আলম বলেন, ‘‘সবার সাথে ঈদ করতে চাই৷ ঢাকায় ঈদে তো ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হবে৷ সাবধানে যাচ্ছি৷ স্বাস্থ্যবিধি মানার চেষ্টা করছি৷’’
কিন্তু এই হাজার হাজার মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো উপায় নাই৷ ফেরিঘাটের মহাব্যবস্থাপক জিল্লুর রহমান বলেন, ‘‘আমাদের পক্ষে স্বাস্থ্যবিধি মানানো সম্ভব নয়৷ এত মানুষের মধ্যে কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানানো সম্ভব?’’
শাজাহান খান
‘দূরপাল্লার বাস চলবেনা কেন’
সরকার ১৬ মে পর্যন্ত লকডাউনের ঘোষণা দিলেও দোকান-পাট, সুপার মার্কেট সব খুলে দেয়া হয়েছে৷ সিটি সার্ভিস বাস ও জেলার মধ্যে বাস চলাচলও শুরু হয়েছে৷ তাই দূরপাল্লার বা আন্তঃজেলা বাস অবিলম্বে চালুর দাবি জানিয়েছেন শাজাহান খান৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সবকিছু খোলা থাকলে দূরপাল্লার বাস চলবেনা কেন? আমরা অবিলম্বে বাস চালুর দাবি জানিয়েছি৷ অন্যথায় ঈদের দিন দুপুর ১০টা থেকে দুই ঘণ্টা সব বাস টার্মিনালে অবস্থান ধর্মঘট পালন করব৷ ঈদের পর আরো কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে৷’’ তিনি দাবি করেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনেই বাস চালানো হবে৷ অর্ধেক আসন খালি রাখা হবে৷
তাদের পক্ষ থেকে যাননবাহন মেরামত, র্কমচারী ও শ্রমিকদের বতেন-ভাতা ও ঈদ বোনাস ইত্যাদি দেয়ার জন্য গাড়ির মালকিদের নাম মাত্র সুদে ও সহজ শর্তে পাঁচ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনারও দাবি করা হয়েছে সরকারের কাছে৷
বাংলাদেশে ১৩ মে থেকে তিন দিনের ঈদের ছুটি শুরু হবে৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই করোনায় যার যার অবস্থানে থেকে ঈদ করার আহ্বান জানিয়েছেন৷ আর সরকারি কর্মকর্তারা ছুটিতেও কর্মস্থল ত্যাগ করতে পারবেন না বলে আদেশ দেয়া হয়েছে৷
লকডাউনে ঈদের কেনাকাটা: ঢাকার বিভিন্ন স্থানের চিত্র
বাংলাদেশে কঠোর লকডাউনের মধ্যেই ঈদ উপলক্ষে খুলে দেওয়া হয়েছে মার্কেট ও শপিংমল৷ সবক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানার নির্দেশনা থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রের এর অভাব চোখে পড়েছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ঈদের জন্য কেনাকাটা
একাধিক শপিংমল এবং মার্কেটে কেনাকাটা করতে আসা মানুষ জানালেন, তারা প্রায় সবাই ঈদের কেনাকাটা করতেই এসেছেন৷ পরিবার এবং আত্মীয়স্বজনের মন রক্ষা করতেই করোনা সংক্রমণের ভয়কে উপেক্ষা করেই এখানে এসেছেন বলে জানান তারা৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বেচাকেনা শুধু পেপার-পত্রিকাতেই
ঢাকার ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের সোমা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মোঃ আবুল বাশার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘‘বেলা বাজে ১২ টা, এখনো বউনি করতে পারি নাই৷ দোকানে কোন কেনাবেচা নাই, শুধু খবরেই আমরা দেখি বেচাকেনায় ধুম পড়সে, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে থেমে থাকে না
ধানমন্ডির হকার্স মার্কেট সংলগ্ন দোকানগুলোতে ঘুরে দেখা গেল, বিয়ের শাড়ি এবং সংশ্লিষ্ট জিনিসপত্র বেচাকেনা চলছে তুলনামূলক বেশি৷ কেনাকাটা করতে আসা সাবরিনা হোসেন জানালেন, তারা ঘরোয়াভাবেই বিয়ের আয়োজন করছেন৷ করোনার প্রকোপ কবে শেষ হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘বছরের পর বছর তো এভাবে বিয়েশাদি আটকে রাখা সম্ভব না৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মুখে মাস্ক নেই, আছে হাসি
ঢাকার নিউমার্কেটে বিভিন্ন দোকান ঘুরে দেখা গেল, খুব কম দোকানিই স্বেচ্ছায় মাস্ক পরে আছেন৷ শুধু ক্যামেরা দেখলেই তড়িঘড়ি করে মাস্ক পরছেন৷ অনেক ক্রেতার মুখেও মাস্ক নেই৷ মাস্ক না পরার কারণ জিজ্ঞেস করতে জানালেন, এই গরমে মাস্ক পরে কেনাকাটা করা অনেক কষ্ট৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
তীব্র তাপদাহেও ভাটা নেই কেনাকাটায়
এবার রমজানের শুরু থেকেই প্রচণ্ড গরমে জনজীবন বিপর্যস্ত৷ তার উপর করোনার উর্ধ্বমুখী সংক্রমণের ঝুঁকি৷ কিন্তু এসবের কোন প্রভাবই দেখা গেলো না কেনাকাটা করতে আসা মানুষের মধ্যে, তাদের কাছে কেনাকাটাই মুখ্য৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ক্যামেরাসহ দোকানে প্রবেশে বাধা
ক্যামেরা দেখলেই অনেক বিক্রেতা দোকানে প্রবেশে বাধা দিচ্ছেন৷ কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সাংবাদিক দেখলে তাদের ক্রেতারা দোকান ছেড়ে চলে যাচ্ছেন৷ এমনিতে বেচাকেনা নেই, এভাবে খদ্দের চলে গেলে তাদের আর কোন উপায় থাকবে না বলে জানান বিক্রেতারা৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বেচাকেনা বেশি ফুটপাথে
ঢাকার অন্যতম বড় কেনাকাটার জায়গা নিউমার্কেটে ঘুরে দেখা গেলো, দোকানিরা অলস সময় পার করলেও দিব্যি বেচাকেনা চলছে মার্কেটসংলগ্ন ফুটপাথগুলোতে৷ কারণ হিসেবে ক্রেতারা বলছেন, ফুটপাথে জিনিসপত্রের দাম তুলনামূলক কম থাকায় এবং করোনার কারণে মানুষের হাতে নগদ অর্থের সংকট থাকায় সবাই কম দামেই কেনাকাটা সেরে নিচ্ছেন এবার৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
লকডাউন কোথায়?
ঢাকার বিভিন্ন শপিংমল এবং মার্কেট সংলগ্ন রাস্তাগুলোতে দেখা মিললো যানবাহনের৷ শুধু গণপরিবহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকায় কোন বাস-লেগুনা দেখা গেলো না৷ একজন পথচারী সাংবাদিক দেখে মন্তব্য করলেন, ‘‘লকডাউন কোথায়? এই লকডাউনের কোন মানে আছে?’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ভিন্ন চিত্র
একাধিক মার্কেট ঘুরে তেমন স্বাস্থ্যবিধি মানতে না দেখা গেলেও বসুন্ধরা সিটি শপিং মলে পাওয়া গেল কিছুটা সন্তোষজনক চিত্র৷ এখানে প্রবেশের সময় দেহের তাপমাত্রা মাপা হচ্ছে, জীবাণুনাশক স্প্রে ছিটানোসহ সচেতনতামূলক মাইকিং করা হচ্ছে৷ এছাড়া সংক্রমণ ঠেকাতে সব ধরনের লিফট তারা বন্ধ রেখেছেন৷ এসব পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন ক্রেতারা৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মূল্যছাড়েও বেচাকেনা নেই
ঢাকার দ্বিতীয় বৃহত্তম শপিংমল বসুন্ধরা সিটিতে গিয়ে দেখা গেলো, নামিদামি ব্র্যান্ডসহ ছোটখাটো দোকানগুলোতে মূল্যছাড়ের প্রতিযোগিতা৷ কিন্তু তবুও ঈদের তুলনায় বেচাকেনা অনেক খারাপ বলে জানান বিক্রেতারা৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
দোকানে মানুষের ভিড়
বসুন্ধরা সিটি শপিংমলের বাটা শোরুমে গিয়ে দেখা গেলো সেখানে বিক্রয়কর্মীদের দম ফেলার ফুরসত নেই৷ দোকানে অনেক মানুষের ভিড়৷ বিক্রয়কর্মীরা জানালেন, ই-ভ্যালির অফারের কারণে মানুষ ৫০-৬০ ভাগ কম দামে জুতা কিনতে পারছে৷ তাই ঈদের কেনাকাটায় এই সুযোগ কেউ হাতছাড়া করতে চাইছে না৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
কাফনের কাপড় কেনার পরামর্শ
লকডাউনের মাঝেও সাধারণ মানুষের কেনাকাটার ধুম এবং সচেতনতার অভাব দেখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করছেন৷ জুতা কাপড়ের পাশাপাশি প্রত্যেকের জন্য একটি করে কাফনের কাপড় কেনার পরামর্শ দিতেও ছাড়ছেন না কেউ কেউ৷