জার্মানিসহ ইইউ-র ছ’টি দেশকে বায়ুদূষণের নির্ধারিত মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে জরিমানার মুখোমুখি হতে হচ্ছে৷ তাই বৃহস্পতিবার এই দেশগুলিকে আদালতে তলব করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপীয় কমিশন৷ এতে তাদের বিপুল অঙ্কের জরিমানা হতে পারে৷
বিজ্ঞাপন
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০১০ সালে ‘ইইউ বায়ুদূষণ নীতিমালা' ঘোষণা করে৷ ওই নীতিমালা অনুযায়ী, এর আওতাভুক্ত দেশগুলোর বাতাসে ১০ মাইক্রো মিলিমিটারের ক্ষুদ্র ক্ষতিকর ধূলিকণা বা পিএম১০ এবং নাইট্রোজেন অক্সাইডের মাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়৷
কিন্তু অনেক সদস্যরাষ্ট্রই বেঁধে দেওয়া মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি বায়ুদূষণ করছে৷ বিশেষ করে বড় শহরগুলোতে এই চিত্র নিয়মিত৷
উদাহরণ হিসেবে জার্মানির শহর স্টুটগার্টের বাতাসে প্রতি কিউবিক মিটারে ৮২ মাইক্রোগ্রাম নাইট্রোজেন অক্সাইড পাওয়া গেছে, যা নীতিমালায় উল্লেখিত মাত্রা ৪০ মাইক্রোগ্রামের দ্বিগুণেরও বেশি৷
ইইউ পরিবেশ কমিশনার কারমেনু ভেলা গত জানুয়ারিতে অভিযুক্ত ছয়টি দেশের পরিবেশ মন্ত্রীদেরকে ব্রাসেলসে ডেকেছিলেন সতর্ক করার জন্য৷ এর মধ্যে জার্মানির পরিবেশমন্ত্রী বারবারা হেন্ড্রিকসও ছিলেন৷
ইউরোপীয় ইউনিয়নে পরিবেশের পরিবর্তনে স্বাস্থ্যের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে যেসব সংগঠন কাজ করে তাদের মোর্চার নাম স্বাস্থ্য ও পরিবেশ অ্যালায়েন্স৷
দূষণ এবং ইউরোপ
দূষণ নিয়ে উত্তাল সারা পৃথিবী৷ দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য লাগাতার আন্দোলন চলছে৷ পিছিয়ে নেই জার্মানিও৷ তার মধ্যেই খবর, বাঁদর এবং মানুষের উপর গাড়ির ধোঁয়া পরীক্ষা করা হয়েছে৷ এক নজরে দেখা যাক ইউরোপের দূষণচিত্র৷
ছবি: picture alliance/empics/C. Radburn
ডিজেল সমাধান
সম্প্রতি জার্মান সরকার ডিজেলের ব্যবহার কমানোর একটি পরিকল্পনা করেছে৷ ডিজেল চালিত বাসগুলিতে এক ধরনের নতুন ‘একজস্টস্ক্রাবিং’ যন্ত্র লাগানো হচ্ছে৷ যাতে দূষণ কমে৷ তাছাড়াও ডিজেল চালিত গাড়িগুলি যাতে ইলেকট্রিক গাড়িতে বদলে ফেলা হয়, তার জন্য প্রচুর চার্জিং পয়েন্ট তৈরি করেছে৷ যদিও পরিবেশকর্মীদের বক্তব্য, দ্রুত সমস্ত ডিজেল গাড়ি বন্ধ করে নতুন ইলেকট্রিক গাড়ি রাস্তায় নামানো হোক৷
ছবি: Reuters/F. Bensch
ধোঁয়া বিড়ম্বনা
জার্মানি জুড়ে যখন ডিজেল বিরোধী আন্দোলন হচ্ছে, ঠিক তখনই একটি খবর দেশ জুড়ে আলোড়ন ফেলে দিয়েছে৷ খবর, একটি নাম করা গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা ডিজেলের দূষণ পরীক্ষার জন্য বায়ুহীন ঘরে বাঁদরদের বসিয়ে ধোঁয়া ঢুকিয়ে দিয়েছিল৷ শুধু তাই নয়, মানুষের শরীরে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড ঢুকিয়েও পরীক্ষা চালানো হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Führer
গাড়ি চলবে না
ইউরোপের অন্যতম দূষিত শহর মিলান৷ বায়ুদূষণের পরিমাণ কমানোর জন্য সম্প্রতি সেখানকার সরকার নিয়ম করেছে, দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে শহরের কেন্দ্রে গাড়ি চালানো যাবে না৷ ইটালির অন্য কয়েকটি শহরও একই পরীক্ষা শুরু করেছে৷
ছবি: picture alliance/NurPhoto/F. Di Nucci
নিখরচায় গণপরিবহণ
বায়ুদূষণে ব্যতিব্যস্ত ম্যাসেডোনিয়া৷ ইউরোপের বায়ুদূষণের ধার্য মাত্রার চেয়ে তাদের দূষণ প্রায় ১৫ গুণ বেশি৷ কয়লার প্রভূত ব্যবহারই এর কারণ বলে অনেকের মত৷ দূষণ কমানোর জন্য মানুষকে গণপরিবহণ চড়ায় উৎসাহ দিচ্ছে সরকার৷ ভাড়া দিতে হচ্ছে না বাসে-ট্রামে৷ সব ফ্রি৷
ছবি: picture alliance/dpa/G. Licovski
দুশ্চিন্তায় লন্ডন
ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাৎসরিক নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড ব্যবহারের সীমা ধার্য করে দিয়েছে৷ কিন্তু লন্ডন কোনো দিনই তা মেনে চলতে পারেনি৷ জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে লন্ডনের একটি রাস্তা ছ’দিন সেই সীমার মধ্যে বাঁধতে পেরেছে নিজেদের৷ কিন্তু বছরের বাকি দিন সেখানে দূষণ এতই বেশি যে, লন্ডনের মেয়র ভাবছেন, অতিরিক্ত দূষণের দিনগুলিতে স্কুল বন্ধ রাখবেন৷
ছবি: picture alliance/empics/C. Radburn
জার্মানির দূষণ
জার্মানির বায়ুদূষণের পরিমাণ নিয়েও সতর্ক করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ কারখানাগুলি থেকে যে পরিমাণ কালো ধোঁয়া প্রতিদিন বাতাসে মিশছে তা বিপদসীমার অনেক ওপরে৷
ছবি: Getty Images/L. Schulze
6 ছবি1 | 6
এর মুখপাত্র অ্যানি স্টাফনার বলেন, ‘‘এটি খুব ভালো ব্যাপার যে, ভেলা মন্ত্রীদের ব্রাসেলসে ডেকেছিলেন এবং বায়ুদূষণ কমাতে চাপ দিয়েছেন৷''
বায়ুদূষণের সমস্যাটি অনেক আগে থেকেই চিহ্নিত হলেও এটি সমাধানে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে বলে তিনি মনে করেন৷
ইউরোপীয় কমিশন ২০১৭ সালে যে এক ডজন সদস্য রাষ্ট্রকে বায়ুদূষণ নীতিমালা নিয়ে সতর্ক করেছিল, তার মধ্যে জার্মানিও ছিল৷ এখন তাদেরকে জরিমানা গুণতে হবে৷
বায়ুদূষণ নীতিমালা ভঙ্গ করায় পোল্যান্ড এবং বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে এই বছরের শুরুতেই পদক্ষেপ নেওয়া হয়৷
ইউরোপীয় কমিশনের মুখপাত্র এনরিকো ব্রিভিও ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বায়ুদূষণ কমিয়ে আনার ব্যাপারে কীভাবে কাজ করবে তা প্রত্যেকটি দেশ নিজেরাই ঠিক করবে৷ তাদেরকে কমানোর পদ্ধতি নিয়ে নির্দেশ দেওয়া আমাদের কাজ নয়৷''
জার্মানির পরিবেশমন্ত্রী ভেলার কাছে জানুয়ারির ৯ তারিখে দেশটির পরিবেশ ও পরিবহন মন্ত্রণালয় একটি চিঠি পাঠায়৷ চিঠিতে ২০১৭ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বায়ুদূষণ কমানোর একটি পরিকল্পনা আছে৷
পরিকল্পনায় রয়েছে, জার্মানিতে বায়ুদূষণ কমাতে ডিজেলচালিত পাবলিক বাসগুলোর ধোঁয়ার দূষণ কমাতে বায়ুশোধন যন্ত্র সংযুক্তকরণ, ই-কারগুলোর জন্য আরও অনেক বেশি চার্জিং পয়েন্ট তেরি করা এবং ই-মোবিলিটির ব্যবস্থা আরও শক্তিশালীকরণ৷ বিনামূল্যে যাতায়াতের সম্ভাবনা বন্ধের কথাও এতে বলা হয়েছে৷
কিন্তু পরিবেশবাদীরা বলছেন, জার্মানির পরিকল্পনা ইউরোপীয়ান কমিশনকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি৷
পরিবেশবাদী সংগঠন ফ্রেন্ডস অফ দ্য আর্থ (বিইউএনডি)-এর মুখপাত্র জেন্স হিলজেনবার্গ বলেন,‘‘ যদিও প্রস্তাবিত প্রকল্পটির মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী কিছু সুফল রয়েছে৷ কিন্তু এটি এখনই দূষণ কমাতে কাজে আসবে না৷ বায়ুদূষণের মাত্রা সহনীয় রাখতে জার্মানিকে তার কারিগরি দিকটি পরিবর্তন করতে হবে৷ পাশাপাশি নিবিড়ভাবে নাগরিকদের আচরণ পরিবর্তনের দিকেও জোর দিতে হবে৷''
ইউরোপে পেট্রোল-ডিজেলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার?
শুধু জার্মানিতে ডিজেলগেট কেলেঙ্কারির কারণে নয়, বায়ুদূষণ কমাতে ডিজেল ও পেট্রোলচালিত গাড়ি ধাপে ধাপে বন্ধ করার জন্য চাপ বাড়ছে গোটা ইউরোপে৷ কিন্তু এমন বৈপ্লবিক পদক্ষেপের পথে রয়েছে অনেক বাধা-বিপত্তি ও জটিলতা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Woitas
বিকল্প জ্বালানির ধীর অগ্রগতি
২০১৬ সালের হিসেব অনুযায়ী গোটা ইউরোপে মাত্র ০ দশমিক ২ শতাংশ গাড়ি পুরোপুরি বিদ্যুৎচালিত ছিল৷ হাইব্রিড গাড়ি ধরলে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ১ দশমিক ৩ শতাংশ৷ প্রযুক্তির উন্নতি সত্ত্বেও রাজনৈতিক সদিচ্ছা, অবকাঠামোর অভাবের মতো অনেক কারণে ইউরোপে পরিবহণের ক্ষেত্রে বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার এখনো নগণ্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Woitas
গাড়ি কোম্পানিগুলির প্রতিরোধ
পেট্রোল-ডিজেল ‘লবি’ প্রচলিত গাড়ির পক্ষে যে সব যুক্তি দেখায়, কর্মসংস্থান তার মধ্যে অন্যতম৷ যেমন জার্মানির গাড়ি শিল্পের সংগঠন ভিডিএ-র দাবি, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রচলিত পেট্রোল-ডিজেল ইঞ্জিন উৎপাদন বন্ধ করলে জার্মানিতে প্রায় ছ’লক্ষ মানুষ চাকরি হারাতে পারেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Jan Woitas
বিকল্প জ্বালানি ও কর্মসংস্থান
বিকল্প জ্বালানির সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপানের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের যে জোয়ার দেখা গেছে, ইলেকট্রিক ও হাইব্রিড গাড়ির ক্ষেত্রেও তেমনটা ঘটবে বলে পূর্বাভাষ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা৷ একটি হিসেব অনুযায়ী ২০১৫ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ইউরোপে এক্ষেত্রে ২৫ হাজার নতুন চাকরি হবে৷
ছবি: picture alliance/dpa/U. Zucchi
দুর্বল ব্যাটারি নিয়ে সমস্যা
ইলেকট্রিক গাড়ির অন্যতম সমস্যা ঘনঘন ব্যাটারি চার্জের প্রয়োজনীয়তা৷ তার উপর চার্জিং-স্টেশনের সংখ্যা এখনো কম৷ সেই নেটওয়ার্ক বাড়ালে ও ব্যাটারির দাম কিলোওয়াট-প্রতি ১০০ মার্কিন ডলারে নেমে এলে প্রচলিত গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে ইলেকট্রিক গাড়ি৷ ২০২০ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে এমনটা সম্ভব হবে বলে পূর্বাভাষ পাওয়া যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/K. Nietfeld
নিষেধাজ্ঞার পথ
ব্রিটেন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে দেশে ২০৪০ সাল থেকে কোনো নতুন পেট্রোল ও ডিজেলচালিত গাড়িকে ছাড়পত্র দেওয়া হবে না৷ ইউরোপে একের পর এক দেশ ও শহর এমন লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে চলেছে৷ বায়ুদূষণ কমাতে ও বিকল্প জ্বালানিচালিত গাড়ির উৎপাদনকে উৎসাহ দিতে এমন সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/S.Barbour
‘একলা চলো রে’ নীতির সমস্যা
ইউরোপের গাড়ি শিল্প পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত৷ তাই ব্রিটেনের মতো দেশ বা কিছু শহর বিচ্ছিন্নভাবে পেট্রোল-ডিজেল বর্জন করলে নির্গমনহীন গাড়ি তৈরির প্রয়াস উলটে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে ইউরোপীয় কমিশন৷ আমদানি-রপ্তানির ক্ষতি, যন্ত্রাংশ সরবরাহে বিঘ্নের ফলে বিকল্প জ্বালানির গাড়িতে বিনিয়োগ কমে যাবার আশঙ্কা রয়েছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/L. M. Mirgeler
চাপের মুখে গাড়ি শিল্প
জার্মানির দু’টি প্রধান গাড়ি কোম্পানি ‘ক্লিন ডিজেল’ প্রযুক্তিতে বিশাল বিনিয়োগ করেছে৷ কিন্তু ২০১৫ সালে অ্যামেরিকায় গাড়ির কার্বন নির্গমন পরীক্ষায় কারচুপি স্বীকার করে নেয় ফলক্সভাগেন কোম্পানি৷ আউডি, পর্শে সহ কোম্পানির এই অসৎ কাজ জার্মানির পরিবহণ কর্তৃপক্ষ ধরতে পারেনি৷ তাই জার্মান গাড়ি শিল্প ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চাপের মুখে পড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Gentsch
পরিবর্তনের শীর্ষে ভলভো
সুইডেনের ভলভো কোম্পানি জানিয়ে দিয়েছে, ২০১৯ সালের পর তারা আর কোনো পেট্রোল ও ডিজেলচালিত গাড়ি উৎপাদন করবে না৷ এই প্রথম কোনো বড় আকারের গাড়ি কোম্পানি এমন সাহসি পদক্ষেপ নিচ্ছে৷ উল্লেখ্য, সুইডেন ২০৪৫ সালের মধ্যে সব ধরনের গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বন্ধ করার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে৷