নিষিদ্ধ ছিল ধর্ম নিয়ে রাজনীতি৷ ১৯৭৫-এর পর জামায়াতকে ফিরিয়ে সেই রাজনীতিকে বৈধতা দেয় বিএনপি৷ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে আওয়ামী লীগের আপোশ খুবই দৃশ্যমান৷ তবে বিএনপি জামায়াতকে না ফেরালে গল্পটা হয়ত অন্যরকম হতো৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press/Z.H. Chowdhury
বিজ্ঞাপন
শুধু আওয়ামী লীগ নয়, প্রথম সারির বাম দলগুলোও কৌশলে ধর্মের রাজনীতির সঙ্গে আপোশ করেই পথ চলছে৷ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের দুই মন্ত্রীকে তো হজে যাওয়ার আগে সে খবরটি সংবাদমাধ্যমকে ঘটা করে জানিয়ে যেতেও দেখা গেছে৷ তাদেরও যে প্রচার দরকার! দেখানো দরকার যে তাঁরাও ‘ধার্মিক'৷ নিজেকে ধার্মিক হিসেবে জাহির করায় তো আজকাল অনেক ‘সুবিধা'৷ আর তাঁরা তো বাম দলের নেতা৷ সবাই তাঁদের প্রগতিশীল ভাবেন৷ ‘ধার্মিক' ইমেজ তৈরি করা গেলে প্রতিক্রিয়াশীলরাও ‘নাস্তিক' তালিকায় তাঁদের রাখবে না৷ সুতরাং তখন দু'দিক থেকেই নিরাপদ৷
ধর্মকে এভাবে নিজের বা দলের সুবিধার জন্য ব্যবহার করাটাও এক ধরনের অপরাজনীতি৷
ভালো কাজ তো স্বার্থচিন্তা ছাড়াই করা ভালো৷ ধর্মেও আছে এমন কথা৷ ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে, ‘‘তুমি এমনভাবে অন্যের উপকার করবে যাতে ডান হাত দিয়ে উপকার করলে বাম হাতও জানতে না পারে৷''
ধর্মের রাজনীতি ও তরুণ প্রজন্ম
ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রসার ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে উৎসাহ, উদ্বেগ দুই-ই আছে৷ আর সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলা বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক দল ও ইসলামপন্থিদের উত্থানের বিষয়টিকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ৷ ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে কী ভাবছে আজকের প্রজন্ম?
ছবি: Reuters
পিয়ান মুগ্ধ নবীর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের শিক্ষার্থী পিয়ান মুগ্ধ নবীর কাছে ধর্ম বিষয়টা পুরোপুরি ব্যক্তিগত হলেও রাজনীতি ব্যক্তিগত বিষয় নয়৷ তবে ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে তিনি কখনোই সমর্থন করেন না৷
ছবি: DW
শিবরাজ চৌধুরী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী শিবরাজ চৌধুরী৷ তার মতে, ধর্ম এবং রাজনীতি কখনোই এক হতে পারে না৷ ধর্মের মূল বিষয় মনুষত্ব বা মানুষের মধ্যকার শুভবোধ৷ তবে ধর্মের নামে যদি কখনো মৌলবাদ কিংবা চরমপন্থা চলে আসে, সেটা কখনোই গ্রহনযোগ্য নয়৷
ছবি: DW
শিহাব সরকার
ঢাকার একটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী শিহাব সরকার৷ তার মতে, ধর্ম ধর্মের জায়গায় আর রাজনীতি রাজনীতির জায়গায়৷ বলা বাহুল্য, ধর্মের নামে রাজনীতি তিনিও সমর্থন করেন না৷
ছবি: DW
আসিফ হামিদী
আসিফ হামিদীও মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন৷ তিনিও মনে করেন ধর্ম এবং রাজনীতি কখনোই এক হতে পারে না৷ তাই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ঘোর বিরোধী তিনি৷
ছবি: DW
মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর
ঢাকার একটি মাদ্রাসা থেকে উচ্চশিক্ষা শেষ করেছেন মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর৷ তাঁর মতেও রাজনীতি ধর্মভিত্তিক হতে পারে না৷ তবে আল্লাহ এবং রাসুলের কিংবা ইসলামের উপর কোনোরকম আঘাত আসলে তার বিরোধীতা করা সব মুসলমানের নৈতিক দ্বায়িত্ব বলে মনে করেন তিনি৷
ছবি: DW
সাদমান আহমেদ সুজাত
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদমান আহমেদ সুজাত৷ তাঁরও ঐ এক কথা৷ ‘‘ধর্ম এবং রাজনীতি কখনো এক হতে পারে না৷’’ তিনি জানান, ‘‘ধর্ম আমরা সাধারণত জন্মগতভাবে পাই, কিন্তু রাজনীতিকে আমরা অনুসরণ করি৷’’
ছবি: DW
সাজ্জাদ হোসেন শিশির
ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাজ্জাদ হোসেন শিশির৷ তাঁর মতে, রাজনীতি সবসময়ই ধর্ম নিরপেক্ষ হওয়া উচিত৷ তাঁর বিশ্বাস, ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে মিশিয়ে ফেললে তার ফল কখনো ভালো হয় না৷
ছবি: DW
দাউদুজ্জামান তারেক
ঢাকার আরেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দাউদুজ্জামান তারেক মনে করেন, রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের কখনো মিল হতে পারে না৷ কারণ বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা একই রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসরণও করতে পারেন৷
ছবি: DW
8 ছবি1 | 8
অথচ ধর্মের রাজনীতিটা হয়ই প্রচারের জন্য৷ ধর্মের প্রচার নয়, ধর্মের নামে নিজের বা দলের স্বার্থে উদ্দেশ্যমূলক প্রচার৷ সেক্ষেত্রে দলের নামে ‘ইসলাম' শব্দটা থাকলে অনেক মানুষের মনে জায়গা করে নেয়া, মানুষকে ধোঁকা দেয়াটাও সহজ৷ সরল, ধর্মপ্রাণ মানুষদের কেউ কেউ ভেবে নিতে পারেন ‘‘দলটির নামের সঙ্গে ‘ইসলাম' আছে, মুখেও তারা ইসলামের কথা বলছে, সুতরাং তারা নিশ্চয়ই ইসলামের রক্ষক৷''
অথচ দলের নামে ‘ইসলামী' শব্দটি থাকলেও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামী কী কী অপকর্ম করেছিল তা তো সবাই জানেন৷ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা, শহিদ পরিবার আর ধর্ষিতা নারীর স্মৃতিতে সেসব আছে, ইতিহাসের পাতায়ও তা লেখা আছে৷
এমনিতে উপমহাদেশের রাজনীতি কখনোই একেবারে ধর্মের প্রভাবমুক্ত ছিল না৷ বিশেষ করে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের পর থেকে তো নয়ই৷ ১৯৪৯ সালে আজকের আওয়ামী লীগও তাই আত্মপ্রকাশ করেছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' নামে৷ তারপর দলটির নাম হয়ে যায় ‘পাকিস্তান আওয়ামী লীগ'৷ বাঙালি জাতীয়তাবাদই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে দলটির কাছে৷ সত্তরের নির্বাচনে এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও এই ভূখণ্ডের আপামর মানুষ তাই বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষেই থেকেছে৷
সেই আওয়ামী লীগই কেন রাজনৈতিক আকাঙ্খা পূরণে ধর্মের ব্যবহারকে মোক্ষম অস্ত্র মনে করছে? যে দেশের জন্মই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে, সেই দেশই বা কিভাবে আবার উল্টো হাঁটে?
কারণটা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে জানতে চাইলে তিনি কী বলবেন তা কিছুটা অনুমান করতে পারি৷ তিনি হয়ত বলবেন, ‘‘এ জন্য বিএনপি আর জামায়াতই দায়ী৷ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কখনোই ধর্মের রাজনীতি করে না৷''
বিএনপি সভানেত্রী খালেদা জিয়াও নিশ্চয়ই বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব বাড়ানোয় তার দলের বিশেষ ভূমিকার কথা অস্বীকারই করবেন৷ স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তিনিও নিশ্চয়ই জামায়াতকে গোপন করে অভিযোগের আঙুলটা তাক করবেন আওয়ামী লীগের দিকে৷
কিন্তু বাংলাদেশে ধর্ম নিয়ে রাজনীতির কথা হবে, অথচ জামায়াত প্রসঙ্গে চুপ থাকবেন, তা কি হয়? আম ছাড়া কি আমসত্ব হয় নাকি?
ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে পৃথককরণ
তৃতীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসনের আমল থেকে ‘‘ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে বিচ্ছেদ’’ কথাটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে চালু৷ বিভিন্ন দেশের সংবিধানে এই সমস্যার মূল্যায়ন ও সমাধান আজও আলাদা৷ তার কিছু নমুনা৷
ছবি: Jewel Samada/AFP/Getty Images
অস্ট্রেলিয়া
কমনওয়েলথ দেশটির সংবিধানে কোনো ধর্ম প্রতিষ্ঠা বা সরকারি পদ গ্রহণের জন্য কোনো ধর্ম পরীক্ষা নিষেধ করা আছে৷ অপরদিকে যে কোনো ধর্ম মুক্তভাবে পালন করার অধিকার দেওয়া হয়েছে৷ (ছবিতে সিডনির সংসদ ভবনের উপর অস্ট্রেলিয়ার লোগো)৷
ছবি: picture-alliance/dpa/L. Coch
ব্রাজিল
ব্রাজিলের বর্তমান সংবিধানে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে; কোনো রাষ্ট্রীয় গির্জা প্রতিষ্ঠা নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ সরকারি কর্মকর্তাদের ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে কোনো ধরনের ‘‘জোট গঠন বা নির্ভরতা’’ নিষিদ্ধ৷ (ছবিতে ব্রাজিলের কনগ্রেসো নাসিওনাল বা জাতীয় কংগ্রেস, যার দুই কক্ষ হলো সেনেট এবং চেম্বার অফ ডেপুটিজ)৷
ছবি: Voishmel/AFP/Getty Images
চীন
গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সংবিধানে বলা হয়েছে, ‘‘কোনো সরকারি বিভাগ, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি নাগরিকদের কোনো ধর্মে বিশ্বাস করতে বা না করতে বাধ্য করতে পারবে না; এছাড়া যে সব নাগরিক কোনো ধর্মে বিশ্বাস করেন অথবা করেন না, তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য করা চলবে না৷’’ (ছবিতে বেইজিং-এর গ্রেট হল অফ দ্য পিপল, যেখানে প্রতিবছর ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়)৷
ছবি: picture-alliance/dpa/How Hwee Young
ফ্রান্স
ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিচ্ছেদকে ফরাসিতে বলা হয় ‘লাইসিতে’৷ ফ্রান্সে ধর্ম ও রাজনৈতিক ক্ষমতাকে পরস্পরের থেকে আলাদা রাখার চেষ্টা করা হয়েছে৷ একদিকে যেমন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ থেকে সুরক্ষিত করার চেষ্টা করা হয়েছে, অপরদিকে সরকারি ক্ষমতাকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির প্রভাবমুক্ত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে৷ (ছবিতে প্যারিসের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বা জাতীয় সম্মেলন)৷
ছবি: picture-alliance/ZB/M. Tödt
জার্মানি
জার্মান সংবিধানে ধর্মের স্বাধীনতার গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে, যদিও জার্মানিতে গির্জা ও রাষ্ট্রের মধ্যে পুরোপুরি বিচ্ছেদ নেই৷ সরকারিভাবে স্বীকৃত গির্জাগুলিকে পাবলিক কর্পোরেশনের মর্যাদা দেওয়া হয়, তাদের প্রাপ্য কিছু কিছু কর সরকার আদায় করে দেন – তবে বিনামূল্যে নয়৷ ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক পাঠ্য বিষয় নয়৷ (ছবিতে বার্লিনের বুন্ডেসটাগ বা জার্মান সংসদ)৷
ছবি: imago/Schöning
জাপান
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন দখলদারির সময় ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিচ্ছেদ সংক্রান্ত মার্কিন ধ্যানধারণা জাপানে আরোপিত হয়৷ জাপানের সংবিধানে ধর্মপালনের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করা হয়েছে, অপরদিকে সরকার ধর্মপালনের জন্য কোনোরকম চাপ দিতে পারবেন না, অথবা কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে সরকারি অর্থ ব্যয় করতে পারবেন না৷ (ছবিতে টোকিও-র সংসদভবন)৷
ছবি: Reuters
সুইজারল্যান্ড
সুইশ কনফেডারেশনের ফেডারাল সংবিধানে ‘‘ধর্ম ও বিবেকের স্বাধীনতা’’-র গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে৷ বিশেষভাবে বলা হয়েছে যে, ‘‘কোনো ব্যক্তিকে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ে যোগ দিতে বা অঙ্গ হতে, কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে বা ধর্মীয় নির্দেশ অনুসরণ করতে বাধ্য করা চলবে না’’৷ (ছবিতে বার্ন শহরের বুন্ডেসহাউস বা ফেডারাল প্যালেস, যেখানে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির অধিবেশন বসে)৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Klaunzer
যুক্তরাজ্য
যুক্তরাজ্যের চার্চ অফ ইংল্যান্ডের প্রধান হলেন ব্রিটিশ নৃপতি স্বয়ং, তিনিই গির্জার উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের নিয়োগ করেন৷ হাউস অফ লর্ডস-এও ২৬ জন বিশপের আসন আছে৷ সব সত্ত্বেও যুক্তরাজ্যে গির্জা ও রাষ্ট্রের মধ্যে যোগাযোগ সীমিত, যুক্তরাজ্যে সরকারি শাসনও অপেক্ষাকৃতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ৷ ব্রিটেনের অলিখিত সংবিধান অনুযায়ী অপরাপর ধর্মীয় গোষ্ঠীও ব্যাপক স্বাধীনতা উপভোগ করে৷ (ছবিতে প্যালেস অফ ওয়েস্টমিনস্টার)৷
ছবি: Mohammad Karimi
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
গির্জা ও রাষ্ট্রের বিচ্ছেদ সম্পর্কে জেফারসনের প্রখ্যাত উক্তি মার্কিন সংবিধানে উল্লিখিত নেই৷ ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্টে বলা হয়েছে যে, ‘‘(মার্কিন) কংগ্রেস কোনো ধর্ম প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে, বা মুক্তভাবে ধর্মপালন নিষিদ্ধ করে কোনো আইন প্রণয়ন করবে না’’৷ (ছবিতে ক্যাপিটল হিল-এ মার্কিন কংগ্রেসের আসন)৷
ছবি: Jewel Samada/AFP/Getty Images
9 ছবি1 | 9
বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে জামায়াতকে ফিরিয়েছিল বিএনপি
জামায়াতে ইসলামীর ‘পুনর্জন্ম' না হলে বাংলাদেশে ধর্মের রাজনীতি এভাবে বিকশিত হতো না৷ স্বাধীন দেশে ধর্মের অপরাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল৷ যুদ্ধাপরাধে ব্যাপকভাবে জড়িত জামায়াতে ইসলামীও তখন নিষিদ্ধ ছিল৷
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু এবং নারী-শিশুসহ তার পরিবারের প্রায় সবাইকে হত্যা করার পর ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী অনেক কিছুই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোশকতায় ফিরিয়ে আনা হয়৷ জিয়াউর রহমানের শাসনামলে জামায়াতে ইসলামীর ওপর থেকেও নিষেধাজ্ঞাটা তুলে নেয়া হয়৷ পাকিস্তানে লুকিয়ে থাকা জামায়াত নেতারা একে একে ফিরেও আসে পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্টের পরে৷
জিয়াউর রহমান বাকশাল ‘নাকচ' করে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধারা ফিরিয়ে এনেছিলেন – এ কথা খুব গর্ব করে বলে বিএনপি৷ কিন্তু একটা কথা বিএনপির সব নেতাই চেপে যান৷ বিএনপির কোনো নেতা বা সমর্থক কখনোই স্মরণ করতে চায় না যে, বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে জামায়াতে ইসলামীকেও রাজনীতিতে ফিরিয়েছিলেন ‘শহিদ প্রেসিডেন্ট' জিয়াউর রহমান৷
টসটসে পাকা আম খুব ভালো৷ ফরমালিনযুক্ত হলে সেই আমই কিন্তু ভয়ঙ্কর৷ জামায়াত ফেরার পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিও সেই নিয়মে ‘ফরমালিনযুক্ত' হয়েছে৷
ভারতবিদ্বেষের নামে ‘হিন্দুবিদ্বেষ'
একাত্তরে প্রকৃত বন্ধুরাষ্ট্রের মতোই পাশে দাঁড়িয়েছিল ভারত৷ কিন্তু তার পরে অনেকভাবেই তারা বন্ধুত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে৷ এ প্রসঙ্গে ফারাক্কা বাঁধ, তিনবিঘা করিডোর, শিলিগুড়ি করিডোর, অর্থনৈতিক ট্রানজিট, সমুদ্র অঞ্চলের মালিকানা নিয়ে বিরোধ, সীমান্তে বিএসএফ-এর বাংলাদেশি নাগরিক হত্যাসহ অনেক বিষয়ই উল্লেখের দাবি রাখে৷ কূটনীতিক উদ্যোগের মাধ্যমে এ সবের অনেকগুলোরই নিষ্পত্তি বা সমাধান সম্ভব৷ কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি নিশ্চয়ই হয়েছে৷ তবে অনেক বিষয়ে, বিশেষ করে বিএসএফ-এর নির্বিচারে বাংলাদেশি হত্যার বিষয়ে জনমনে অসন্তোষ আছে৷ ক্ষোভ আছে৷
দু'দেশের সম্পর্কে চিড় ধরানোর আশঙ্কা জাগানো সব সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশের সব সরকারই কূটনৈতিক উদ্যোগ নিয়েছে৷ কিন্তু বিএনপি কূটনৈতিকভাবে ভারতের সঙ্গে যেমন সম্পর্কই প্রত্যাশা করুক, খোলা ময়দানের রাজনীতিতে সবসময় ভীষণ নোংরাভাবে ভারতবিদ্বেষই ছড়িয়েছে৷ বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান তাঁর শাসনামলের শেষদিকে সার্ক প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখে আঞ্চলিক সহযোগিতার সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা করেছিলেন৷ কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া দলের সভানেত্রী হওয়ার পর বিএনপি কোমর বেঁধে শুরু করে ভারতবিদ্বেষ ছড়ানোর রাজনীতি৷ অনেক ক্ষেত্রেই তা শিষ্টাচারের সীমা ছাড়িয়েছে৷ অনেক ক্ষেত্রেই বিদ্বেষটা দেশ ছাড়িয়ে হয়ে গেছে সম্প্রদায় বিরোধী৷ ভোট এলে স্বয়ং খালেদা জিয়াকেও অনেকবার বলতে শোনা গেছে, ‘‘আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে দেশ বিক্রি হয়ে যাবে, ঘরে ঘরে উলুধ্বনি শোনা যাবে৷'' দেশ বিক্রি হয় না৷ বিক্রি হয়নি৷ মাঝখান থেকে সাম্প্রদায়িকতা ঠিকই বেড়েছে৷
যেসব দেশে রাষ্ট্রপ্রধানদের নির্দিষ্ট ধর্মের হতে হয়
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’ বিশ্বের সব দেশের সংবিধান বিশ্লেষণ করে দেখেছে, ৩০টি দেশে কেউ রাষ্ট্রপ্রধান হতে হলে তাঁকে নির্দিষ্ট একটি ধর্মের হতে হবে৷
ছবি: picture-alliance/ABACAPRESS/E. Vandeville
মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান
‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’-এর বিশ্লেষণ বলছে, ১৭টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে মুসলমান হতে হবে৷ এগুলো হচ্ছে আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, ব্রুনাই, ইরান, জর্ডান, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, মৌরিতানিয়া, মরক্কো, ওমান, পাকিস্তান, কাতার, সৌদি আরব, সোমালিয়া, সিরিয়া, টিউনিশিয়া ও ইয়েমেন৷
ছবি: Reuters/J. Roberts
ইন্দোনেশিয়া
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মুসলমানের বাস ইন্দোনেশিয়ায়৷ তবে সেদেশের সংবিধান বলছে, যিনি রাষ্ট্রপ্রধান হবেন তাঁকে অবশ্যই রাষ্ট্রের মতাদর্শে, যা পঞ্চশিলা নামে পরিচিত, বিশ্বাসী হতে হবে৷ ছবিতে ১৯৬৮ সালে দেশটির দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে সুহার্তোকে শপথ নিতে দেখা যাচ্ছে৷ পঞ্চশিলার অর্থ জানতে উপরের ‘+’ চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Public Domain
লেবানন
জনসংখ্যার প্রায় ৫৪ শতাংশ মানুষ মুসলিম৷ এর মধ্যে ২৭ শতাংশ সুন্নি ও বাকি ২৭ শতাংশ শিয়া৷ খ্রিষ্টান জনগণের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪০ শতাংশ৷ এর মধ্যে ২১ শতাংশ ম্যারোনিট ক্যাথলিক ও ৮ শতাংশ গ্রিক অর্থোডক্স৷ এবার বলুন তো রাষ্ট্রপ্রধানকে কোন ধর্মের হতে হবে? সংবিধান বলছে, অবশ্যই ম্যারোনিট ক্যাথলিক৷ আর প্রধানমন্ত্রীকে হতে হবে অবশ্যই সুন্নি মুসলমান৷ রাষ্ট্রপ্রধান খ্রিষ্টান হতে হবে এমন শর্ত আছে অ্যান্ডোরাতেও৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Haidar
রাজা বা রানিকে নির্দিষ্ট ধর্মের হতে হবে
যুক্তরাজ্য, ক্যানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড সহ কমনওয়েলথভুক্ত ১৬টি দেশের রাজা অথবা রানিকে (বর্তমানে যেমন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ) অবশ্যই নির্দিষ্ট একটি ধর্মের হতে হবে৷ রানির পদ অলংকারিক হলেও তিনি সেসব দেশের রাষ্ট্রপ্রধান৷ ডেনমার্ক, নরওয়ে ও সুইডেন এর ক্ষেত্রেও একই শর্ত প্রযোজ্য৷
ছবি: Getty Images/AFP/C.Jackson
বৌদ্ধ রাষ্ট্রপ্রধান
এমন বিধান আছে দু’টি দেশে৷ ভুটান আর থাইল্যান্ডে৷ ছবিতে ভুটানের বর্তমান রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক ও রানি গিয়ালতসুয়েন জেতসুন পেমা ওয়াংচুককে দেখা যাচ্ছে৷ পিউ রিসার্চ সেন্টারের প্রতিবেদনটি পড়তে উপরের ‘+’ চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Royal Office For Media, Kingdom of Bhutan
ধর্মীয় নেতাদের মানা
বলিভিয়া, মেক্সিকো ও এল সালভেদর সহ আটটি দেশের সংবিধান বলছে, ধর্মীয় নেতারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না৷ অন্য দেশগুলো হচ্ছে মিয়ানমার, কস্টা রিকা, হন্ডুরাস, নিকারাগুয়া ও ভেনিজুয়েলা৷ (প্রতীকী ছবি)
ছবি: picture-alliance/ABACAPRESS/E. Vandeville
6 ছবি1 | 6
আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে ভারতবিরোধিতায় এত বাড়াবাড়ি কেন? ‘উলুধ্বনি শোনা যাবে' বা এই জাতীয় বক্তব্যের মাধ্যমে সমর্থকদের কী ছড়াতে চায় বিএনপি? উগ্রতা নয়? সাম্প্রদায়িকতা নয়? অন্য ধর্ম বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে বিষোদগার বা তাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো নিঃসন্দেহে ধর্মীয় রাজনীতির নিকৃষ্ট উদাহরণ৷
বিএনপির পথ ধরেই ‘রাষ্ট্রধর্ম' করেছিলেন এরশাদ
জামায়াতকে ফিরিয়ে বিএনপি রাজনীতিতে ‘ফরমালিন' মেশালেও রাজনীতিকে ‘ফরমালিনমুক্ত' করার উদ্যোগ কেউই আর নেয়নি৷ বরং আরো নতুন নতুন উপায়ে ‘ফরমালিন' মিশিয়ে সর্বস্তরের জনগণের মাঝে উগ্রতা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টাই লাগাতার হয়ে এসেছে৷ সংবিধানে পরিবর্তন এসেছে৷ সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ধর্ম নিয়ে রাজনীতির খেলায় সবচেয়ে মোক্ষম চালটা চেলেছিলেন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করে৷ এরশাদের পতনের ২৬ বছর পর সংবিধান এবং সম্ভবত জনমনেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আরো জেঁকে বসেছে৷
জামায়াতকে আরো ওপরে তুলেছে বিএনপি
স্বাধীনতার পরে যে দলটি নিষিদ্ধ ছিল বিএনপির বিশেষ কৃপায় সেই জামায়াত এক সময় জাতীয় সংসদেও ঢুকে পড়ে৷ ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াত তো বিএনপির সহযোগী শক্তি হিসেবে মন্ত্রী পরিষদেও ঢোকে৷ আলবদর নেতা, যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মতিউর রহমান নিজামী তখনই কৃষি ও শিল্পমন্ত্রী হন৷
বিএনপি কখনো যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগও নেয়নি
আওয়ামী লীগ নিজামী বা অন্য কোনো যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাকে মন্ত্রীত্ব দেয়নি৷ তবে ধর্মের রাজনীতি সব রকমভাবেই তারা করেছে, করছে৷ আওয়ামী লীগ আর বিএনপির খুব বড় পার্থক্য শুধু একটি জায়গায়৷ আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে আর বিএনপি এই বিচার শুরুর উদ্যোগও কখনো নেয়নি৷
জামায়াতের ‘চুমু' পেয়েছে বিএনপি
ধর্মের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ অনেক জায়গাতেই মেধাহীন, আদর্শহীনের মতো বিএনপিকে অনুসরণ করেছে৷ হেফাজতের সঙ্গে অলিখিত বোঝাপড়াটাও তার একটি প্রমাণ৷ যে হেফাজতকে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানোর চেষ্টায় ব্যবহার করেছিল বিএনপি, সেই হেফাজত এখন অনেকাংশেই আওয়ামী লীগের অনুগত৷ এছাড়া ধর্মের রাজনীতিতে প্রায় হেফাজতের সমতুল ‘ওলামা লীগ'ও আছে আওয়ামী লীগের৷
আশীষ চক্রবর্ত্তী, ডয়চে ভেলেছবি: DW/P. Henriksen
এতকিছুর পরও ধর্মীয় রাজনীতিতে একটা জায়গায় বিএনপি আওয়ামী লীগের চেয়ে পরিষ্কার ব্যবধানে এগিয়ে৷ আওয়ামী লীগ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বহুবারই বলেছে, জামায়াতে ইসলামীকে তারা আবার নিষিদ্ধ করবে৷ এখনো জামায়াতকে নিষিদ্ধ না করলেও দলটির অনেক নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠিকই করছে আওয়ামী লীগ৷ অন্যদিকে বিএনপি শত সমালোচনার পরও জামায়াতকে ছাড়বে না বলেই যেন পণ করেছে৷ কয়েক দিন আগে সে কারণেই হয়ত বিএনপির প্রতি বিশেষ ভঙ্গিতে কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেছে জামায়াত৷ এক ইফতার পার্টিতে বিএনপি নেতাদের ধরে ধরে কপালে চুমু খেয়েছেন জামায়াতের এক নেতা৷
আওয়ামী লীগের এত আপোশ আর বিএনপিকে জামায়াতের চুম্বনে ধন্য হতে দেখার পর বাংলাদেশে ধর্মের অপরাজনীতি বন্ধের কি আর কোনো সম্ভাবনা থাকতে পারে?
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷