বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির স্থায়ী কমিটির তিন নেতাসহ পাঁচ জনকে গ্রেফতারের পর শনিবার কারাগারে পাঠানো হয়েছে৷ আদালত তাদের জামিনের আবেদন না মঞ্জুর করে বৃহস্পতিবার রিমান্ড আবেদনের ওপর শুনানির দিন ধার্য করেছেন৷
বিজ্ঞাপন
গ্রেপ্তারকৃত শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে হরতালে নাশকতার ষড়যন্ত্র এবং উস্কানির অভিযোগ আনা হয়েছে৷ তাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে রবিবার থেকে ডাকা বিএনপির টানা তিন দিনের হরতাল বাড়িয়ে চার দিন করা হয়েছে৷ আর আওয়ামী লীগ নেতারা বলেছেন, সহিংসতাকারীরা যত বড় নেতাই হোন না কেন তাদের আইনের আওতায় আনা হবে৷
প্রসঙ্গত, শুক্রবার রাতে গোয়েন্দা পুলিশ প্রথমে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, এম কে আনোয়ার এবং ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়াকে আটক করে৷ এরপর গভীর রাতে আটক করা হয় বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুল আউয়াল মিন্টু এবং বিশেষ সহকারি শিমুল বিশ্বাসকে৷ এই পাঁচ জনকে রাজধানীর মতিঝিল থানার দু'টি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে৷ গোয়েন্দা বিভাগের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান ডয়চে ভেলেকে জানান, তাদের বিরুদ্ধে হারতালে গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নি সংযোগ এবং নাশকতার অভিযোগ আনা হয়েছে৷ গত পাঁচই নভেম্বর মামলা দু'টি দায়ের করা হয়৷
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট থামছে না
আগামী বছরের সূচনায় জাতীয় নির্বাচন, কিন্তু দুই মুখ্য রাজনৈতিক জোটের টানাপোড়েন অব্যাহত৷ অথচ দেশে-বিদেশে অনেকেই চান সংকট নিরসনে দুই বৈরী জোটের মধ্যে আলোচনা৷ কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব হবে?
ছবি: AP
দু’দলের দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নির্দিষ্ট হয়েছে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে৷ তবে মুখ্য বিরোধী দল বিএনপি এখনো নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি নয়৷ তারা চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, শাসক আওয়ামী লীগের কাছে যা সংবিধান লঙ্ঘনের সমান৷
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
জাতিসংঘ চায় সংলাপ
জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই দুই বিবাদী জোটের মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে৷ মহাসচিব বান কি-মুন গত ২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা বলেছেন৷ জাতিসংঘের মহাসচিব উভয় নেতার প্রতি চলতি রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ অবসানের জন্য আলাপ-আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
হাসিনা চান সংসদে আলোচনা
জাতিসংঘ বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মহাসচিবের ফোনালাপের কোনো খুঁটিনাটি প্রকাশ করেনি৷ তবে বাংলাদেশের একাধিক দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী হাসিনা ‘‘জাতিসংঘের প্রধানকে জানিয়েছেন যে, তিনি সংবিধান অনুযায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করছেন৷’’ বিরোধীপক্ষ যদি গোটা প্রসঙ্গটি সংসদে আলোচনা করার কোনো প্রস্তাব দেয়, তবে তিনি তাকে স্বাগত জানাবেন, এমন আভাসও দিয়েছেন হাসিনা৷
ছবি: dapd
সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে বিএনপির ‘না’
বান কি-মুনের সঙ্গে ফোনালাপে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াও সংকট সমাধানে সংলাপের সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন, কিন্তু এ-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ‘‘বিরোধীপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না৷’’
ছবি: Reuters
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি ও কেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল কাজ হলো মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা৷ ১৯৯১ সালে এই পদ্ধতি চালু করা হয় কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেই পদ্ধতি বাতিল করে৷ বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছে৷
ছবি: AP
জার্মানি সংলাপ সমর্থন করে
সংলাপকে বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক জোটের মধ্যে অচলাবস্থা নিরসনের একমাত্র পন্থা বলে মনে করে জার্মানি৷ ‘ঢাকা কুরিয়ার’ নামক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. আলব্রেশট কনৎসে বলেছেন, ‘‘দু’টি মুখ্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ হলো বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানের একমাত্র পথ৷’’
ছবি: DW/R. Manzoor
ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ডাক দিলেন
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস একটি ‘‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ (নির্বাচনকালীন) সরকার’’ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করেছেন৷ গত ২২ আগস্ট ইউনূস একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘নির্বাচন অতি অবশ্য হওয়া উচিত এবং তা একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়া উচিত৷’’
ছবি: Getty Images
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)
হাসিনা সরকারের সৃষ্ট আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি-র উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার৷ কিন্তু তা শাসকদল এবং বিরোধীপক্ষের মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আইসিটি এখন পর্যন্ত ছ’জন অভিযুক্তকে শাস্তি দিয়েছে৷ বিরোধীপক্ষ এই বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত আখ্যা দিয়েছে৷ তাদের মতে এই প্রক্রিয়ার বাস্তবিক উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার নয়, পুরাতন শত্রুতার প্রতিশোধ৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক সমালোচনা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচও আইসিটি-র সমালোচনা করেছে৷ এইচআরডাব্লিউ বিবৃতিতে বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া ‘‘গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ’’ ছিল৷ প্রতিক্রিয়া হিসেব সরকারি কৌঁসুলির তরফ থেকে এইচআরডাব্লিউ-এর বিরুদ্ধে আদালতের অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে৷ ইতিমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এইচআরডাব্লিউ-এর ‘‘একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’’ রয়েছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
ট্র্যাক রেকর্ড
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা কৃষি খাতে সরকারের সাফল্যের খতিয়ান যাই হোক না কেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর হাসিনা সরকারের অন্য সব সাফল্য ঐ একটি কেলেঙ্কারির আড়ালে ধামাচাপা পড়ে গেছে৷ আগামী নির্বাচনেও পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রসঙ্গটি প্রভাব ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
বিএনপির এই পাঁচ নেতাকে শনিবার বিকেলে আদালতে হাজির করে দুই মামলায় প্রত্যেকের ২০ দিন করে রিমান্ডের আবেদন জানায় পুলিশ৷ আদালত জামিনের আবেদন নাকচ করে বৃহস্পতিবার রিমান্ড আবেদনের শুনানির দিন ধার্য করে তাদের কারাগারে পঠিয়েছেন৷
শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেপ্তারের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, সরকারের পতনের শেষ সাইরেন বেজে উঠেছে৷ তিনি বলেন, ‘‘গ্রেফতার আর নির্যাতন চালিয়ে আন্দোলন বন্ধ করা যাবেনা৷'' তাই তিনি ৭২ ঘণ্টার হরতাল বাড়িয়ে ৮৪ ঘণ্টার কথা জানান৷ রিজভী অভিযোগ করেছেন সারা দেশেই ব্যাপক ধরপাকড় চালানো হচ্ছে৷ তিনি নিজেও পুলিশের হুমকির মুখে রয়েছেন৷
এদিকে, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব আলম হানিফ বলেছেন, ‘‘সহিংসতাকারী হলে তিনি যত বড় নেতাই হোন না কেন তাকে আইনের আওতায় আনা হবে৷ যাদের নির্দেশে দেশের এবং সাধারণ মানুষের সম্পদের ক্ষতি হয়, সাধারণ মানুষের প্রাণ যায় তারা আইনের উর্ধ্বে থাকতে পারেন না৷
আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, ‘‘বিএনপির পাঁচ নেতাকে আটক করতে সরকার বাধ্য হয়েছে৷ তারা দাবি আদায়ের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছেন৷ তাদের ডাকা অবৈধ হারতাল প্রতিরোধে সাধারণ মানুষকে নিয়ে আওয়ামী লীগ মাঠে থাকবে৷''
তবে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, ‘‘কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া বিরোধী দলের নেতাদের গ্রেফতার করা মানবাধিকারের লঙ্ঘন৷ বিরোধী দলের অনুসারী হলেই সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করা যায়না৷''
সর্বশেষ পাওয়া খবরে জানা গেছে, বিএনপির পাঁচ নেতাকে গ্রেফতারের পর রাজধানীতে পুলিশের ব্যাপক তল্লাশী অভিযান চলছে৷ অভিযানের মুখে বিএনপির অধিকাংশ সিনিয়র নেতা আত্মগোপনে চলে গেছেন৷ তবে তাদের গ্রেফতারে প্রতিবাদে রাজধানীতে বাসে আগুন এবং নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জ ও কবির হাটে স্থানীয় বিএনপির ডাকে শনিবার হরতাল পালিত হয়েছে৷
সংবাদ মাধ্যমে পঠানো এক বিবৃতিতে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘‘যেকোন মূল্যে একতরফা নির্বাচন রুখে দেয়া হবে৷'' তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘সরকার একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে একদলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র করছে৷''