চীন ও দক্ষিণ এশিয়ার অনেক শহরে বায়ুদূষণ শুধু তাত্ত্বিক আলোচনার বিষয় নয়৷ দূষিত বায়ু যে কী, ভুক্তভোগীরা তা হাড়ে হাড়ে টের পান৷ পার্টিকুলেটস সহ নানা ক্ষতিকারক পদার্থ রোগ ও অকালমৃত্যুর কারণ হয়৷
বিজ্ঞাপন
বিশাল মেগাসিটির উপর ধোঁয়াশার চাদর ছেয়ে গেলে বায়ুদূষণের কারণে সতর্কতা জারি করা হয়৷ এমন বায়ু শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে ঢুকে মানুষকে অসুস্থ করে তোলে৷ গোটা বিশ্বে বায়ুদূষণের কারণে ৩০ লক্ষেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়৷ এর মধ্যে এশিয়ায় মৃতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি৷ বিশেষ করে চীন ও ভারতে পার্টিকুলেটস বা ক্ষতিকারক ধুলিকণার কারণে অসংখ্য মানুষ কষ্ট পাচ্ছে৷ মাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউট-এর কর্ণধার প্রো. ইয়োহানেস লেলিফেল্ড এ বিষয়ে বলেন, ‘‘প্রধানত ফুসফুসের রোগ হয়, তবে হৃদযন্ত্রের রোগও কম নয়৷ মানুষ শেষ পর্যন্ত হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের কারণে মারা যায়৷ পরিসংখ্যান তাই বলে৷ তবে কণা অতি ক্ষুদ্র হলে সেগুলি রক্তেও ঢুকে যেতে পারে৷ সেগুলি টক্সিক হওয়ায় ফুসফুসের মধ্যে টক্সিক পদার্থ ঢুকিয়ে দেয়৷ তখন তার কুপ্রভাব টের পাওয়া যায়৷''
পার্টিকুলেটস সরাসরি হৃদযন্ত্রের ক্ষতি করে৷ বায়ুদূষণের মোকাবিলা না করলে ২০৫০ সাল নাগাদ বছরে ৬০ লক্ষেরও বেশি মানুষ এই কারণে মারা যাবে৷
ইউরোপের বাতাসে দূষণ
ইউরোপের বাতাসে বায়ু দূষণের মাত্রা অনেকখানি কমেছে৷ তবে এখনো জার্মানিসহ সাতটি দেশে দূষণের পরিমাণ আইনগতভাবে নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে কিছুটা বেশি৷
ছবি: Getty Images
১২ থেকে ৮
২০১১ সালে ইউরোপের আটটি দেশে বায়ু দূষণের মাত্রা ইউরোপীয় পরিবেশ সংস্থা ইইএ-র বেঁধে দেয়া মাত্রার চেয়ে বেশি ছিল৷ তবে আগের বছর এমন দেশ ছিল ১২টি৷ ফলে বলা যায়, সার্বিকভাবে ইউরোপের বাতাস আগের তুলণায় বিশুদ্ধ হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
দূষণের কারণ
বিদ্যুত উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার এবং শিল্প কারখানা ও গাড়ি থেকে নির্গত ধোঁয়া বায়ু দূষণের প্রধান কারণ বলে জানিয়েছে ইউরোপীয় পরিবেশ সংস্থা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
‘শত্রু’ নাইট্রোজেন অক্সাইড
নির্গত নাইট্রোজেন অক্সাইডের ৪০ ভাগের জন্য দায়ী গাড়ি ও ট্রাক৷ ইইএ-র নির্বাহী পরিচালক বলছেন প্যারিস, মার্সেই, তুরিন, মিলান, রোমসহ চেক প্রজাতন্ত্র, পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়ার কয়েকটি শহর কর্তৃপক্ষকে নাইট্রোজেন অক্সাইড নির্গমন কমাতে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
অসুস্থতার কারণ
বায়ু দূষণের কারণে হৃদরোগ, শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে শিশু কিশোরদের ফুসফুসের সমস্যাসহ নানারকমের স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দিতে পারে৷
ছবি: Fotolia/uwimages
দূষণ কমানোর উদ্যোগ
২০১০ সালের চেয়ে ২০১১ সালে ডেনমার্ক, মাল্টা, সুইডেন আর নেদারল্যান্ডসের বাতাসে দূষণের পরিমাণ কমেছে৷ শহরের মধ্যে বড় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে, গতিসীমা কার্যকর করে এবং শহরের মধ্যে অধিবাসীদের বেশি করে সাইকেল চালাতে উৎসাহী করে নেদারল্যান্ডস সরকার বায়ু দূষণ কমানোয় সফলতা দেখিয়েছে৷
ছবি: DW
সেরা ডেনমার্ক
ইইএ-র মতে, বায়ু দূষণ কমানোয় সবচেয়ে বেশি সফলতা দেখিয়েছে ডেনমার্ক সরকার৷ এতে নেতৃত্ব দিয়েছেন সে দেশের জলবায়ু ও জ্বালানি মন্ত্রী (বামে) ও পরিবেশমন্ত্রী (ডানে)৷
ছবি: picture-alliance/dpa
দূষণ বেড়েছে জার্মানিতে
নানা পদক্ষেপ সত্ত্বেও ২০১১ সালে জার্মানিতে দূষণ বেড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ছোট পদক্ষেপ
দূষণ কমাতে দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগ প্রয়োজন হলেও ঘরে লিলি জাতীয় গাছ রেখে আপনিও দূষণ কমানোয় সহায়তা করতে পারেন৷
ছবি: picture alliance/dpa
8 ছবি1 | 8
জার্মানির মাইনৎস শহরে মাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের হিসেব অনুযায়ী এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে চলেছে৷ ঠিক কত সংখ্যক মানুষ বাতাসে পার্টিকুলেটস, ওজোন এবং নাইট্রোজেন অক্সাইডের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান, ইয়োহানেস লেলিফেল্ড-এর নেতৃত্বে এক টিম তা খতিয়ে দেখেছে৷ প্রো. লেলিফেল্ড বলেন, ‘‘যারা পার্টিকুলেটস ও বায়ুদূষণের শিকার হন, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই এশিয়ায় থাকেন৷ তার একটা কারণ অবশ্যই দূষিত বায়ু৷ তাছাড়া বড় বড় ঘনবসতিপূর্ণ শহরে দীর্ঘ সময় ধরে অনেক মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসে পার্টিকুলেটস ঢুকছে৷ ফলে রোগব্যাধি ও অকালমৃত্যুও বাড়ছে৷ শুধু চীনেই বছরে প্রায় ১৪ লক্ষ মানুষের অকালমৃত্যু ঘটছে৷ ভারতে সংখ্যাটা প্রায় ৭ লক্ষ৷ সংখ্যাটা সত্যি খুব বেশি৷''
নিজস্ব পরিমাপের পাশাপাশি স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া জলবায়ু সংক্রান্ত তথ্যের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা এই বিশ্লেষণ করেছেন৷ এই সব তথ্য সমন্বয় করে তাঁরা একদিকে সারা পৃথিবীতে ক্ষতিকারক পদার্থের বণ্টন, অন্যদিকে মৃত্যুর হার তুলনা করে এক কম্পিউটার সিমুলেশন সৃষ্টি করেছেন৷ তাতে দেখা যাচ্ছে, বিশেষ ক্ষতিকারক পদার্থের মিশ্রণের কারণে মানুষ সত্যি মারা যাচ্ছে৷
তবে গবেষকরা সবচেয়ে অবাক হয়েছেন এটা জানতে পেরে, যে শহরাঞ্চলে পরিবহণ ও শিল্পক্ষেত্রে ধোঁয়া বায়ুদূষণের মূল কারণ নয়৷ প্রো. ইয়োহানেস লেলিফেল্ড বলেন, ‘‘এশিয়ায় রান্নাবান্না ও ঘর গরম করার জন্য ছোট করে আগুন জ্বালানো হয়৷ ফলে অনেক ধোঁয়া বের হয়৷ অনেক মানুষ এমন আগুন জ্বালালে ধোঁয়ার পরিমাণও বেশি হয়৷ বিশেষ করে ভারত, বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ এশিয়ায় এমন আগুন বায়ুদূষণের প্রধান কারণ৷''
ঢাকায় বায়ু দূষণে মরছে বছরে ১৫ হাজার মানুষ
প্রায়ই ঢাকা শহরের উপরে ভেসে বেড়ায় কুয়াশা ও ধোঁয়ার মিশ্রণ বা স্মগ৷ আর শুধু বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর মারা যায় শহরটির ১৫ হাজার মানুষ৷ তবে শুধু ঢাকা নয়, আরো অনেক শহরের অবস্থা এমন৷ দেখুন এখানে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
উলান বাটর, মঙ্গোলিয়া
উলান বাটর শুধুমাত্র বিশ্বের সবচেয়ে ঠান্ডা রাজধানী নয়, এটি চরম বায়ু দূষণের শিকারও৷ শীতের মাসগুলোতে টেসিগি-র তাঁবুগুলো গরম রাখতে কয়লা এবং কাঠ ব্যবহার করা হয়, যা শহরের সত্তর শতাংশ স্মোগের কারণ৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত নিরাপদ সীমার চেয়ে সাতগুন বেশি দূষিত উলান বাটরের বাতাস৷
ছবি: DW/Robert Richter
বেইজিং, চীন
চীনের রাজধানী স্মগে এতই ক্ষতিগ্রস্ত যে বিজ্ঞানীদের মতে, শহরটি বসবাসের প্রায় অনুপযোগী৷ তাসত্ত্বেও দুই কোটি মানুষ বাস করে সেখানে৷ ধারণা করা হয়, বিশ্বে প্রতিবছর ৩৫ লাখ মানুষ বায়ু দূষণের কারণে মারা যায়, যাদের মধ্যে অর্ধেকই চীনের বাসিন্দা৷
ছবি: picture alliance/Photoshot
লাহোর, পাকিস্তান
পরিবেশ নিয়ে পাকিস্তানের উদ্বেগগুলোর মধ্যে অন্যতম বায়ু দূষণ৷ দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর করাচির অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়৷ শহরটিতে স্মগের মূল কারণগুলো হচ্ছে রাস্তায় অনেক যান চলাচল, ময়লা পোড়ানো এবং আশেপাশের মরুভূমি থেকে আসা ধূলিকণা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নতুন দিল্লি, ভারত
ভারতের রাজধানী নতুন দিল্লিতে কারের সংখ্যা গত ৩০ বছরে এক লাখ ৮০ হাজার থেকে ৩৫ লাখে পৌঁছেছে৷ তাসত্ত্বেও অবশ্য সেখানে স্মগের সবচেয়ে বড় কারণ কয়লাচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র৷ শহরের দূষিত বায়ুর ৮০ শতাংশের উৎসই এগুলো৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রিয়াদ, সৌদি আরব
রিয়াদে ধুলিঝড় স্মগ সৃষ্টির অন্যতম কারণ৷ কেননা এটি বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ অনেক বাড়িয়ে দেয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
কায়রো, মিশর
কায়রোর দূষিত বাতাস শহরের বাসিন্দাদের অনেক রোগের কারণ৷ বায়ু দূষণের কারণে শ্বাসযন্ত্রের নানাবিধ সমস্যাসহ ফুসফুসে ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে৷ শিল্প উন্নয়ন এবং রাস্তায় যানবাহনের বাড়তি উপস্থিতি দূষণের কারণ৷
ছবি: DW Akademie/J. Rahe
ঢাকা, বাংলাদেশ
জার্মানির মাইনৎস শহরের ম্যাক্স-প্লান্ক ইন্সটিটিউট-এর এক গবেষণা অনুযায়ী, বায়ু দূষণের কারণে ঢাকায় বছরে মারা যায় ১৫ হাজার মানুষ৷ গবেষকরা ঢাকার বাতাসে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সালফার ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতি শনাক্ত করেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মস্কো, রাশিয়া
বাহ্যিকভাবে একই মনে হলে শহর ভেদে স্মগের ধরন আলাদা৷ যেমন মস্কোর বাতাসে হাইড্রোকার্বনের উপস্থিতি অনেক বেশি৷ আর এই দূষণের মধ্যে শহরের পশ্চিমাঞ্চলের বাতাস তুলনামূলকভাবে ভালো৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মেক্সিকো সিটি, মেক্সিকো
ভৌগোলিক কারণে মেক্সিকো সিটির স্মগ বিপজ্জনক৷ বাতাসে সালিফার ডাই-অক্সাইড এবং হাইড্রোকার্বনের উপস্থিতির কারণে দীর্ঘসময় শহরটিকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল৷ কিছু ফ্যাক্টরি বন্ধ করায় এবং যান চলাচল নীতিতে পরিবর্তনের কারণে পরিস্থিতি এখন আগের চেয়ে ভালো হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
9 ছবি1 | 9
এশিয়ার বাতাসে পার্টিকুলেটস-এর মূল উৎস এমন আগুন৷ ডিজেল জেনারেটর, কয়লার ছোট চুলা এবং জ্বলন্ত কাঠ থেকে অতি ক্ষুদ্র কণা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে৷ চীনে পার্টিকুলেটস-এর এক-তৃতীয়াংশ আসে এই উৎস থেকে৷ ইন্দোনেশিয়া ও ভারতের ক্ষেত্রে সেই মাত্রা ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ৷
বিস্ময়কর মনে হলেও গোটা বিশ্বে পার্টিকুলেটস-এর দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস হলো কৃষিক্ষেত্র৷ ইউরোপ, জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার ও বড় আকারে পশুপালনের ফলে বিশাল পরিমাণ অ্যামোনিয়া সৃষ্টি হয় এবং বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে৷ পার্টিকুলেটস আদৌ সৃষ্টি হবার পেছনে অ্যামোনিয়ার বিশেষ অবদান রয়েছে৷
অর্থাৎ শিল্প ও পরিবহণ ক্ষেত্র মূল অভিযুক্ত নয়৷ তাই এই সমস্যার মোকাবিলা করতে নতুন কৌশলের প্রয়োজন৷ প্রো. লেলিফেল্ড বলেন, ‘‘ইউরোপে কৃষিক্ষেত্রে কার্বন নির্গমন কমানোর চেষ্টা করতে হবে৷ বড় আকারে গবাদি পশুপালনের বিষয়ে কিছু একটা করতে হবে৷ অন্যদিকে এশিয়ায় মানুষের নাগালে এমন প্রযুক্তি পৌঁছে দিতে হবে, যাতে তারা ধোঁয়া ছাড়াই রান্না এবং ঘর গরম রাখতে পারে৷ এমন প্রযুক্তি রয়েছে এবং তা মোটেই দামি নয়৷''
এই কাজে সফল না হলে ২০৫০ সালে গোটা বিশ্বে বায়ুদূষণের ফলে ৬০ লক্ষেরও বেশি মানুষের অকালমৃত্যু ঘটবে৷ শুধু এশিয়ায় ৪০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে৷