‘‘শুধু অপারেশন ক্লিন হার্টের সময় নয়, যে সময়ই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটুক না কেন, সেটা অবৈধ৷'' আর অবৈধ এ সব হত্যাকাণ্ডকে দায়মুক্তি দিয়ে বিগত সরকার যে আইন করেছিল, এবার সেটাকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করল হাইকোর্ট৷
বিজ্ঞাপন
২০০২ সালের ১৬ই অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ই জানুয়ারি পর্যন্ত সেনাবাহিনী, তৎকালীন বিডিআর, পুলিশ, আনসার ও বেসরকারি প্রশাসনের সহায়তায় যৌথ অভিযান পরিচালিত হয়৷ তৎকালীন বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিধান, সন্ত্রাস দমন ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য এই অভিযানের নির্দেশ দেয়৷ পরে ২০০৩ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি যৌথ অভিযানের দায়মুক্তি দিয়ে সংসদে আইন পাশ করে সরকার৷ এরপর গত রবিবার হাইকোর্ট ওই দায়মুক্তিকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করে৷ বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে ডয়চে ভেলের মুখোমুখি হন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল৷
ডিডাব্লিউ: এর আগেও কি কখনও এই ধরনের দায়মুক্তিকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে?
সুলতানা কামাল: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরও একই ঘটনা ঘটেছিল৷ সেক্ষেত্রে হত্যাকারীদের দায়মুক্তি দেয়া হয়েছিল৷ পরে সেই দায়মুক্তিকে অবৈধ ঘোষণা করে আদালত৷ এরপর অবশ্য বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়৷ আর এক্ষেত্রেও ঐ একই ঘটনা ঘটেছে৷ এটা খুবই স্বাভাবিক যে, এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে আর দায়মুক্তি দেয়া যায় না৷ সেটা তো আইন বর্হিভূত, পাশাপাশি অসাংবিধানিকও বটে৷ উচ্চ আদালত সেই কাজটা করেছে৷ যার অর্থ, এখন ওই সময়কার ক্ষতিগ্রস্ত কেউ চাইলে বিচার চাইতে বা ক্ষতিপূরণ চেয়ে আদালতে মামলা করতে পারেন৷
এখনো তো দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে?
শুধু অপারেশন ক্লিন হার্টের সময় নয়, যে কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডই অবৈধ৷ এখনো যেসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে সেগুলোও অবৈধ৷ আমরা হাজার বার বলছি যে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটা উচিত নয়৷ এটা ঘটতে দেয়াও উচিত নয়৷ একটি গণতান্ত্রিক দেশে এভাবে চলতে পারে না৷ এর একটা শেষ হওয়া উচিত৷ আমরা এর অব্যহত প্রতিবাদ করছি৷ আমার মতে, সরকারকে এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে৷ এখানে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগও নেই৷
র্যাব – বিতর্কিত এক বিশেষ বাহিনী
শুরুটা হয়েছিল ২০০৪ সালে৷ সেসময় বাঘা বাঘা জঙ্গিদের কুপোকাত করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় ব়্যাব৷ কিন্তু অসংখ্য ক্রসফায়ার, অপহরণ, হত্যার দায়ে এখন সমালোচিত এই ‘এলিট ফোর্স’৷ র্যাব নিয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Getty Images/AFP
‘এলিট ফোর্স’
বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব নামক ‘এলিট ফোর্স’-এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালে৷ এই বাহিনীর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ‘‘পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমকে আরো গতিশীল ও কার্যকর করার লক্ষ্যে সরকার একটি এলিট ফোর্স গঠনের পরিকল্পনা করে৷’’ তবে এই বাহিনী এখন তুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন মহল৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সমন্বিত বাহিনী
বাংলাদেশ পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে র্যাব গঠন করা হয়৷ এই বাহিনীর উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাস প্রতিরোধ, মাদক চোরাচালান রোধ, দ্রুত অভিযান পরিচালনা এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কার্যক্রমে নিরাপত্তা প্রদান৷
ছবি: Getty Images/AFP
জঙ্গি তৎপরতা দমন
শুরুর দিকের ব়্যাবের কার্যক্রম অবশ্য বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল৷ বিশেষ করে ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে বাংলাদেশে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা উগ্র ইসলামি জঙ্গি তৎপরতা দমনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে র্যাব৷
ছবি: AP
জেএমবির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার
বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় ২০০৫ সালে একসঙ্গে বোমা ফাটিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা জেএমবির শীর্ষ নেতাদের আটক ব়্যাবের উল্লেখযোগ্য সাফল্য৷ ২০০৬ সালের ২ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমান (ছবিতে) এবং ৬ মার্চ সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয় ব়্যাব৷ একাজে অবশ্য পুলিশ বাহিনীও তাদের সহায়তা করেছে৷
ছবি: DW
ভুক্তভোগী লিমন
২০১১ সালে লিমন হোসেন নামক এক ১৬ বছর বয়সি কিশোরের পায়ে গুলি করে এক ব়্যাব সদস্য৷ গুলিতে গুরুতর আহত লিমনের বাম পা উরুর নীচ থেকে কেটে ফেলতে হয়৷ এই ঘটনায় ব়্যাবের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ তবে এখনো সুবিচার পায়নি লিমন৷ উল্টো বেশ কিছুদিন কারাভোগ করেছেন তিনি৷
ছবি: DW
‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’
জঙ্গিবাদ দমনে সাফল্য দেখালেও ক্রসফায়ারের নামে অসংখ্য ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব়্যাবের বিরুদ্ধে সমালোচনা ক্রমশ বাড়তে থাকে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করে জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বাহিনী ‘সিসটেমেটিক’ উপায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে৷
ছবি: DW
‘ক্রসফায়ার’
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ব়্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ২৪ জন৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দাবি অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১১ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে কমপক্ষে সাতশো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ব়্যাব জড়িত ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আলোচিত সাত খুন
২০১৪ সালের মে মাসে ব়্যাবের বিরুদ্ধে ৬ কোটি টাকা ঘুসের বিনিময়ে সাত ব্যক্তিকে অপহরণ এবং খুনের অভিযোগ ওঠে৷ নারায়ণগঞ্জে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিন ব়্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ৷ এই ঘটনার পর ব়্যাবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আবারো বিতর্ক শুরু হয়েছে৷
ছবি: DW
প্রতিষ্ঠাতাই করছেন বিলুপ্তির দাবি
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করেছেন৷ অথচ তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই ‘এলিট ফোর্স’৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিলুপ্তির দাবি নাকচ
বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিক স্তর থেকে ব়্যাবকে বিলুপ্তির দাবি উঠলেও বর্তমান সরকার সেধরনের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না৷ বরং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ব়্যাব বিলুপ্তির দাবি নাকচ করে দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘র্যাবের কোনো সদস্য আইন ভঙ্গ করলে তাদের চিহ্নিত করে বিচারিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়৷’’