বিএনপি'র সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ!
২৭ জুন ২০১৭বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিএনপিকে নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দলটিকে অনেকেই ‘সীমিতভাবে সক্রিয়' রাজনৈতিক দল হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন৷ তাঁদের মতে, বিএনপির রাজনীতি পল্টন কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিং আর প্রেসক্লাবে বা ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কোনো কোনো নেতার যোগ দেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ৷ মাঠের রাজনীতিতে জনঘনিষ্ঠ কোনো ইস্যুতে তারা শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারেনি৷ এমনকি সম্প্রতি দলটির মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ওপর হামলার প্রতিবাদেও কেবল একটি প্রেস ব্রিফিংই করেছে তারা৷ এ পরিস্থিতিতে ঈদের পর সহায়ক সরকারের প্রস্তাব নিয়ে বিএনপিকে মাঠে দেখা যেতে পারে বলে জানা গেছে৷
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী অবশ্য দাবি করেন, বিএনপি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করছে৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘অনেকে মনে করেন, রাজনীতি মানে মাঠে সহিংসতা দেখানো৷ কিন্তু আমরা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করছি৷ প্রত্যেকটি বিষয়ে আমরা মতামত দিচ্ছি৷ আমরা নির্বাচন কমিশন কিভাবে গঠন হবে, আরপিও নিয়ে প্রস্তাব দিয়েছি৷ ভিশন ২০৩০ দিয়েছি৷ রামপাল নিয়ে গবেষণা করে বিবৃতি দিয়েছি৷''
তবে মাঠের আন্দোলনে বিএনপির সাফল্য বা প্রাপ্তি নিয়ে ‘বিএনপিঘনিষ্ঠ' হিসেবে পরিচিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. এমাজউদ্দীন আহমেদেরও ভিন্নমত রয়েছে৷ তিনি মনে করেন, নেতৃত্ব পর্যায়ে দলটির দুর্বলতা আছে৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি জানান, ঈদের পর আন্দোলনের রূপরেখা দেয়ার বিষয়টি দলটি এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি৷ ‘‘বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ে দুর্বলতা আছে৷ খালেদা জিয়া অসুস্থ৷ নিঃসঙ্গ৷ তাঁর ছেলে লন্ডনে নির্বাসনে৷ স্থায়ী কমিটির অন্য শীর্ষ নেতাদের শক্ত সমর্থনপুষ্ট নন তিনি৷ অসুস্থ বলে নেত্রী হিসেবে নিজেও দলকে ঠিকমতো সময় দিতে পারেন না৷'' তিনি মনে করেন, ‘‘সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বিএনপি৷ হামলা-মামলার শিকার হয়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা মাঠে নামতে পারছে না৷ কিন্তু সামনে তাঁদের এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে৷''
কলামিস্ট সোহরাব হাসানও তুলে ধরলেন বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা দিকটি৷ ডয়চে ভেলেকে দেয়া টেলিফোন সাক্ষাৎকারে তিনি মন্তব্য করেন, ‘‘জনঘনিষ্ঠ ইস্যুগুলোতে বিএনপি তাদের অবস্থান তৈরি করতে পারেনি৷'' তাঁর মতে, ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপি সাংগঠনিক ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ নির্বাচন ঠেকানোর নামে তারা যে আন্দোলন করেছে, তা সহিংস আন্দোলনে রূপ নেয়ায় এর রাজনৈতিক ফায়দা নিতে পেরেছে আওয়ামী লীগ৷ বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে৷ তিনি মনে করেন, নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে গিয়ে আন্দোলনকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে বিএনপি৷
সোহরাব হাসানের মতে, তারেক রহমান শিগগিরই দেশে আসবেন বা দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠবেন– এমন আশা দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে নেই৷ তিনি বলেন, ‘‘২০১৪ সালে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে আশা ছিল তারেক রহমান দেশে আসবেন৷ নির্বাচন করবেন৷ কিংবা জেলে গেলেও রাজনীতিতে সক্রিয় থাকবেন৷ কিন্তু এখন আমার মনে হয় না, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে তাঁদের মধ্যে এ ধরনের কোনো আশা অবশিষ্ট আছে৷''
তিনি মনে করেন, দলের নেতাকর্মীদের দৃষ্টি এখন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোর দিকে৷ মামলাগুলো প্রায় নিষ্পত্তির মুখে৷ জানা গেছে, রায় বিপক্ষে গেলেও বিএনপি উচ্চ আদালতে আপিল করবে৷
তবে বিএনপি'র স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী মনে করেন, বিএনপির নেতৃত্ব সংকট নেই৷ বরং তাঁর মতে, হামলা-মামলা দিয়ে দমন করা হলেও বিএনপি এখন আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘ বিএনপি এখন আগুনে পুড়ে খাঁটি হওয়া একটি দল৷''
আমির খসরু ও ড. এমাজউদ্দীন দু'জনই বিএনপির জন্য কিছুটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন৷ দু'জনই মনে করেন, বীতশ্রদ্ধ জনগণ বর্তমান সরকারকে প্রত্যাখ্যান করবে আর বিএনপিকে সেই সুযোগটাই সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে৷
সোহরাব হাসান মনে করছেন, এখন বিএনপির ভরসা ঈদের পর আন্দোলন জমিয়ে তোলার৷ কিন্তু সহায়ক সরকারের যে প্রস্তাব, তা আওয়ামী লীগ গ্রহণ করবে সে আশা খুব একটা দেখছেন না তিনি, কারণ, ‘‘গত ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সংসদে ছিল বিএনপি৷ এবার তা-ও নেই৷ তাই তাদের প্রস্তাব কতটা আমলে নেবে আওয়ামী লীগ সে সংশয় থেকেই যায়৷''
এ বিষয়ে আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘‘এটি শুধু বিএনপির ইস্যু নয়৷ এটি জাতির ইস্যু৷ তারা (আওয়ামী লীগ) যদি জনগণের ভোটাধিকার আবারো কেড়ে নিয়ে ক্ষমতায় আসতে চায়, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তো এমনিতেই বদলাচ্ছে, আওয়ামী লীগ প্রত্যাখ্যান করলে তা আরো কঠিন রূপ নেবে বলে আমার ধারণা৷''
সাম্প্রতিক সময়ে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেও বিএনপির দূরত্ব দেখা গেছে৷ দলটির এ বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয় রয়েছে৷ নিজস্ব প্রতীকে আগামী নির্বাচনে জামায়াতের অংশ নেয়ার সুযোগ নেই৷ সাম্প্রতিক কয়েকটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ২০ দলীয় জোট প্রার্থীর প্রচারণার জন্য গঠিত দলে জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব রাখা হয়নি৷ এ বিষয়ে ড. এমাজউদ্দীন আহমেদ বলেন, বিএনপিকে ছাড়া জামায়াতের গতি নেই৷ তাই নির্বাচনকে ঘিরে এ দূরত্ব থাকবে না৷ সোহরাব হাসানও মনে করেন, জামায়াতের সামনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসার কোনো সুযোগ নেই৷ তাই বিএনপির সঙ্গেই তাদের থাকতে হবে৷ ড. এমাজউদ্দীন আরো মনে করেন, হেফাজতে ইসলামকে সুযোগ দিয়ে সরকারি দল যে রাজনৈতিক সুবিধা পেতে চাইছে, তা সম্ভব নয়৷ কারণ, তাঁর মতে, আওয়ামী লীগ গায়ে যতই ধর্মীয় তকমা লাগাক, ভোটের রাজনীতিতে এর সুফল তারা কখনো ঘরে তুলতে পারবে না৷
সোহরাব হাসান মনে করেন, সামনের দেড় বছর বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ বিএনপিকে এ সময়টাতে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে৷ সেক্ষেত্রে বিএনপি যা গেল আট বছরে পারেনি, তা সামনের সময়গুলোতে কি পারবে? নাকি তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন সীমাবদ্ধ ‘‘জনগণ যদি আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করে'' সেই আশায়? সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সোহরাব হাসান মনে করেন, বিএনপি নির্বাচনে যাবে৷ আর খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা বা শাস্তি দেয়া হলে তা নির্বাচনে বিএনপির জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে বলে মনে করেন তিনি৷
আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে মন্তবের ঘরে৷