নারায়ণগঞ্জে এলিট বাহিনী র্যাব সদস্যদের হাতে সাতজনকে হত্যা মামলার অভিযোগ-পত্র গ্রহণ করেছে আদালত৷ তাতে র্যাব-এর সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনকে আসামি করা হয়েছে৷ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে পলাতক ৮ জনের বিরুদ্ধেও৷
বিজ্ঞাপন
এই তদন্তে স্পষ্ট হয়েছে যে, ঢাকার দক্ষিণে অবস্থিত ঐ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধের জের ধরে প্রধান আসামি আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন র্যাবকে দিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থক আরেক কাউন্সিলার নজরুলকে খুন করান৷ বলা বাহুল্য, এ ঘটনা র্যাবকে ‘ভাড়াটে বাহিনী' হিসেবে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে৷
গত বছরের ২৭শে এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের লিংক রোড এলাকা থেকে কাউন্সিলার নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ করে র্যাব-১১ কয়েকজন সদস্য৷ তিনদিন পর তাঁদের মৃতদেহ শীতলক্ষ্যা নদীতে পাওয়া যায়৷ হত্যাকাণ্ডের প্রায় এক বছর পর গত ৮ই এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের আদালতে এই মামলার অভিযোগ-পত্র দেন জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ওসি মামনুর রশিদ মণ্ডল৷
অভিযোগ-পত্র গ্রহণের দিন বুধবার সাত খুনের মামলার আসামি সাবেক র্যাব কর্মকর্তা তারেক সাঈদকে নারায়ণগঞ্জের আদালতে হাজির করা হয়৷ আসামিদের মধ্যে ২২ জন গ্রেপ্তার এবং র্যাব-এর ৮ সদস্যসহ ১৩ জনকে পলাতক দেখানো হয় অভিযোগ-পত্রে৷
মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আটকের পর সেখানকার কারাগারেই বন্দি রয়েছেন৷ গতবছর লাশ উদ্ধারের পরপরই নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম অভিযোগ করেন, র্যাবকে ৬ কোটি টাকা দিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে৷ তদন্তে প্রমাণ হয়েছে, ‘‘এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধের জের ধরে আওয়ামী লীগ নেতা ও কাউন্সিলার নূর হোসেন র্যাবকে দিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থক আরেক কাউন্সিলার নজরুলকে খুন করান৷''
র্যাব – বিতর্কিত এক বিশেষ বাহিনী
শুরুটা হয়েছিল ২০০৪ সালে৷ সেসময় বাঘা বাঘা জঙ্গিদের কুপোকাত করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় ব়্যাব৷ কিন্তু অসংখ্য ক্রসফায়ার, অপহরণ, হত্যার দায়ে এখন সমালোচিত এই ‘এলিট ফোর্স’৷ র্যাব নিয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Getty Images/AFP
‘এলিট ফোর্স’
বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব নামক ‘এলিট ফোর্স’-এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালে৷ এই বাহিনীর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ‘‘পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমকে আরো গতিশীল ও কার্যকর করার লক্ষ্যে সরকার একটি এলিট ফোর্স গঠনের পরিকল্পনা করে৷’’ তবে এই বাহিনী এখন তুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন মহল৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সমন্বিত বাহিনী
বাংলাদেশ পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে র্যাব গঠন করা হয়৷ এই বাহিনীর উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাস প্রতিরোধ, মাদক চোরাচালান রোধ, দ্রুত অভিযান পরিচালনা এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কার্যক্রমে নিরাপত্তা প্রদান৷
ছবি: Getty Images/AFP
জঙ্গি তৎপরতা দমন
শুরুর দিকের ব়্যাবের কার্যক্রম অবশ্য বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল৷ বিশেষ করে ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে বাংলাদেশে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা উগ্র ইসলামি জঙ্গি তৎপরতা দমনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে র্যাব৷
ছবি: AP
জেএমবির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার
বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় ২০০৫ সালে একসঙ্গে বোমা ফাটিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা জেএমবির শীর্ষ নেতাদের আটক ব়্যাবের উল্লেখযোগ্য সাফল্য৷ ২০০৬ সালের ২ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমান (ছবিতে) এবং ৬ মার্চ সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয় ব়্যাব৷ একাজে অবশ্য পুলিশ বাহিনীও তাদের সহায়তা করেছে৷
ছবি: DW
ভুক্তভোগী লিমন
২০১১ সালে লিমন হোসেন নামক এক ১৬ বছর বয়সি কিশোরের পায়ে গুলি করে এক ব়্যাব সদস্য৷ গুলিতে গুরুতর আহত লিমনের বাম পা উরুর নীচ থেকে কেটে ফেলতে হয়৷ এই ঘটনায় ব়্যাবের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ তবে এখনো সুবিচার পায়নি লিমন৷ উল্টো বেশ কিছুদিন কারাভোগ করেছেন তিনি৷
ছবি: DW
‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’
জঙ্গিবাদ দমনে সাফল্য দেখালেও ক্রসফায়ারের নামে অসংখ্য ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব়্যাবের বিরুদ্ধে সমালোচনা ক্রমশ বাড়তে থাকে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করে জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বাহিনী ‘সিসটেমেটিক’ উপায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে৷
ছবি: DW
‘ক্রসফায়ার’
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ব়্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ২৪ জন৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দাবি অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১১ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে কমপক্ষে সাতশো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ব়্যাব জড়িত ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আলোচিত সাত খুন
২০১৪ সালের মে মাসে ব়্যাবের বিরুদ্ধে ৬ কোটি টাকা ঘুসের বিনিময়ে সাত ব্যক্তিকে অপহরণ এবং খুনের অভিযোগ ওঠে৷ নারায়ণগঞ্জে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিন ব়্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ৷ এই ঘটনার পর ব়্যাবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আবারো বিতর্ক শুরু হয়েছে৷
ছবি: DW
প্রতিষ্ঠাতাই করছেন বিলুপ্তির দাবি
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করেছেন৷ অথচ তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই ‘এলিট ফোর্স’৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিলুপ্তির দাবি নাকচ
বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিক স্তর থেকে ব়্যাবকে বিলুপ্তির দাবি উঠলেও বর্তমান সরকার সেধরনের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না৷ বরং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ব়্যাব বিলুপ্তির দাবি নাকচ করে দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘র্যাবের কোনো সদস্য আইন ভঙ্গ করলে তাদের চিহ্নিত করে বিচারিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়৷’’
ছবি: Getty Images/AFP
10 ছবি1 | 10
এদিকে বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র বা আসক-এর প্রতিবেদনে জানা যায়, গত বছরের প্রথম আট মাসে র্যাবসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বাংলাদেশে মোট ১১৩টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে৷ ২০১৩ সালে ১৭৯টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল৷
আসক-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত মোট ৩৫টি গুমের ঘটনা ঘটেছে, যার সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জড়িত বলেও দাবি করা হয়৷
আসক-এর পরিচালক নূর খান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় এটা প্রামণিত যে, ওই র্যাব সদস্যরা ভাড়াটে হিসেবে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়৷ আর অর্থের বিনিময়ে একপক্ষের হয়ে প্রতিপক্ষের লোকজনকে হত্যা করে তারা৷ এটা একটি বাহিনীর অবস্থান এবং নৈতিক ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে৷''
তিনি বলেন, ‘‘এটা শুধু নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় নয়৷ আরো অনেক ঘটনায় র্যাব সদস্যদের ভাড়ায় খাটার অভিযোগ আছে৷ তবে তদন্ত প্রক্রিয়া একপেশে হওয়ায় তা অনেক সময় প্রমাণ হয় না৷ এবার জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তদন্তের মাধ্যমে তা প্রকাশ হলো৷''
নূর খান বলেন, ‘‘র্যাব-এর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এখনো কমেনি৷ তার ওপর এই বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে ব্যবহার করায় তারা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে৷ তাদের আর কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় না৷ তাই এই সুযোগে নিজেদের ফায়দাও লুটে নেয় তারা, নারায়ণগঞ্জের ঘটনা যার বড় প্রমাণ৷ এখানে ক্ষমতাসীন দলের এক কাউন্সিলার ক্ষমতাসীন দলের আরেক কাউন্সিলারকে অর্থের বিনিময়ে ব়্যাব সদস্যদের দিয়ে হত্যা করিয়েছে৷''