মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও গতিশীল নাগরিকদের দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমকে অন্যতম মানবাধিকার সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়৷
বিজ্ঞাপন
বৃহস্পতিবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ২০১৪ সালের মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ করে৷ ওয়াশিংটনের ঐ অফিসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি এই বার্ষিক প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন৷ জন কেরির কথায়, ‘‘যখন কোনো দেশের নাগরিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার ও স্বাধীনতা সম্পূর্ণভাবে ভোগ করতে পারে, তখনই একটি দেশকে ভালো বলা যায়৷ কিন্তু বর্তমান বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ এবং সহিংসতা মানবাধিকারের জন্য প্রধান হুমকি হয়ে উঠেছে৷''
শুরুটা হয়েছিল ২০০৪ সালে৷ সেসময় বাঘা বাঘা জঙ্গিদের কুপোকাত করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় ব়্যাব৷ কিন্তু অসংখ্য ক্রসফায়ার, অপহরণ, হত্যার দায়ে এখন সমালোচিত এই ‘এলিট ফোর্স’৷ র্যাব নিয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Getty Images/AFP
‘এলিট ফোর্স’
বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব নামক ‘এলিট ফোর্স’-এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালে৷ এই বাহিনীর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ‘‘পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমকে আরো গতিশীল ও কার্যকর করার লক্ষ্যে সরকার একটি এলিট ফোর্স গঠনের পরিকল্পনা করে৷’’ তবে এই বাহিনী এখন তুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন মহল৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সমন্বিত বাহিনী
বাংলাদেশ পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে র্যাব গঠন করা হয়৷ এই বাহিনীর উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাস প্রতিরোধ, মাদক চোরাচালান রোধ, দ্রুত অভিযান পরিচালনা এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কার্যক্রমে নিরাপত্তা প্রদান৷
ছবি: Getty Images/AFP
জঙ্গি তৎপরতা দমন
শুরুর দিকের ব়্যাবের কার্যক্রম অবশ্য বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল৷ বিশেষ করে ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে বাংলাদেশে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা উগ্র ইসলামি জঙ্গি তৎপরতা দমনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে র্যাব৷
ছবি: AP
জেএমবির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার
বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় ২০০৫ সালে একসঙ্গে বোমা ফাটিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা জেএমবির শীর্ষ নেতাদের আটক ব়্যাবের উল্লেখযোগ্য সাফল্য৷ ২০০৬ সালের ২ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমান (ছবিতে) এবং ৬ মার্চ সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয় ব়্যাব৷ একাজে অবশ্য পুলিশ বাহিনীও তাদের সহায়তা করেছে৷
ছবি: DW
ভুক্তভোগী লিমন
২০১১ সালে লিমন হোসেন নামক এক ১৬ বছর বয়সি কিশোরের পায়ে গুলি করে এক ব়্যাব সদস্য৷ গুলিতে গুরুতর আহত লিমনের বাম পা উরুর নীচ থেকে কেটে ফেলতে হয়৷ এই ঘটনায় ব়্যাবের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ তবে এখনো সুবিচার পায়নি লিমন৷ উল্টো বেশ কিছুদিন কারাভোগ করেছেন তিনি৷
ছবি: DW
‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’
জঙ্গিবাদ দমনে সাফল্য দেখালেও ক্রসফায়ারের নামে অসংখ্য ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব়্যাবের বিরুদ্ধে সমালোচনা ক্রমশ বাড়তে থাকে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করে জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বাহিনী ‘সিসটেমেটিক’ উপায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে৷
ছবি: DW
‘ক্রসফায়ার’
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ব়্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ২৪ জন৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দাবি অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১১ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে কমপক্ষে সাতশো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ব়্যাব জড়িত ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আলোচিত সাত খুন
২০১৪ সালের মে মাসে ব়্যাবের বিরুদ্ধে ৬ কোটি টাকা ঘুসের বিনিময়ে সাত ব্যক্তিকে অপহরণ এবং খুনের অভিযোগ ওঠে৷ নারায়ণগঞ্জে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিন ব়্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ৷ এই ঘটনার পর ব়্যাবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আবারো বিতর্ক শুরু হয়েছে৷
ছবি: DW
প্রতিষ্ঠাতাই করছেন বিলুপ্তির দাবি
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করেছেন৷ অথচ তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই ‘এলিট ফোর্স’৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিলুপ্তির দাবি নাকচ
বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিক স্তর থেকে ব়্যাবকে বিলুপ্তির দাবি উঠলেও বর্তমান সরকার সেধরনের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না৷ বরং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ব়্যাব বিলুপ্তির দাবি নাকচ করে দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘র্যাবের কোনো সদস্য আইন ভঙ্গ করলে তাদের চিহ্নিত করে বিচারিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়৷’’
ছবি: Getty Images/AFP
10 ছবি1 | 10
মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার'-এর বরাত দিয়ে জানানো হয়, গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত মোট ৩৫টি গুমের ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে৷ এগুলির সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জড়িত বলেও দাবি করা হয়৷ এছাড়া প্রতিবেদনে ধর্মীয় ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে অন্তঃকোন্দলের বিষয়টিকেও সমস্যা বলে উল্লেখ করা হয়৷ শুধু তাই নয়, সংবাদমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ, নাজুক শ্রম অধিকার পরিস্থিতি ও অনলাইনে মত প্রকাশের সীমাবদ্ধতাকেও বাংলাদেশের অন্যতম সমস্যা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় প্রতিবেদনে৷ বলা হয়, বিভিন্ন বেসরকারি সাহায্য সংগঠন বা এনজিও তাদের কার্যক্রম পরিচালনায় বাংলাদেশে ক্রমাগত বাধার সম্মুখিন হচ্ছে৷
মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনের ব্যাপারে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক এবং মানবাধিকার নেতা নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই প্রতিবেদনে যে পরিস্থিতির কথা বলা হয়েছে, তা যথার্থ৷'' তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ উদার, গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ৷ কিন্তু শাসন ব্যবস্থা বা শাসকরা যখন এর বিপরীতে অবস্থান নেয়, তখন এক অসহনীয় পরিবেবেশের সৃষ্টি হয়৷ বাংলদেশেও তাই হয়েছে৷''
তার কথায়, ‘‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুম এখন যেন একটি স্বাভাবিক ঘটনা বাংলাদেশে৷ আগের সরকারের আমলে হয়েছে, এখনো হচ্ছে, থামছে না৷ তার ওপর এখন নতুন করে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের গুমের ঘটনা৷ কাউকে কাউকে আবার অপহরণের কয়েক মাস পর অস্ত্র বা বোমাসহ গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে৷''
নূর খান বলেন, ‘‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা রাজনৈতিকভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন৷ তাই পরিস্থিতি অনুযায়ী সংখ্যালঘু নির্যাতন বাড়ে, আবার কমে৷ একইভাবে রাজনৈতিক কারণেও বাড়ে পেট্রোল বোমার ব্যবহার, যার শিকার হন সাধারণ মানুষ৷''
তিনি জানান, ‘‘শুধু এনজিও বা মানবাধিকার সংগঠন নয়, যাঁরাই সরকারের সমালোচনা করেন, তাঁরাই সরকারের নিয়ন্ত্রণ বা চাপের মুখে পড়েন৷ সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিকরা এর বাইরে নয়৷''
নূর খানের মতে, ‘‘বাংলাদেশের বর্তমান শাসন ব্যবস্থায় গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা প্রকটভাবে অনুপস্থিত৷''
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইকোনোমিকস অ্যান্ড পিস-এর ‘গ্লোবাল পিস ইনডেক্স' (জিপিআই) অনুসারে, দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে তৃতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ৷ বাংলাদেশের পরের অবস্থানে রয়েছে শ্রীলঙ্কা, ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান৷ বাংলাদেশের আগের অবস্থান ভুটান ও নেপালের৷ এছাড়া বিশ্বের ১৬২টি দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম৷ শান্তির সূচকে যুক্তরাষ্ট্রের (৯৪) চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ৷ চলতি সপ্তাহে এই রিপোর্টটিও প্রকাশ করা হয়৷