বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এখন আর দলীয় কোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন না। আগে থেকেই কেন্দ্রীয় নেতারাও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। সব সিদ্ধান্ত দেন বিদেশে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বিজ্ঞাপন
বিএনপির কয়েকজন নেতার সাথে কথা বলে এই চিত্র স্পষ্ট হয়েছে। তাই দলের মধ্যে হতাশা আর নিস্ক্রিয়তা বাড়ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২২ জুন দলের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠানোর সুযোগ দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ওই দিন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার লিভার ও অন্যান্য জটিলতার চিকিৎসা বিদেশের কোনো উন্নত কেন্দ্রে প্রয়োজন। এ পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটি।’’
বিএনপির চার দশক
৪৫ বছরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপি৷ দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দলটির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া৷ যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত আছেন সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান৷ এত বছরে কী ছিল দলটির পথচলা?
ছবি: Getty Images/Keystone
প্রেক্ষাপট
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনা সদস্যদের গুলিতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন৷ এরপর প্রায় তিন বছর বাংলাদেশে ছিল অনির্বাচিত সরকার৷ সে সময় দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেন তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান৷ পরে ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগিয়ে এলে রাজনৈতিক দল গঠন করেন৷
ছবি: imago/Belga
প্রতিষ্ঠা
বিএনপি গঠন করার আগে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে আরেকটি দল তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে সভাপতি করে গঠন করা হয়েছিল৷ পরে তা বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে প্রধান করে গঠিত হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপি৷ ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর রমনা রেস্তোরাঁয় আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠ করে দলের যাত্রা করেন জিয়াউর রহমান৷
ছবি: imago/United Archives International
নির্বাচন ও মৃত্যু
জিয়া রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থাতেই ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন৷ এ নির্বাচনে বিএনপি ২৯৮টি আসনের মধ্যে ২০৭টিতে জয়লাভ করে৷ তখন মালেক উকিলের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ৩৯টি ও মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ২টি আসনে জেতে৷ নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেবার মাত্র দুই বছরের মাথায় ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন৷
ছবি: Getty Images/Keystone
খালেদার রাজনীতিতে আসা
জিয়ার মৃত্যুর পর নেতাকর্মীদের আহ্ববানে তিনি ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপিতে যোগ দেন৷ ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন৷ ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল দলের বর্ধিত সভায় প্রথম বক্তৃতা করেন৷ ১৯৮৪ সালের ১০মে পার্টির চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন৷
ছবি: AP
এরশাদবিরোধী আন্দোলন ও খালেদা জিয়া
জিয়ার মৃত্যুর পর উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি হন৷ তবে তাঁকে হটিয়ে ১৯৮৩ সালে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন৷ বিএনপি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে৷ এই আন্দোলনে বেগম জিয়া ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দু’জনই ছিলেন, যদিও আপোষহীনতার কারণে খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়৷
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
সরকার গঠন
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন৷ এ নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে বিএনপি৷ ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল প্রশ্নবিদ্ধ আরেকটি নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে৷ কিন্তু আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলোর প্রতিবাদে মাত্র ৪৫ দিন টিকতে পারে সেই সরকার৷
ছবি: AP
শেষবার সরকারে
২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় নির্বাচনে জিতে আবারো সরকার গঠন করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট৷এই সরকারই ছিল বিএনপির শেষ সরকার৷ এই সরকারের মেয়াদ শেষ হবার পর নানা বিতর্ক ও ঘটনার প্রেক্ষাপটে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল প্রায় দুই বছর৷ সে সময় খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা উভয়কেই জেলে যেতেও হয়েছিল৷ পরে অবশ্য দু’জনই ছাড়া পান৷
ছবি: Getty Images
জোটের রাজনীতি
বিএনপি এ পর্যন্ত বারবার জোট করেছে৷ প্রথম সাতদলীয় জোট করে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে৷ এরপর জামায়াতে ইসলামীসহ গড়ে চারদলীয় জোট৷ পরবর্তীতে জোটে দলের সংখ্যা বাড়তে থাকে৷ সেটি ঠেকে বিশ দলীয় জোটে৷
ছবি: bdnews24.com
রাজনৈতিক ভুল ও কারাগারে খালেদা
সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পর আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট৷ এই নির্বাচনে অংশ না নেয়াকে অনেকেই রাজনৈতিক ভুল বলে মনে করেন৷ তাঁর বিরুদ্ধে থাকা নানা মামলার মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আদালত তাঁকে কারাদণ্ড দেয়৷ আরো কয়েকটি মামলা চলছে তাঁর বিরুদ্ধে৷
ছবি: picture-alliance/epa/A. Abdullah
বিদেশে তারেক রহমান
মানি লন্ডারিংসহ নানা মামলায় বর্তমানে যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন জিয়াপুত্র ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান৷ নানা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় তিনি দেশে ফিরতে পারছেন না৷ এসব সংকট নিয়ে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে কিছুটা দুর্বল অবস্থায় আছে বলে মনে করেন অনেকেই৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
এর আগে অবশ্য খালেদা জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে দলের প্রতি ক্ষোভ জানানো হয়। দলের পক্ষ থেকে কোনো অবস্থান না নেয়ায় খালেদা জিয়ার পরিবার ওই ক্ষোভ প্রকাশ করে।
জানা গেছে, বিএনপির পক্ষ থেকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে এরইমধ্যে সরকারের দুইজন মন্ত্রীর সাথে খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে কথা বলা হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক আবেদন জনানো হবে বলে জানা গেছে। আবেদন জানানোর আগে অনুষ্ঠানিক কোনো বৈঠক করতে চান না বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। আগে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় তারা সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত সিগন্যাল পেতে চায়। সরকার চায় খালেদা জিয়া শর্ত মেনে বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাক। জানা গেছে, সরকারের শর্তগুলোও পর্যালোচনা করে দেখছে বিএনপি। বিএনপি চাইছে যত কম শর্তে খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠানো যায়।
কার্যত দল চালাচেছন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দেশের বাইরে থেকেই তিনি দলের সব সিদ্ধান্ত দিচেছন। এখানে যারা আছেন তারা শুধু মাত্র তা বাস্তবায়ন করছেন। বিএনপিতে এখন খালেদা জিয়া পন্থীরা বলতে গেলে পুরোপুরি কোণঠাসা। তাদের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেই। দলের মহাসচিবও তারেক রহমানকে না জনিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তাই সরকারের সাথে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে কোন শর্ত মানা হবে কি হবে না তা তিনিই ঠিক করবেন।
খালেদা জিয়ার দীর্ঘ অসুস্থতা এবং দুর্নীতির মামলায় শাস্তির বিষয়টি তাকে রাজনীতির বাইরে নিয়ে গেছে। তিনি এখন আর দলীয় কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেন না। তার সঙ্গে দলের বিষয় নিয়ে কথা বলারও তেমন সুযোগ নাই। তাই বিএনপি এখন পুরোপুরি তারেক রহমান নির্ভর হয়ে পড়েছে। কিন্তু সেটা নিয়ে দলে আছে দুই মত।
খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড, করোনা পরিস্থিতি এবং খালেদা জিয়ার করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় বিএনপি এখন অনেকটাই বিবৃতি এবং ভার্চুয়াল মিটিং কেন্দ্রিক দলে পরিণত হয়েছে। তবে ঢাকা মহানগর বিএনপি নেতারা আজকাল কিছুটা সক্রিয় হয়েছেন। এর কারণ সামনে নতুন কমিটি হবে। তাই যারা মহানগরের শীর্ষ পদে আছেন এবং নতুন করে পদের প্রত্যাশীরা বিভিন্ন নাগরিক ও সামাজিক ইস্যুতে কর্মসূচি দিচ্ছেন। যেমন ২৪ জুন তারা পানির দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে ওয়াসার সামনে কর্মসূচি পালন করেছে।
বিএনপির সুহৃদ বলে পরিচিত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘‘বিএনপি খালেদা জিয়ার জন্য কিছুই করেনি। তার চিকিৎসার জন্য করেনি। তার মুক্তির জন্যও করেনি। খালেদা জিয়া এখন মানসিক ডিপ্রেশনে ভুগছেন। বিএনপি এখন আরা খারাপের দিকে যাচ্ছে। তারা কোনো আন্দোলন করছে না। আন্দোলন করতেও নাকি দেশের বাইরে থেকে নিষেধ করা হচ্ছে।’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘তারেক রহমানকে দিয়ে বিএনপি চলবে না। আসমানে বসে সেখান থেকে এখানকার পার্টি কন্ট্রোল করার চেষ্টা একটা বুজরুকি ব্যাপার। আমি তাকে পড়াশুনা করার পরামর্শ দিয়েছিলাম সেটা করলেও কিছুটা কাজ হত।’’
বিএনপির ভাইস চেয়াম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘‘তারেক রহমানের নেতৃত্বে গত আড়াই বছরে বিএনপি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে সংগঠিত। সরকার সমর্থকেরা তার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার করছে।’’
দলকে চাঙা করার সব ধরনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে: মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
আর খালেদা জিয়ার পরিবারের চেষ্টার পর দল এখন আরো বৃহত্তর পরিসরে তাকে দেশের বাইরে পাঠানোর চেষ্টা করছে। তার পরিবারের কিছু সীমবদ্ধতা আছে বলে জানান বিএনপির এই নেতা।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘‘দলকে চাঙা করার সব ধরনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।’’
এতদিন পর দলের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য পাঠানোর দাবি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘খালেদা জিয়া খুবই অসুস্থ এখন। তাই দলের স্থায়ী কমিটির পক্ষ থেকে এই আহ্বান জানানো হয়েছে।’’
সামনে নির্বাচন কমিশন নিয়ে একটি রাজনৈতিক অবস্থানে যেতে চায় বিএনপি। মির্জা ফখরুল জানান, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে তারা একটি সিদ্ধান্ত নেবেন।