সীমান্তে বিএসএফ জওয়ানের মৃত্যুতে কি প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়তে পারে?
বিজ্ঞাপন
সাবেক রাষ্ট্রদূত লে. জেনালের (অব.) হারুন অর রশীদ ডয়চে ভেলেকে বলছেন, ‘‘দুই দেশের সম্পর্কের ভিত্তি অনেক মজবুত৷ এই ঘটনায় দুই দেশের সম্পর্কে প্রভাব পড়বে না৷ আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান হবে৷’’
বাংলাদেশ সীমান্তে ঢুকে ভারতীয় জেলেদের ইলিশ ধরা নিয়ে বিবাদে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলিতে বৃহস্পতিবার একজন বিএসএফ জওয়ানের মৃত্যু হয়েছে৷ এক সপ্তাহ আগে কুমিল্লায় মাদক ব্যবসায়িকে ধরতে গিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করেছিলেন তিনজন র্যাব সদস্য ও তাদের দুই নারী সোর্স৷ তাদের আটক করে মারধোর করে বিএসএফ৷ ১০ ঘন্টা পর আহত অবস্থায় তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়৷
জেনারেল হারুন অর রশীদ বলেন, ‘‘কয়েকদিন আগে প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করেছেন৷ সেখানে চমৎকার আলোচনা হয়েছে৷ আসলে দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ের আলোচনা অনেক সময় মাঠ পর্যায়ের সৈনিকদের কাছে পৌঁছে না৷ এটা তাদের কাছে পৌঁছাতে হবে৷ তাহলে এই অনাকাঙ্খিত ঘটনা কমে যাবে৷’’
শীর্ষ পর্যায়ের আলোচনা অনেক সময় মাঠ পর্যায়ের সৈনিকদের কাছে পৌঁছে না: হারুন অর রশীদ
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল শুক্রবার বলেছেন, ‘‘বিজিবির তথ্যমতে পতাকা বৈঠকের অপেক্ষা না করে তারা (বিএসএফ) আটক জেলেকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য জোরাজুরি করছিল৷ আর তখনই এই গোলাগুলির ঘটনা৷ এতে একজন বিএসএফ সদস্য মারা যান৷ বিজিবি মহাপরিচালক ও বিএসএফের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে৷ আমরা মনে করি, এটা ভুল বোঝাবুঝি থেকেই হয়েছে৷ দুই দেশই বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে৷ আমরা আশা করি আলাপের মাধ্যমে একটা সুরাহা হবে৷’’
বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে চারঘাট উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আরিফুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে পদ্মা নদীতে টহল দিচ্ছিল বিজিবি সদস্যরা৷ এমন সময় বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতরে একটি ভারতীয় মাছ ধরার ট্রলার দেখতে পান তারা৷ ট্রলারটিসহ প্রণব মণ্ডল নামে একজন জেলেকে আটক করলেও অন্য দুই জেলে পালিয়ে যান৷ তারা খবর দিলে ঘটনাস্থলে হাজির হয় বিএসএফের একটি দল৷ সেখানে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে৷ এতে বিএসএফের হেড কনস্টেবল বিজয় ভান সিং (৫২) মারা যান৷ আহত হন কনস্টেবল রাজবীর সিং যাদব৷ তার হাতে গুলি লেগেছে৷ তাকে মুর্শিদাবাদ মেডিকেলে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে৷
ঘটনার একদিন পরও শুক্রবার দুই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে৷ বিজিবি বিবৃতি দিয়ে দাবি করেছে, বিএসএফ আগে গুলি করার পর আত্মরক্ষার্থে তারা গুলি ছোড়ে৷ অন্যদিকে বিএসএফের বরাত দিয়ে বাংলাদেশের ভারতীয় হাইকমিশন থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বিএসএফ জওয়ানরা যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন বিজিবি গুলি ছোড়ে৷ এতে বিজয় নিহত হন এবং রাজবীর আহত হন৷
বিএসএফের আচরণে একটু সমস্যা আছে: তৌহিদ হোসেন
এদিকে আটক জেলে ভারতের মুর্শিদাবাদের জলঙ্গী থানার সাহেবনগর ছিড়াচর এলাকার বসন্ত মণ্ডলের ছেলে প্রনব মন্ডল৷ তার বিরুদ্ধে চারঘাট থানায় দু'টি মামলা করেছে বিজিবি৷ শুক্রবার তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে৷ সীমান্ত অতিক্রম এবং নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ইলিশ ধরার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে৷
এর আগে গত ১০ অক্টোবর কুমিল্লা সীমান্তে মাদক ব্যবসায়ীদের ধাওয়া করতে গিয়ে ভুল করে ভারতের ভেতরে ঢুকে পড়েছিলেন র্যাবের তিন সদস্য ও তাদের দুই নারী সোর্স৷ র্যাব সদস্যরা হলেন, কনস্টেবল আবদুল মতিন, কনস্টেবল রিগেন বড়ুয়া ও সৈনিক ওয়াহেদুল ইসলাম৷ তাদের মারধর করে আটকে রাখে বিএসএফ৷ তাদের আগ্নেয়াস্ত্রও জব্দ দেখানো হয়৷ ১০ ঘণ্টা পর ওইদিন সন্ধ্যায় তাদের ফিরিয়ে দেয় বিএসএফ৷
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘র্যাব টহল দিতে গিয়ে ভুলে ভারতীয় সীমানায় ঢুকে গিয়েছিল৷ বিএসএফ তাদের তিনজনকে চোখ বাঁধা এবং আহত অবস্থায় আমাদের কাছে হস্তান্তর করেছে৷ এটাও আলোচনার মাধ্যমে সুরহা হবে৷’’
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দুই দেশের সম্পর্কের যে ভিত্তি তাতে এই ধরণের ছোটোখাটো ঘটনায় প্রভাব পড়বে না৷ তবে ঘটনাগুলো অনাকাঙ্খিত৷ আমরা আগেও দেখেছি, বিএসএফের আচরণে একটু সমস্যা আছে৷ তারা সীমান্তে কাউকে দেখলেই গুলি করে৷ সে যদি অপরাধীও হয় তাহলেওতো গুলি করা ঠিক না৷ আপনি তাকে ধরে বিচারের আওতায় নেন৷ দুই দেশের মধ্যে এত চমৎকার সম্পর্ক সেখানে কথায় কথায় গুলি করা ঠিক? আসলে আলোচনার মাধ্যমে এগুলোর সমাধান করা উচিত৷’’
ভারত বাংলাদেশ যত চুক্তি
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক পেয়েছে অন্য এক মাত্রা৷ দুই দেশের সরকারের মধ্যে বেড়েছে পারস্পরিক যোগাযোগ, হয়েছে নানা চুক্তি, আর একে অপরকে দিয়েছে ‘সবচেয়ে পছন্দের দেশের’ মর্যাদা৷
ছবি: AFP/P. Singh
১০০ কোটি ডলার ঋণ ও ১৪ প্রকল্প
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার একবছর পর ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম ভারত সফরে যান৷ সেসময় ১০০ কোটি ডলারের এলওসি বা ঋণরেখা অনুমোদন করে ভারত৷ এই অর্থে জনপরিবহন, সড়ক, রেলপথ সেতু আর অভ্যন্তরীন নৌপথের ১৪ টি প্রকল্প বাস্তবায়নের চুক্তি হয়৷
ছবি: Getty Images/G. Crouch
বন্দী বিনিময়
২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে দুই দেশের মধ্যে বন্দী বিনিময় চুক্তি হয়৷ ২০১১ সালের ১৩ই জানুয়ারি তা কার্যকর হয়৷ চুক্তি অনুযায়ী কোনো দেশের নাগরিক অন্য দেশে সাজাপ্রাপ্ত হলে তাকে অনুরোধক্রমে ফেরত পাঠাতে পারবে৷ তবে এর আগেই অনুপ চেটিয়াসহ ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদি নেতাদের গ্রেপ্তার করে দেশটিতে পাঠানো হয় বলে গণমাধ্যমে খবর বেরোয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Barreto
ছিটমহল বিনিময়
২০১৫ সালের জুন মাসে ভারত-বাংলাদেশের স্থল সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন হয়৷ যার মাধ্যমে ২০১৫ সালের জুলাইতে দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত ছিটমহল বিনিময় হয়৷ ভারতের ১১১টি ছিটমহল যুক্ত হয় বাংলাদেশের সাথে৷ একইভাবে ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলও হয়ে যায় ভারতের অংশ৷
ছবি: AFP/Getty Images
নদীর পানি বন্টন
বাংলাদেশের ভারতের অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৪ টি৷ এর মধ্যে শুধু গঙ্গা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি আছে৷ যদিও পানি বন্টনের ক্ষেত্রে এই চুক্তি ভারত মানছে না বলে অভিযোগ আছে৷ অন্যদিকে পাঁচ দশক ধরে তিস্তা চুক্তির চেষ্টা চললেও তা সম্ভব হচ্ছে না দেশটির উদাসীনতার কারণে৷ যার ফলে এখন একতরফাভাবে নদীটির পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত৷
ছবি: DW/A. Chatterjee
ভারসাম্যহীন বাণিজ্য
১৯৭২ সালে প্রথম বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর হয়৷ ২০১৫ সালে স্বাক্ষর হয় এ বিষয়ে নতুন চুক্তি৷ এর আওতায় দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত হাটসহ আরো কিছু বাণিজ্য সম্পর্কিত চুক্তি হয়েছে৷ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের আকার ছিল ৯১৪ কোটি ডলার৷ যার সিংগভাগই ভারতের অনুকূলে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Dutta
উন্নয়ন সহযোগিতার কাঠামো
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালে একটি উন্নয়ন সহযোগিতাবিষয়ক কাঠামোগত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়৷ যার মধ্যে আছে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, পানি সম্পদ; বিদ্যুৎ; শিক্ষা, সাংস্কৃতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ইত্যাদি৷
ছবি: Getty Images/AFP/M.U. Zaman
দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি
এই চুক্তি সম্পর্কে ভারতীয় দূতাবাসের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘‘দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে এক দেশ অন্য দেশের ভূখণ্ড থেকে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও রক্ষার লক্ষ্যে এ চুক্তি হয়েছে৷ ভারত ও বাংলাদেশ একে অপরকে ‘সবচেয়ে পছন্দের দেশ’-এর মর্যাদা দিয়েছে৷’’
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Swarup
বাংলাদেশ ভারতের পণ্য পরিবহন
দুই দেশের মধ্যে হওয়া বাণিজ্য চুক্তি অনুযায়ী এক দেশ আরেক দেশের জল, স্থল ও রেলপথ ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পণ্য ট্রানজিটের সুবিধা নিতে পারে৷ ২০১৬ সালে মাশুলের বিনিময়ে ভারতকে আশুগঞ্জ নৌ বন্দর দিয়ে বহুমাত্রিক ট্রানজিট সুবিধা দেয় বাংলাদেশ৷ সড়কপথে ট্রানজিট দিতে ২০১৫ সালে আখাউড়া অগরতলা সীমান্ত দিয়ে পরীক্ষামূলক চালান পাঠানো হয়৷ যা পরবর্তীতে নিয়মিত হয়নি৷
ছবি: DW/M. Mamun
ভারতের রেল যাবে বাংলাদেশ হয়ে
আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে কোলকাতা থেকে ছেড়ে আসা ট্রেন বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে শিলিগুড়ি যাবে৷ ২০১১ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় এ বিষয়ক একটি চুক্তি হয়৷ চুক্তি অনুযায়ী এজন্য দুই দেশকে তাদের অংশের রেলপথ নির্মাণ করতে হবে৷ বাংলাদেশ অংশের সাত কিলোমিটার রেলপথ আগামী বছরে জুন মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা৷
ছবি: DW/P. Mani
সাবরুমের মানুষে জন্য ফেনীর পানি
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে সাতটি সমঝোতা সই ও চুক্তি হয়েছে৷ একটি সমঝোতার আওতায় ফেনী নদীর ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করতে পারবে ভারত৷ ওই পানি তারা ত্রিপুরার সাবরুম শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ প্রকল্পে ব্যবহার করবে৷
ছবি: AFP/P. Singh
বন্দর ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে ভারত আটটি রুটে তার উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোদে পণ্য আনা নেয়া করতে পারবে৷ এজন্য স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর বা পদ্ধতি কী হবে, তা নির্ধারণে একটি সমঝোতা স্বাক্ষর হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সফরে৷
ছবি: DW/U. Danisman
চুক্তি থাকলেও হত্যা থেমে নেই
সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে ২০১১ সালে বিজিবি-বিএসএফ একটি চুক্তি করে৷ নেয়া হয় সীমান্ত পারাপারে অস্ত্র ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত৷ তবে সীমান্তে দেশটির আচরণে তার প্রতিফলন নেই৷ গত ১০ বছরে ২৯৪ বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ৷