বেশ কিছু দিন করেই বাংলাদেশে ‘টক অফ দ্য কান্ট্রি' আইন, বিচার ও আদালত৷ কখনও ৫৭ ধারা, কখনও বিচারহীনতার সংস্কৃতি, আবার কখনও আদালতের রায় – কোনো না কোনোভাবে আলোচনায় ঘুরে ফিরে আসছে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা৷
বিজ্ঞাপন
৫৭ ধারা নিয়ে তোলপাড় চলছে অনেকদিন ধরেই৷ এই ধারার অপব্যবহার নিয়ে সমালোচনাও হচ্ছে অনেক৷ নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এই ধারা থাকবে না, বলছেন আইনমন্ত্রী৷ কিন্তু বিশেষজ্ঞরা আশংকা করছেন, নতুন আইনেও সংখ্যাটি ৫৭ না হলেও কাছাকাছি ধরনেরই কোনো একটি ধারা থাকবে৷
কিন্তু এই ধারাটির মধ্যেই যে ‘অপব্যবহার' করার সুযোগ লুকিয়ে আছে, সে দায় কার? সংসদ এই আইন বাতিল করছে না, ভালো কথা৷ পুলিশ বুঝেশুনে, তদন্ত করে মামলা নিলেই হলো৷ কিন্তু পুলিশও যদি ‘বিশেষ' কারও ‘ক্ষমতায়' প্রভাবিত হয়ে মামলা নেয়, সেক্ষেত্রে বিচারকরা তো আছেনই৷
কিন্তু অবাক হয়ে দেখতে হচ্ছে, জনগণের ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল বিচারালয়ও কেমন জানি ধারার মারপ্যাঁচে পড়ে আছে৷ যে মামলা সাধারণের মধ্যেই হাসির উদ্রেক করে, সে মামলা কিভাবে আদালত গ্রহণ করে, আর কেনই বা সে মামলায় কারও হাজতবাস হয়, তা বোধগম্য হওয়াটা নিতান্তই কষ্টকর৷
অন্য উদাহরণ থাক৷ ধরা যাক অতিসাম্প্রতিক উদাহরণটাই৷ খুলনার ডুমুরিয়ায় প্রতিমন্ত্রীর বিতরণ করা ছাগলের মৃত্যুর খবর ফেসবুকে শেয়ার করায় এক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করেন আরেক সাংবাদিক৷ এতে নাকি প্রতিমন্ত্রীর মানহানি হয়েছে!
একজন প্রতিমন্ত্রী এবং এক সাংবাদিকের এত ঠুনকো মান থাকাটা যেমন আশ্চর্যের ব্যাপার, তার চেয়েও আশ্চর্যের ব্যাপার মামলার আসামিকে এ কারণে জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোটা৷ পরদিন আসামি জামিন পেলেও ততক্ষণে হেনস্তা করার যে উদ্দেশ্য বাদির ছিল, তা নিশ্চয়ই পূরণ হয়েছে৷
প্রশ্ন হচ্ছে, ৫৭ ধারা জামিন অযোগ্য হলেও কিভাবে বাদি জামিন পেলেন? আর যদি পেলেনই, কেনই বা তাকে এই তুচ্ছ কারণে একদিন হাজতে থাকতে হলো? এতে যারা বরাবরই জেল-জুলুমের ভয় দেখিয়ে আসেন, তারা আরো উৎসাহিতই কি হচ্ছেন না?
এমন হাস্যকর বিষয় শুধু ৫৭ ধারাতেই থেমে থাকলেও হতো৷ ধরা যাক, বরগুনার সদরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গাজী তারিক সালমনের কথাই৷ তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল জামিনযোগ্য ধারাতেই৷ কিন্তু একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাকে, কিভাবে শিশুর পরম মমতায় আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি প্রচারের অপরাধে কারাগারে পাঠালেন বিচারক?
পরবর্তীতে বিচারক জামিন নামঞ্জুর করার কথা অস্বীকার করলেও, ইউএনও বা তার আইনজীবীর বক্তব্যের সাথে অবশ্য বিচারকের বক্তব্যের ব্যাপক গরমিল রয়েছে৷ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও এমন ঘটনায় আশ্চর্য হয়েছেন৷ তারিক সালমনের পদায়ন হয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে, দল থেকে বরখাস্ত হয়েছেন মামলার বাদি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাও৷ কিন্তু কেমন আছেন সেই বিচারক?
ষোড়শ সংশোধনী, অধস্তন বিচারকদের নিয়োগ, বদলি এবং বিচারপতিদের অপসারণ জুডিশিয়াল কাউন্সিলে নাকি সংসদে, এ নিয়েও চলছে চরম দ্বন্দ্ব৷ মুখোমুখি অবস্থানে দেশের আইন ও বিচার বিভাগ৷ এমন দ্বন্দ্ব ও বিতর্ক গঠনমূলক হলে তা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভালোই হওয়ার কথা৷
ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে ব্রিটিশ বিচারক লর্ড ডেনিংয়ের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘‘যদি কাউকে বিশ্বাসই করতে হয়, তবে বিচারকদের করো৷'' কিন্তু একথা অস্বীকারের উপায় নেই যে, আমাদের আদালত যেমন যুগান্তকারী কিছু রায় দিয়েছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে উপরে উল্লিখিত ঘটনারও জন্ম দিয়ে যাচ্ছে৷
সংবিধানের ৭-এর ১ অনুচ্ছেদে বলা আছে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে৷'
প্রশ্ন হচ্ছে, জনগণ কি সত্যিকার অর্থে সেই ক্ষমতার ব্যবহার করতে পারছে? চাইলেই কি নিজের মতপ্রকাশ করতে পারছে জনগণ? সরকার, সংসদ, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, বিচারপতিদের কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারছে?
বিচার অন্ধ, কিন্তু বিচারক অন্ধ হলে চলবে কী করে!
এ বিষয়ে আপনি কী ভাবছেন? মন্তব্য লিখুন নীচের ঘরে৷
বিচার পাওয়ার আশা যেন দুরাশা
‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’ বাংলাদেশে এখন একটি অতি উচ্চারিত শব্দযুগল৷ বিচার হচ্ছে না কিংবা বিচারের অপেক্ষায় আছে এমন কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: dapd
ব্লগার হত্যা
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি টিএসসির সামনে দুর্বৃত্তরা মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করে৷ এরপর একে একে হত্যার শিকার হন ব্লগার নীলাদ্রী নিলয়, অনন্ত বিজয় দাশ, ওয়াশিকুর বাবু, প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন৷ এ সব হত্যাকাণ্ডের কোনোটির বিচারে ‘উল্লেখযোগ্য’ অগ্রগতি না হওয়ায় সম্প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান৷
ছবি: Privat
সাংবাদিক দম্পতি হত্যা
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ভাড়া বাসায় সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনিকে হত্যা করা হয়৷ গত চার বছরে এই মামলার তদন্ত থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ হয়ে র্যাব-এর হাতে পৌঁছেছে৷ গত মে মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘সাম্প্রতিক সময়ে আমরা প্রত্যেক হত্যাকাণ্ড তদন্তের মাধ্যমে তার বিচার করতে পেরেছি৷ সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড অন্য কথা৷ ওটা এখানে না আসাই ভালো৷’’
ছবি: DW
ধর্ষণের বিচার
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে ৬৬০ জন নারী গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ অথচ কোনো ঘটনারই বিচার হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/E. McGregor
ত্বকী হত্যা
নারায়ণগঞ্জ গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তা রফিউর রাব্বির ছেলে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীকে ২০১৩ সালের ৬ মার্চ হত্যা করা হয়৷ হত্যার দুদিন পর শীতলক্ষ্যার একটি খালে তার লাশ পাওয়া যায়৷ রাষ্ট্রের অনিহা থাকায় এই হত্যাকাণ্ডের বিচার থমকে আছে বলে সম্প্রতি অভিযোগ করেন রফিউর রহমান রাব্বি৷ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাংসদ শামীম ওসমানের পরিবারের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: Facebook/Taqi.Mancha
তনু হত্যা
চলতি বছরের ২০ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর মৃতদেহ পাওয়ার পর দেশব্যাপী প্রতিবাদ উঠেছিল৷ দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি উঠেছিল৷ কিন্তু এখনও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি৷ তবে তদন্তকাজ চলছে৷
ছবি: Twitter
শিল্প কারখানায় দুর্ঘটনা
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে সাভারের রানা প্লাজা ধসে এগারশ’র বেশি মানুষের প্রাণ যায়৷ এর মধ্যে বেশিরভাগই পোশাক শ্রমিক ছিল৷ তিন বছরেরও বেশি সময় পর গত জুলাইতে এই ঘটনায় করা হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়৷ ঢাকার এক অনলাইন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৬ বছরে উল্লেখ্যযোগ্য শিল্প দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৮টি৷ এর কোনোটিরই বিচার আজ পর্যন্ত হয়নি৷ প্রতিবেদনটি পড়তে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Reuters
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা
১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর বনানীর ১৭ নম্বর রোডের আবেদীন টাওয়ারে ট্রাম্পস ক্লাবের নীচে চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ ঘটনার দিনই তাঁর ভাই গুলশান থানায় হত্যা মামলা করেছিলেন৷ এই অভিনেতা খুন হওয়ার পর চলচ্চিত্র প্রযোজক ও ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠলেও এখনও মামলার বিচার শুরু করা যায়নি৷ আরও তথ্য জানতে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: bdnews24.com
সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা
২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যের বাজারে আওয়ামী লীগের জনসভা শেষে ফেরার পথে গ্রেনেড হামলায় মারা যান সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ পাঁচজন৷ এ ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা – দু’টিই হবিগঞ্জে দায়ের হলেও পরে সিলেটে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়৷
ছবি: Facebook/Justice-for-Shah-AMS-Kibria
হতাশ রামুর ক্ষতিগ্রস্তরা
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের রামু উপজেলায় কোরআন অবমাননার অভিযোগ তুলে বৌদ্ধপল্লীতে হামলা চালিয়ে ১২টি বৌদ্ধ মন্দির ও ৩০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে একদল লোক৷ ঐ ঘটনার চার বছর পরও মামলা গতিশীল না হওয়ায় হাতাশা প্রকাশ করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা৷ পিপি মমতাজ আহমদ সম্প্রতি বলেন, এই হামলার ঘটনায় দায়ের করা ১৯টি মামলায় ইতোমধ্যেই অভিযোগ গঠন করা হয়েছে৷ আরও তথ্য জানতে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: AFP/Getty Images
নারী নির্যাতনের মামলা ৫,০০৩টি, রায় ৮২০টির
২০১৫ সালে প্রকাশিত মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক জরিপ বলছে, গত নয় বছরে দেশের নয়টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২২,৩৮৬ জন নারী ধর্ষণসহ বিভিন্ন নির্যাতনের ঘটনায় চিকিৎসা নেন৷ এই ঘটনাগুলোর বিচারিক প্রক্রিয়ায় দেখা গেছে এ সব ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র ৫,০০৩টি৷ রায় ঘোষণা হয়েছে ৮২০টি, শাস্তি হয়েছে ১০১ জনের৷ শতকরা হিসাবে রায় ঘোষণার হার ৩.৬৬ এবং সাজা পাওয়ার হার ০.৪৫ শতাংশ৷