‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আদালতের মাধ্যমে এক্সপোজ করুন’
১৭ ডিসেম্বর ২০২১গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারবহির্ভূত হতাকাণ্ডের অভিযোগে গত সপ্তাহে বাংলাদেশের বিশেষায়িত বাহিনী ব়্যাব ও এর সাবেক-বর্তমান সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র৷ এ নিয়ে আলোচনা সমালোচনা চলছে বাংলাদেশে৷
তবে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ মনে করেন বাংলাদেশের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কোন প্রতিবেদনের উপর নির্ভর করার প্রয়োজন পড়ে না৷ ‘ডয়চে ভেলে খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায়' ইউটিউব টকশোতে অংশ নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে মানবাধিকার সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরেই বিচারবহির্ভূত হত্যা গুম নিয়ে বলে আসছে৷ যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক প্রতিবেদনেও তা আছে৷ এসবের উপরে ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ব়্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে৷ এইসব বিষয়ে জানার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অপেক্ষা করার কিছু নেই৷ যুক্তরাষ্ট্রও আজকে প্রথম বলেনি, ২০০৫ সালে ব়্যাব গঠনের পর এই প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেছে বলে আমরা জানি৷’’
ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগের প্রধান খালেদ মুহিউদ্দীনের সঞ্চালনায় ‘বিচারবহির্ভূত খুনের অভিযোগ’ নিয়ে এই আলোচনায় আরেক অতিথি ছিলেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ৷ বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হচ্ছে কীনা তা নিয়েই প্রশ্ন তোলেন তিনি৷ বলেন, ‘‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমরা কী বুঝি- সরকারি কোন বাহিনীর হাতে রাষ্ট্র যে অস্ত্র তুলে দিয়েছে, সেই অস্ত্রের গুলিতে কোনো মানুষ মারা যাচ্ছে কীনা৷... যেখানে অপরাধ, জঙ্গিবাদ বা সংগঠিত অপরাধের মাত্রা বেশি সেখানে সেও যেহেতু অস্ত্র তুলে নিচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনীও অস্ত্র তুলে নিচ্ছে৷ এই প্রতিযোগিতার মধ্যে যারা মারা যাচ্ছেন তাকে কেউ বলছেন বিচারবহির্ভূত হত্যা৷’’
তার মতে, এই ধরনের ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এক ধরনের ‘বয়ান’ দেয় বলেই ‘অবিশ্বাস’ তৈরি হচ্ছে৷ তবে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন বা এই ধরনের হত্যার ক্ষেত্রে' রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতা করছে বলে তিনি মনে করেন না৷ বলেন, ‘‘বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য ব়্যাবের প্রধানের উপর নিষেধাজ্ঞা দিলেন৷ কিন্তু আমি নিশ্চিত ব়্যাবের মহাপরিচালক মাঠে অপারেশন পরিচালনা করেননি৷ বাংলাদেশে প্রতিটি হত্যা হলেই একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়৷ জেলা প্রশাসকের ম্যাজিস্ট্রেট গিয়ে তদন্ত করে৷ তাহলে আমাদের বলতে হবে সব তদন্তই ভুল৷’’
তবে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘‘তদন্ত যারা অভিযুক্ত তারাই করছেন৷’’ একটি মানবাধিকার সংগঠনের পরিসংখ্যানের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘২০০৪ সাল থেকে শুরু করে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে মারা গেছেন চার হাজার ১৪০ জন৷’’
এর প্রতিটি ক্ষেত্রে কি সুষ্ঠু তদন্ত হয়েছে কীনা এমন প্রশ্ন তার৷ তিনি বলেন, ‘‘প্রশ্নটা উঠছে এই কারণে যে এগুলোর যথাযথ কোন তদন্ত হচ্ছে না৷ এগুলোর কোন সুষ্ঠু উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না৷ আন্তর্জাতিক ফোরামে ২০১৯ সালের জুলাই মাসে জেনেভায় কমিটি এগেইনস্ট টর্চার মিটিংয়ে ২১ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো একটা প্রতিবেদন দিয়েছে৷ সেই সমস্ত প্রতিবেদনের পর কিছু রিকমেন্ডেশন ছিল৷ বলা হয়েছিল, আপনারা সুষ্ঠু তদন্ত করুন৷ গুম বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড রহস্যের মতো থেকে যাচ্ছে কারণ আপনি তদন্ত করছেন না৷ আন্তর্জাতিকভাবে যখন বলা হচ্ছে এই তদন্ত করতে সরকার আপত্তি করছে কেন?’’
সার্বভৌমত্বের প্রসঙ্গ টেনে আন্তর্জাতিক তদন্তের বিরোধিতা করেন আব্দুর রশীদ৷ তার মতে, বাংলাদেশের আদালতেই এর সুরাহা হতে পারে৷ এক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের স্বজন বা মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে মামলা করার পরামর্শ তার৷
তিনি বলেন, ‘‘পুলিশ মামলা না নিলে আদালত মামলা নিবে৷ যদি নিম্ন আদালত মামলা না নেয় তাহলে উচ্চতর আদালতে যাবেন৷ এই প্রক্রিয়া কি রাষ্ট্র বন্ধ করেছে?... বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন আছে তারা দুই একটা কেইস আদালতে নিয়ে এসে জনসম্মুখে নিয়ে এসে তদন্ত... এমনকি সরকারি তদন্ত যেমন হয় আমরা গণতদন্তও দেখেছি৷’’
তার দাবি, রাষ্ট্র আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বা এর সদস্যদের কোন ধরনের ইমপিউনিটি বা দায়মুক্তি দেয়নি৷ তবে ড. আলী রীয়াজ মনে করেন আইনের মধ্যে না হলেও সমাজে দায়মুক্তির সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে সরকার৷ যে কারণে সংসদ সদস্যরাও ক্রসফায়ারের পক্ষে কথা বলেন৷
এফএস/এআই