একদিনে দুটি মামলায় খালাস পেয়েছেন বিএনপির চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া৷ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় তার দণ্ড আগেই স্থগিত করা হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
এর আগে ৩০ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে নাশকতা ও রাষ্ট্রদ্রোহের ১১টি মামলার কার্যক্রম বাতিল হয়।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানও একই দিনে দুটি মামলা থেকে অব্যাহতি পান।
বুধবার জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বিশেষ আদালতের দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার আপিল মঞ্জুর করেছেন হাইকোর্ট।এই মামলায় ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর রায়ে বিশেষ আদালত খালেদা জিয়াকে সাত বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেন । একই বছরের ১৮ নভেম্বর রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন খালেদা জিয়া। হাইকোর্টের বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বুধবার খালেদা জিয়ার আপিল গ্রহণ করে রায় দেন। ফলে এই মামলা থেকে খালাস পেলেন তিনি।
অন্যদিকে বুধবারই বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি মামলায় বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া, স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন এবং ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরীকে অভিযোগ গঠন পর্যায়ে খালাস দিয়েছেন আদালত। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-২-এর বিচারক আবু তাহের এই রায় দেন। তবে চারজনের বিরুদ্ধে আদালত অভিযোগ গঠন করেছেন। তারা হলেন: জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব নজরুল ইসলাম, পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান এস আর ওসমানী, সাবেক পরিচালক মঈনুল আহসান, এবং বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম ও খনির কাজ পাওয়া কোম্পানির স্থানীয় এজেন্ট হোসাফ গ্রুপের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন।
মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামিদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী এম সাইফুর রহমান, আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া, এমকে আনোয়ার, এম শামসুল ইসলাম, ব্যারিস্টার আমিনুল হক ও সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন মারা গেছেন। যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াতের দুই শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। তাই এ মামলা থেকে তাদের আগেই অব্যাহতি দেয়া হয়।
বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির কয়লা উত্তোলন, ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষনে ঠিকাদার নিয়োগে অনিয়ম এবং রাষ্ট্রের ১৫৮ কোটি ৭১ লাখ টাকার ক্ষতি ও আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ থানায় মামলাটি করা হয়। ওই বছরের ৫ অক্টোবর চার্জশিট দাখিল করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
কী হচ্ছে আদালত পাড়ায়?
অন্তর্বর্তী সরকারে সময়ে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের পক্ষে আদালতে দাঁড়াতে গিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন আইনজীবীরা৷ ছাত্রদের দাবির মুখে ১২ বিচারপতিকে বিচারকাজ থেকে বিরত রাখার মতো ঘটনাও ঘটেছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘মারধরের শিকার হয়েছি’
আইনজীবী মোশারফ হোসেন শাহীন বলেন, ‘‘গত আড়াই মাসে যাদের গ্রেপ্তার করে আদালতে নেওয়া হয়েছে, তাদের সবাইকে অপদস্থ করা হয়েছে৷ যারা ডিফেন্স করতে যাচ্ছেন, তাদের উপরও হামলা করা হচ্ছে৷ আক্রমণ করা হচ্ছে৷ এই ধরনের কাজের মাধ্যমে বাইরে খারাপ বার্তা যাচ্ছে৷ আমি নিজেও ডিফেন্স করতে গিয়ে মরধরের শিকার হয়েছি৷ আশা করবো, সবাই যেন সহকর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকেন৷’’
ছবি: Privat
‘আসামি পক্ষের কোনো আইনজীবীই আদালতে যেতে পারছেন না’
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সাইদ আহমেদ রাজা বলেন, ‘‘ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বাদী ও আসামি দুই পক্ষেই আইনজীবী থাকতে হয়৷ কিন্তু বর্তমান সরকারের সময় আসামি পক্ষকে আইনজীবী রাখার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না৷ প্রত্যেক আসামির আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকে৷ সেই সুযোগও পাচ্ছেন না তারা৷ আমি নিজেও কোনো মক্কেলের পক্ষে দাঁড়াতে পারছি না৷ শুধু আমি নই, আসামি পক্ষের কোনো আইনজীবীই আদালতে যেতে পারছেন না৷
ছবি: Privat
‘আসামির পক্ষে আইনজীবীর অধিকার নিশ্চিত করা হচ্ছে না’
সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলেন, ‘‘আসামির পক্ষে আইনজীবীর দাঁড়াতে পারাটা অধিকার, সেটাই নিশ্চিত করা হচ্ছে না৷ সবাই নাগরিক কিনা সেটাই এখন প্রশ্ন৷ একটা পক্ষ বলতে চাচ্ছে, আরেকপক্ষ এদেশের নাগরিকই না৷ আমরা আগের পথেই চলে গেছি কিনা সেটাও ভাববার বিষয়৷ একটাই পার্থক্য শুধু পুলিশ গুলি করছে না৷ দেশে সরকার দুইটা কিনা সেটাও প্রশ্ন! ছাত্ররাও সিদ্ধান্ত দিচ্ছে, আবার যারা শপথ নিয়েছেন (উপদেষ্টারা) তারাও চালাচ্ছেন৷’’
ছবি: DW
‘এভাবে চললে অভিযুক্তরা ন্যায় বিচার-বঞ্চিত হবেন’
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আহসানুল করিম বলেন, ‘‘সংবিধানে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে আইনজীবী নিযুক্ত করার কথা বলা হয়েছে৷ এখন যারা ডিফেন্স করতে যাবেন, তারা তো ভয়ের মধ্যে আছেন৷ প্রধান বিচারপতি বারবার বলছেন, অভিযুক্তকে আইনজীবী প্রাপ্তির সুযোগ দিতে৷ কিন্তু আইনজীবীরা মারধরের শিকার হচ্ছেন৷ অভিযুক্তরা নিজের কথাও বলতে পারছেন না৷ কোর্টও ভয়ের শিকার হন৷ এভাবে চললে অভিযুক্তরা ন্যায় বিচার-বঞ্চিত হবেন৷’’
ছবি: Privat
‘এই বিচারব্যবস্থার জন্য তো তারা জীবন দেননি’
ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন, ‘‘আমাদের বিচারব্যবস্থা সামনের দিকে এগোচ্ছে কিনা সেই প্রশ্ন করলে আমি বলবো- ‘না’৷ বিগত সরকারের সময়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগ যেটা করেছে, আমরা তো সেটা চাই না৷ আজকের যে বাংলাদেশ, সেটার জন্য কিন্তু যাদের অবদান, তাদের অনেকে কবরে শুয়ে আছে৷ অনেকে অন্ধ হয়ে হাসপাতালের বিছানায়৷ আমার কাছে একজন এসেছেন, যিনি ৪০ বছর ধরে বিচারের জন্য আদালতে ঘুরছেন৷ এই বিচারব্যবস্থার জন্য তো তারা জীবন দেননি৷’’
ছবি: Privat
‘ছাত্ররা আদালতে মিছিল না করে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করলেই ভালো হতো’
আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি তারিক উল হাকিম বলেন, ‘‘ছাত্ররা যেভাবে আদালতের ভেতরে এসে মিছিল করে দাবি জানিয়েছে, সেটা না করে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করলেই ভালো হতো৷ তারপর দাবি পূরণ না হলে আন্দোলন করতে পারতো৷ বিগত সরকারের সময়ের চেয়ে এখন কোনো পার্থক্য দেখা যাচ্ছে কিনা সেটা বুঝতে হলে আমাদের আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে৷’’
ছবি: Privat
‘আদালতের তো নিজস্ব কোনো বাহিনী নেই যে, তারা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে’
অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ ড. শাহজাহান সাজু বলেন, ‘‘কোন বিচারককে বেঞ্চ দেবেন আর কোন বিচারককে বেঞ্চ দেবেন না সেটা প্রধান বিচারপতির এখতিয়ার৷ ছাত্ররা যেভাবে উচ্চ আদালতের ভেতরে এসে মিছিল করলো, সেখানে পুলিশ তো বাধা দিলো না৷ এখন আদালতেরও তো নিজস্ব কোনো বাহিনী নেই যে, তারা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে৷ ফলে তাদের আন্দোলনের কারণেই ভয়ে বা চাপে পড়ে প্রধান বিচারপতি এটা করেছেন সে কথা তো আপনি বলতে পারবেন না৷
ছবি: Privat
‘প্রথম দিকে কিছুটা সমস্যা হলেও এখন আসামী পক্ষের আইনজীবীদের দাঁড়াতে সমস্যা হচ্ছে না’
সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এম বদরুদ্দোজা বাদল বলেন, ‘‘ছাত্রদের দাবির মুখে কয়েকজন বিচারককে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে, এমন নয়৷ আমরা আইনজীবীরাও তাদের অপসারণের দাবিতে আন্দোলন করেছি৷ আমাদের কাছে তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট প্রমানও আছে৷ সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে প্রধান বিচারপতি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ প্রথম দিকে কিছুটা সমস্যা হলেও এখন কিন্তু আসামী পক্ষের আইনজীবীদের দাঁড়াতে সমস্যা হচ্ছে না৷
ছবি: Privat
8 ছবি1 | 8
এর আগে ১১ নভেম্বর জিয়া অরফানজে ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার দণ্ড স্থগিত করেছেন হাইকোর্টের আপিল বিভাগ । আপিল এখন শুনানির অপেক্ষায় আছে। এই মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিশেষ জজ আদালত খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেন। রায়ের বিরুদ্ধে একই বছর হাইকোর্টে আপিল করেন খালেদা জিয়া। আপিলের ওপর শুনানি শেষে ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর হাইকোর্ট রায়ে খালেদা জিয়ার সাজা বাড়িয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড করেন। হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ২০১৯ সালে আপিল বিভাগে পৃথক লিভ টু আপিল করেন খালেদা জিয়া।
আর ৩০ অক্টোবর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের একটি, নাশকতার অভিযোগে করা ১০টিসহ ১১টি মামলার কার্যক্রম বাতিল ঘোষণা করেন হাইকোর্ট।
মামলার কার্যক্রম বাতিল চেয়ে খালেদা জিয়ার করা পৃথক ১১টি আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ বাতিলের ওই রায় দেয়। ১১টি মামলার মধ্যে রাজধানীর দারুস সালাম থানার সাতটি, যাত্রাবাড়ী থানার চারটি মামলাও রয়েছে। এসব মামলায় খালেদা জিয়া জামিনে ছিলেন।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বুধবার কর ফাঁকি ও চাঁদাবাজির দুইটি মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। চাঁদাবাজির মামলায় অব্যাহতি পাওয়া অন্যরা হলেন, তারেক রহমানের বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুন, ওবায়দুল্লা খন্দকার, কামরুজ্জামান, ইঞ্জিনিয়ার মাহবুবুল আলম, ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম শোয়েব বাশুরী ওরফে হাবলু, আজিজুল করিম তারেক ও মনিজুর রহমান ওরফে মানিক। চাঁদাবাজির অভিযোগে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কোম্পানি আব্দুল মোনেম লিমিটেডের মহা-ব্যবস্থাপক খায়রুল বাশার ২০০৭ সালের ৯ এপ্রিল বাদী হয়ে রাজধানীর শাহবাগ থানায় এ মামলা করেন। অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. ছানাউল্ল্যাহ তাদের অব্যাহতি দেন।
দেশের মানুষ জানে এই মামলাগুলো মিথ্যা: ব্যারিস্টার কায়সার কামাল
অন্যদিকে ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালে ২৬ লাখ টাকার কর ফাঁকির অভিযোগে তারেক রহমানের নামে একটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সেই মামলায় তাকে খালাস দেন বিশেষ জজ আদালত ১০-এর বিচারক মো. রেজাউল করিম।
২৪ নভেম্বর তারেক রহমান ২০১৫ সালে গাজীপুরে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা একটি বিস্ফোরক মামলা থেকে ২৪ নভেম্বর অব্যাহতি পান। গাজীপুরের আদালতে দায়ের করা আরেকটি মানহানির মামলা থেকেও তাকে ওইদিন অব্যাহতি দেয়া হয়। ৩১ অক্টোবর তিনি ময়নসিংহের আদালত থেকে দুটি মানহানির মামলায় অব্যাহতি পান। ১ নভেম্বর তিনি হাইকোর্টে একটি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা থেকে অব্যাহতি পান। ২২ সেপ্টেম্বর তিনি ঢাকার সাইবার ট্রাাইবুনাল থেকে ২০২১ সালে দায়ের হওয়া সাইবার অপরাধের একটি মামলা থেকে অব্যাহতি পান।
তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহসহ বিভিন্ন অভিযোগে ৮০টি মামলা আছে। ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং পরবর্তী সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এসব মামলা হয়। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, অর্থ পাচার, মানহানিসহ পাঁচ মামলায় সাজা হয়েছে তারেক জিয়ার। দেশে না থাকায় পলাতক দেখিয়ে মামলাগুলোর বিচার সম্পন্ন করেছে বিভিন্ন আদালত।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে পাঁচটি দুর্নীতির অভিযোগসহ মোট মামলা ৩১টি। এর মধ্যে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় পাঁচ বছরের সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয় তাকে। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ তাকে হাসিনা সরকার সাজা বহাল রেখে নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেয়। ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর তার সাজা স্থগিত করে পুরোপুরি মুক্তি দেয়া হয়।
মামলার জাল থেকে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বেরিয়ে আসার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তার কি কোনো রাজনৈতিক প্রভাব আছে? অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নে কি তা কোনো প্রভাব ফেলবে? বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিকল্পনায় কি কোনো ভূমিকা রাখবে?
খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার মামলা থেকে অব্যহতিতে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে স্বস্তি আছে।কিন্তু এখনো তারা নিশ্চিত নন সব মামলা শেষ হতে কত সময় লাগবে। আর টু মাইনাস থিওরি নিয়ে যে আতঙ্ক ছিল তা-ও কাটতে শুরু করেছে। তারা অপেক্ষা করছেন তারেক রহমানের দেশে ফেরার। কিন্তু মামলা থেকে অব্যাহতি বা খালাসের সঙ্গে রাজনীতি মেলাতে চাননা বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল। তিনি বলেন," আমরা আগেও বলেছিলাম যে মামলাগুলো আমরা আইনগতভাবে মোকাবেলা করব। এখন তাই করছি। এখন বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে শুরু করেছে। আগের ফ্যাসিবাদী সরকার মিথ্যা মামলা দিয়েছিলো। খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠিয়েছিলো। আমরা কোনো সরকারের কোনো সহানুভূতি নয়, আইনগত লাড়াই করেই ন্যায় বিচার পাচ্ছি।”
অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপির আস্থার সম্পর্ক বাড়াবে: ড. জাহেদ উর রহমান
তার কথা, "দেশের মানুষই বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও নেতৃত্ব নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। এর সঙ্গে মামলার কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ, দেশের মানুষ জানে এই মামলাগুলো মিথ্যা। আর তারেক রহমান সাহেবের দেশে ফেরা মামলা থাকা বা না থাকার ওপর নির্ভর করে না। দেশের মানুষের আশা, দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রত্যাশা অনুযায়ী তিনি দেশে ফিরে আসবেন।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ভিাগের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন," আসলে রাজনীতিতে রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা কোনো সংকট নয়। বরং নেতাদের বিরুদ্ধে রজনৈতিক মামলা হলে, কারাগারে গেলে তারা আরো জনপ্রিয় হন। সেটা তো এখন আমরা দেখতেই পারছি।”
"আর রাজনৈতিক মামলা সব সময়ই গোলমেলে। যারা সরকারে থাকে, তারা বিরোধীদের বিরুদ্ধে মামলা করে। ফলে এই মামলাগুলো সব সময়ই প্রশ্নের মুখে পড়ে। তবে আমরা মনে করি, আদালতের রায়ের সাথে রাজনীতি নির্ভরশীল নয়,” বলেন তিনি।
তবে আরেকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. জাহেদ উর রহমান মনে করেন, "খালেদা জিয়া খালাস পাচ্ছেন, তারেক রহমানও পাচ্ছেন- এগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপির আস্থার সম্পর্ক বাড়াবে। দেশের মানুষের পারসেপশন আছে যে, ওই মামলাগুলো রাজনৈতিক হয়রানিমূলক। সেই মামলা থেকে এখন তারা রেহাই পাচ্ছেন। এতে বিএনপির নেতা-কর্মীরা যেমন খুশি, দেশের সাধারণ মানুষও খুশি। বর্তমান সরকার দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই কাজ করতে চায়। আমরা মনে হয় সেই সম্পর্ক আরো ভালো হবে।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, " তারেক রহমান দেশের বাইরে আছেন। এখন তারা দেশে ফেরার পথ সহজ হয়ে যাচ্ছে। ফলে বিএনপির রাজনৈতিক পরিকল্পনা ও ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্যও এটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশা ও চ্যালেঞ্জ
নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশা ও সরকারের কিছু চ্যালেঞ্জ নিয়ে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছে ডিডাব্লিউ৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP
সিফাত নাহার, চিকিৎসক
স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে ওষুধের অপ্রতুলতা, পর্যাপ্ত সরঞ্জামের অভাব, লোকবলের অভাবসহ আরো অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে৷ এসব কারণে আমরা প্রায়ই প্রতিকূলতার সম্মুখীন হই৷ মাঝেমধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়৷ তাই আমার প্রত্যাশা থাকবে, এই সরকার কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকসহ সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করার চেষ্টা করবে৷
ছবি: DW
দীপংকর সরকার দীপু, ভিজুয়াল আর্টিস্ট
বেশিরভাগ মানুষের আস্থা অর্জন, জানমালের নিরাপত্তা বিধান, দুর্নীতিকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা, সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা- ইত্যাদি সরকারের চ্যালেঞ্জ৷ আর সরকারের কাছে প্রত্যাশা থাকবে তারা যেন দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে আনতে পারেন, দুর্নীতি নির্মূল করতে পারেন, মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারেন ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে পারেন৷
ছবি: DW
সাদিয়া মরিয়ম রূপা, আলোকচিত্রী ও শিক্ষক
প্রত্যাশা: পাহাড় থেকে সেনাশাসন হটাতে হবে, পাহাড় দখলমুক্ত করতে হবে৷ ক্ষমতাধর ও আইনপ্রণেতাদের জনগণের কাছে জবাবদিহিতা থাকতে হবে৷ বাকস্বাধীনতা খর্ব করা যাবে না৷ বিচারব্যবস্থাকে স্বাধীন করতে হবে৷ জনস্বার্থবিরোধী সব চুক্তি বাতিল করতে হবে৷
ছবি: DW
আলী আরাফাত জাকারিয়া, লেখক
প্রত্যাশা: রাষ্ট্র সংস্কার, বিশেষ করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার, আইন-শৃঙ্খলা ঠিক করা, পুলিশকে দলীয় রাজনীতি থেকে দূরে রাখা, দুর্নীতি দমন ও ছাত্র হত্যার বিচার করা, আর্থিকখাতে দুর্নীতি করা ব্যক্তিদের বিচার এবং সর্বোপরি নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখা৷ চ্যালেঞ্জ: অর্থনীতি ঠিক করা, সতর্কতার সাথে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে পুলিশ রিফর্ম করা৷
ছবি: DW
ফারহানা শারমিন শুচি, উদ্যোক্তা
স্বচ্ছ সরকার চাই৷ রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ছিল, সেগুলো নির্মূল করতে হবে৷ দীর্ঘদিন ধরে অন্যায়, অবিচার দেখেছি৷ এগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে৷ দুর্নীতিবাজদের সরিয়ে তরুণ প্রজন্মকে নিয়োগ দিতে হবে৷ দুর্নীতি দূর করতে শিক্ষার্থীদের মনিটরিং দরকার৷
ছবি: DW
আমিরুল, প্রকৌশলী
প্রত্যাশা: কথা বলা ও রাস্তায় নামার অধিকার ফিরিয়ে আনা৷ এখন যে পরিস্থিতি সেটা আগে মোকাবেলা করুক, সব স্বাভাবিক করে আনুক এটাই আশা করি৷ প্রাইমারি ফোকাস হওয়া উচিত রাষ্ট্রকে আগে গড়ে তোলা৷ নৈরাজ্য হবার পরে যে অবস্থা বা গত সরকার ১৫ বছর যেভাবে শাসন করেছে এটা থেকে স্বাভাবিক করার জন্য দেশকে একটা শক্তিশালী জায়গায় নেওয়া উচিত৷ অর্থনৈতিক দিক থেকে এবং সকল দিকই যেন ঠিকঠাক করতে পারে৷
ছবি: DW
শিমু আক্তার, শিক্ষার্থী ও ভলিবল খেলোয়াড়
আশা করবো বর্তমান সরকার শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশ গড়ার দাবির কথা মাথায় রেখে রাষ্ট্র পুনর্গঠন করবে৷ তবে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করা এই সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জিং হতে পারে৷
ছবি: DW
আবুল বাশার, শরবত বিক্রেতা
আমি চাই এই সরকার সুন্দরভাবে দেশ পরিচালনা করবে যেন গরিব, ধনী সবাই শান্তিতে বাস করতে পারেন৷ রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতার প্রতি লোভ এই সরকারকে বিপদে ফেলতে পারে বলেও মনে করেন তিনি৷
ছবি: DW
রুপসী চাকমা, শিক্ষার্থী
পার্বত্য চট্টগ্রামে বহুদিন ধরে ‘সেনাশাসন’ চলছে৷ যত ধরনের বৈষম্য তৈরি করা দরকার, সেটা তারা করেছে৷ আমরা সেনাশাসন প্রত্যাহার চাই৷ কল্পনা চাকমার গুমের যে ঘটনা ঘটেছিল তার তদন্ত ও সন্ধান চাই৷ দীর্ঘদিন ধরে যে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা ছিল সেটা নির্মূল করা বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে৷ দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা নির্মূল করে সংস্কার করাই হবে অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ৷
ছবি: DW
জয়নাল, পান বিক্রেতা
সরকারের কাছে আমার প্রত্যাশা, দ্রব্যমূল্য যেন কম থাকে, সাধারণ মানুষ যেন কম দামে খাবার কিনতে পারে৷ তবে মনে হয় দ্রব্যের দাম কমানো অনেক কঠিন হবে৷ অবশ্য সরকার যদি আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে, তাহলে হয়তো পারবে৷
ছবি: DW
ইসরাত জাহান ইমু, শিক্ষার্থী
দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সময়ে হয়ে আসা ছাত্র আন্দোলনের সকল দাবি যেন এই সরকার পূরণ করে৷ এছাড়া অফিস-আদালত থেকে শুরু করে সব প্রতিষ্ঠানে গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে হবে৷ কাঠামোগত দুর্নীতি দূর করতে হবে৷ নতুন সংবিধান তৈরি করে প্রশাসনিক কাঠামো এমনভাবে পরিবর্তন করতে হবে যেন পরবর্তী কোনো সরকার আবার স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে না পারে৷