বিচারপতির বাড়ি থেকে রাশি রাশি নোট, বদলি করলো সুপ্রিম কোর্ট
২১ মার্চ ২০২৫
দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি যশবন্ত ভার্মার সরকারি বাসভবনে আগুন লাগে। দমকল আগুন নেভানোর সময় প্রচুর টাকা পায়। পুলিশও সেখানে ছিল। এই খবর সামনে আসার পরই ভয়ংকর আলোড়ন দেখা দিয়েছে।
ঘটনাটি যখন ঘটে তখন বিচারপতি ভার্মা দিল্লিতে ছিলেন না। তার পরিবারের সদস্যরা দমকলে খবর দেন। দমকল আগুন নিয়ন্ত্রণ করার পর একটি ঘরে রাশি রাশি নোট পায়।
বিচারপতি ভার্মা শুক্রবার হাইকোর্টে যাননি। বলা হয়েছে, তিনি ছুটিতে আছেন।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই খবর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে জানায়। এরপরই প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না সুপ্রিম কোর্টের কলিজিয়ামের বৈঠক ডাকেন। এই কলিজিয়ামের সদস্য হলেন সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ প্রবীণ বিচারপতি। বিচারবিভাগ নিয়ে তারাই সিদ্ধান্ত নেন।
কলিজিয়াম ঠিক করেছে, প্রথমেই বিচারপতি ভার্মাকে এলাহাবাদ হাইকোর্টে বদলি করা হবে। কারণ, তিনি এলাহাবাদ হাইকোর্ট থেকেই বদলি হয়ে দিল্লি হাইকোর্টে এসেছিলেন।
কী হয়েছিল?
গত ১৪ মার্চ রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ দিল্লিতে বিচারপতি যশবন্ত ভার্মার তুঘলক রোডের সরকারি বাসভবনে আগুন লাগে। তার বাসভবন থেকে ফোন পেয়ে দমকল ও পুলিশ সেখানে পৌঁছায়।
আগুন নেভানোর পর বিপুল পরিমাণ টাকার সন্ধান পান এক দমকলকর্মী। এরপর দিল্লি পুলিশের তরফ থেকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ঘটনার রিপোর্ট পাঠায়। মন্ত্রণালয় সেই রিপোর্টটি পাঠিয়ে দেয় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে।
২০ মার্চ কলিজিয়ামের বৈঠকে ঠিক হয়, বিচারপতি ভার্মাকে এলাহাবাদ হাইকোর্টে বদলি করা হবে।
এসএসসি কেলেঙ্কারিতে মন্ত্রী গ্রেপ্তার, বান্ধবীর বাড়ি থেকে ২২ কোটি
দীর্ঘ জেরার পর গ্রেপ্তার করা হলো পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। এসএসএসি কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত অভিযোগে। পার্থ-ঘনিষ্ঠ অর্পিতার বাড়ি থেকে ২২ কোটি উদ্ধার। তার দাবি, পার্থই টাকা রাখতে বলেছিলেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
শুক্রবার সকাল থেকে জেরা
শুক্রবার সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ কেন্দ্রীয় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি-র অফিসাররা পৌঁছে যান পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নাকতলার বাড়িতে। পার্থ তখন ঘুমাচ্ছিলেন। তাকে ঘুম থেকে তুলে শুরু হয় জেরা ও তল্লাশি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
২৭ ঘণ্টা ধরে জেরা
গ্রেপ্তার করার আগে ২৭ ঘণ্টা ধরে জেরা করে ইডির অফিসাররা। শুধু পার্থের বাড়ি নয়, মোট ২০টি জায়গা তল্লাশি চালান ইডি-র কর্মকর্তারা। প্রায় ৯০ জন ইডি কর্মী পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালাতে থাকেন। উপরের ছবিতে কলকাতার নাকতলায় পার্থ চট্টোপাধ্য়ায়ের বাড়ি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বান্ধবীর বাড়ি থেকে ২২ কোটি উদ্ধার
তল্লাশির সময় অভিনেত্রী ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখোপাধ্য়ায়ের ফ্ল্যাট থেকে ২২ কোটি টাকা উদ্ধার করে ইডি। টাকা অর্পিতার শোয়ার ঘরের আলমারিতে চটের বস্তায় রাখা ছিল। অর্পিতা ইডি-র অফিসারদের জানিয়েছেন, পার্থই তার কাছে টাকা রেখেছিলেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
রাতভর টাকার হিসাব
ইডি-র অফিসাররা ব্যাংক থেকে দশটি টাকা গোনার মেশিন ও কর্মীদের নিয়ে আসেন। সারারাত ধরে টাকা গোনা হয়। দেখা যায়, ২২ কোটি টাকা আছে। তাছাড়া ৫০ লাখ টাকার সোনার গয়না ও প্রচুর ডলার পাওয়া যায়। বেশ কিছু নথিপত্রও নিয়ে গেছে ইডি। অর্পিতাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। উপরের ছবিতে অর্পিতার দক্ষিণ কলকাতার আবাসনের ফ্ল্যাটের সামনে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রহরা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কীসের টাকা
আদালতে ইডি জানিয়েছে, অর্পিতা এসএসসি-তে বেআইনি নিয়োগের সঙ্গে জড়িত। তিনি অন্যতম চক্রান্তকারী। তার বাড়িই ছিল নিয়োগের আখড়া। সেই নথিপত্র ইডি পেয়েছে। মন্ত্রীর নামের সরকারি খামও পাওয়া গেছে। অর্পিতা ইডিকে জানিয়েছে, টাকাটা পার্থ চট্টোপাধ্যায তাকে রাখতে দিয়েছিলেন। তিনি এনিয়ে কিছুই জানেন না। ইডি এখন অর্পিতার বাড়ি থেকে পাওয়া বিদেশি মুদ্রা নিয়েও আলাদা মামলা করতে পারে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কে এই অর্পিতা?
অর্পিতা মুখোপাধ্যায় অভিনেত্রী। তিনি বাংলা ও ওড়িয়া ছবিতে অভিনয় করেছেন। তাছাড়া তিনি নেল আর্ট করতেন। পার্থর সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট ফোনে অর্পিতা সারাদিন কথা বলতেন বলে অভিযোগ। তিনি দক্ষিণ কলকাতার একটি নামী দুর্গাপুজোর সঙ্গেও জড়িত। এই পুজোর সঙ্গে পার্থও য়ুক্ত।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কী বলছেন অর্পিতার মা
মেয়ের গ্রেপ্তারের খবর পেয়ে তার মা মিনতি বলেন, ‘‘বাবা-মা যা চাইবে ছেলেমেয়ে কি সেটাই করবে? সেরকম হলে তো মেয়ের বিয়ে দিতে পারতাম। ওর কথা খবরে শুনেছি। তবে অর্পিতা এই কাজ করেছে কি না, সেই সত্যাসত্যও বিচার করা হবে।’’
ছবি: Satyajit Shaw/DW
পার্থ হাসপাতালে
গ্রেপ্তার করার পর পার্থকে নিজেদের হেফাজতে রাখে ইডি। তারপর আদালতে পার্থ জানান, তিনি অসুস্থ বোধ করছেন। তখন আদালত তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে বলে। এসএসকেএম হাসাপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। ইডি অবশ্য আপত্তি জানিয়েছিল।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
ইডির দাবি মেনে
ইডি পরে কলকাতা হাইকোর্টে জানায়, পার্থকে কল্যাণীর এইমসের চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে দেখুন। কিন্তু বিচারপতি বলেন, কল্যাণীর এইমসের উপর তার ভরসা নেই। পরে তিনি নির্দেশ দেন, ভুবনেশ্বরের এইমসে পার্থর স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা হবে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
শান্তিনিকেতনে পার্থর বাড়ি?
শান্তিনেকতনে ছয়টি বাড়ি পার্থর বলে অভিযোগ উঠেছে। তারমধ্যে একটি বাড়ির কেয়ারটেকার বলেছেন, একটি বাড়িতে পার্থর আসা-যাওয়া ছিল। একটি সাত বিঘের জমিও পার্থর বলে অভিযোগ। তবে সরকারি আধিকারিকরা বলেছেন, তারা খোঁজ না করে এই বিষয়ে কিছু বলতে পারবেন না।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
পার্থর বিরুদ্ধে অভিযোগ
পার্থ চট্টোপাধ্যায় আগে শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। তখন এসএসসি কেলেঙ্কারি হয়। পরীক্ষা দিয়ে যারা উঁচু স্থান পেয়েছে, তাদের চাকরি না দিয়ে, পয়সা দিয়ে নিয়োগের অভিযোগ ওঠে। এই নিয়োগের বিরুদ্ধে কলকাতায় দীর্ঘদিন ধরে বিক্ষোভ চলছে। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে সিবিআই এই অভিযোগের তদন্ত করছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
তৃণমূলের প্রতিক্রিয়া
পার্থ চট্টোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অন্যতম বরিষ্ঠ মন্ত্রী। মমতার অত্যন্ত বিশ্বস্ত সৈনিক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হামেশাই অভিযোগ করেন, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা দিয়ে রাজ্যের নেতাদের হেনস্থা করা হচ্ছে। কিন্তু পার্থকে গ্রেপ্তার করার পর তৃণমূলের বক্তব্য, অভিযোগ প্রমাণ হলে দল ও সরকার ব্যবস্থা নেবে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
সিপিএমের প্রতিক্রিয়া
সিপিএম সাংসদ ও আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য আদালতে এসএসসি চাকুরিপ্রার্থীদের হয়ে মামলা লড়ছেন। বিকাশরঞ্জনের প্রতিক্রিয়া হলো, ''পার্থ হচ্ছেন দাবার ঘুঁটি, ইডির উচিত হরিশ চ্যাটার্জি রোডে তল্লাশি করা। সেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা পাওয়া যাবে।'' তার দাবি, ''ইডি যেদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়কে ধরবে, সেদিন পুরো দুর্নীতি সামনে আসবে।'' সিপিএম কর্মীরা এখন বিভিন্ন জেলায় রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন।
ছবি: Abp Photo/Sudipta Bhowmick
বিজেপি, কংগ্রেসের অভিযোগ
বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এসএসসি নিয়ে বিক্ষোভ-মঞ্চে যান। তিনি টুইট করে পার্থ ও অর্পিতা নিয়ে সোচ্চার হন। দিলীপ ঘোষও তাই। কংগ্রেসও এসএসসি কেলেঙ্কারি নিয়ে সোচ্চার হয়েছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
14 ছবি1 | 14
কী করতে পারে সুপ্রিম কোর্ট?
১৯৯৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট একটা নীতিনির্দেশিকা তৈরি করে। সেখানে বলা হয়েছিল, কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অন্যায় কাজ করা, বিচারবিভাগীয় বেনিয়মের অভিযোগ উঠলে কীভাবে তা নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সেই নীতি-নির্দেশিকা বলছে, কোনো বিচারক বা বিচারপতির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলে প্রধান বিচারপতি অভিযুক্তের কাছ থেকে জবাব চাইবেন। যদি তার জবাবে তিনি সন্তুষ্ট না হন অথবা তার মনে হয়, তদন্ত করা দরকার তাহলে তিনি অভ্যন্তরীণ কমিটি গঠন করবেন। সেই কমিটিতে সুপ্রিম কোর্টের একজন ও হাইকোর্টের দুইজন বিচারপতি থাকবেন।
তদন্তের পর যদি কমিটির মনে হয়, যে অভিযোগ করা হয়েছে তা গুরতর এবং তার অপসারণ দরকার, তাহলে তারা প্রধান বিচারপতিকে সেই রিপোর্ট দেবেন। তখন প্রধান বিচারপতি তাকে ইস্তফা দিতে বলবেন।
তিনি পদত্যাগ না করলে প্রধান বিচারপতি সরকারকে জানাবেন, সংসদ তাকে ইমপিচ করতে পারে।
'বিচারবিভাগের দুর্নীতির প্রসঙ্গ গুরুতর'
সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী কপিল সিবাল বলেছেন, বিচারবিভাগের দুর্নীতির প্রসঙ্গটা খুবই গুরুতর বিষয়। এই প্রথম প্রবীণ আইনজীবীরা এই উদ্বেগ জানাচ্ছেন এমন নয়। এটা বেশ কিছু বছর ধরে চলছে।
তার মতে, নিয়োগ প্রক্রিয়া আরো স্বচ্ছ হওয়া দরকার। দুর্নীতি খুবই গুরুতর বিষয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যা বলেছেন ঠিক আছে, কিন্তু দুর্নীতি বেড়েছে।
সাবেক বিচারপতি আর এস সোনি টিভি চ্যানেলে বলেছেন, অভিযুক্ত বিচারপতিকে বদলি করা হয়েছে মানে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হলো। এটা একটা অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। এটা হওয়া উচিত নয়। বিচারপতিরাও আইনের উপরে নয়। তবে তাদের দুর্নীতির উপরে থাকতে হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন প্রধান বিকাশ সিং বলেছেন, বিচারবিভাগের উপর মানুষের আস্থা আছে। তাতে ধাক্কা লাগা উচিত নয়। যদি বিচারপতির বাড়ি থেকে এত টাকা পাওয়া য়ায় এবং তার কোনো ব্যাখ্যা না আসে, তাহলে মানুষের আস্থায় ধাক্কা লাগতেই পারে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী স্বপ্নিল কোটারিও বলেছেন, শুধুমাত্র বদলি করলে বিচারবিভাগের উপর আস্থা ফিরবে না। আমরা অপেক্ষা করব। দেখব সুপ্রিম কোর্ট কী করে। এটা তাদের কাছেও কঠিন পরীক্ষা।