র্যাব কীভাবে ‘ক্রসফায়ারের নামে' মানুষ হত্যা করে, তা এক সিনিয়র কর্মকর্তার বয়ানে প্রকাশ করে সুইডিশ রেডিও৷ এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে৷ এবার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য অ্যানথেয়া ম্যাকিনটায়ার এই আহ্বান জানান৷ রাজনৈতিক বিরোধীদের নিয়মিত হত্যার বিষয়ে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-এর এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার আলোচনার প্রমাণ হাতে রয়েছে বলে সুইডেনের জাতীয় রেডিও দাবি করার পর ওয়েস্ট মিডল্যান্ডের কনজারভেটিভ দলের এই এমপি এমন আহ্বান জানান৷
বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের বিতর্কে ম্যাকিনটায়ার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানান৷ তিনি বলেন, ‘‘রেকর্ডিং অনুসারে একজন ব্যক্তিকে তুলে নেওয়া, তাকে হত্যা করা এবং লাশ গুম করে দেওয়ার জন্য র্যাব কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হতো৷ আর যাদের তুলে নেওয়া হতো, তারা প্রধানত বিরোধী দলের সদস্য৷'' এ বিষয়ে স্বতন্ত্র তদন্ত কমিশন গঠন করতে বাংলাদেশ সরকারের উপর চাপ দিতে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ও ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটিকে চাপ দেওয়ার আহ্বান জানান মাকিনটায়ার৷ র্যাব অবশ্য সুইডিশ রেডিওর ওই প্রতিবেদনকে ‘অস্পষ্ট' এবং ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার প্রচেষ্টা হিসেব উল্লেখ করেছে৷
প্রসঙ্গটি নিয়ে ফেসবুকেও কয়েকজন কথা বলেছেন৷ রিফাত হাসান লিখেছেন, ‘‘র্যাব নিয়ে আলাদাভাবে কিছু বলার নেই৷ র্যাব না থাকলেও কিছু হয় না, বিলুপ্ত হলেও না৷ বাংলাদেশে এখন সব সরকারি বাহিনীই র্যাবের পাশাপাশি খুনে বাহিনী হিসেবে নিজেদের সর্বোচ্চ কৃতিত্ব দেখিয়েছে৷ সর্বসাম্প্রতিক নুরুল আলম হত্যার ব্যাপারে পুলিশের দিকেই অভিযোগ৷ ফলত র্যাব বিলুপ্ত হলে সরকার বরং আরো ক্লিন ইমেজে বাকি বাহিনীগুলো দিয়েই তৎপর রাজনৈতিক কর্মীদের গুপ্তহত্যা, গুম ও নির্যাতন চালিয়ে যেতে পারবে৷ শুধু র্যাব বিলুপ্তি নয়, দরকার অন্য কিছু৷''
রুপন আজিজ লিখেছেন, ‘‘র্যাব, পুলিশ নিরীহ মানুষদের গুম করে এত দিন কোনো হদিস দিতোনা, সেসব পুরানো খবর৷ নতুন খুশির খবর হলো, এ সব অপহৃত মানুষকে কোনো জঙ্গি হামলায় নাম ঢুকিয়ে হয় মেরে ফেলা হয়, নয়ত গ্রেফতার করা হয়৷''
র্যাব – বিতর্কিত এক বিশেষ বাহিনী
শুরুটা হয়েছিল ২০০৪ সালে৷ সেসময় বাঘা বাঘা জঙ্গিদের কুপোকাত করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় ব়্যাব৷ কিন্তু অসংখ্য ক্রসফায়ার, অপহরণ, হত্যার দায়ে এখন সমালোচিত এই ‘এলিট ফোর্স’৷ র্যাব নিয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Getty Images/AFP
‘এলিট ফোর্স’
বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব নামক ‘এলিট ফোর্স’-এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালে৷ এই বাহিনীর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ‘‘পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমকে আরো গতিশীল ও কার্যকর করার লক্ষ্যে সরকার একটি এলিট ফোর্স গঠনের পরিকল্পনা করে৷’’ তবে এই বাহিনী এখন তুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন মহল৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সমন্বিত বাহিনী
বাংলাদেশ পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে র্যাব গঠন করা হয়৷ এই বাহিনীর উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাস প্রতিরোধ, মাদক চোরাচালান রোধ, দ্রুত অভিযান পরিচালনা এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কার্যক্রমে নিরাপত্তা প্রদান৷
ছবি: Getty Images/AFP
জঙ্গি তৎপরতা দমন
শুরুর দিকের ব়্যাবের কার্যক্রম অবশ্য বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল৷ বিশেষ করে ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে বাংলাদেশে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা উগ্র ইসলামি জঙ্গি তৎপরতা দমনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে র্যাব৷
ছবি: AP
জেএমবির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার
বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় ২০০৫ সালে একসঙ্গে বোমা ফাটিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা জেএমবির শীর্ষ নেতাদের আটক ব়্যাবের উল্লেখযোগ্য সাফল্য৷ ২০০৬ সালের ২ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমান (ছবিতে) এবং ৬ মার্চ সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয় ব়্যাব৷ একাজে অবশ্য পুলিশ বাহিনীও তাদের সহায়তা করেছে৷
ছবি: DW
ভুক্তভোগী লিমন
২০১১ সালে লিমন হোসেন নামক এক ১৬ বছর বয়সি কিশোরের পায়ে গুলি করে এক ব়্যাব সদস্য৷ গুলিতে গুরুতর আহত লিমনের বাম পা উরুর নীচ থেকে কেটে ফেলতে হয়৷ এই ঘটনায় ব়্যাবের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ তবে এখনো সুবিচার পায়নি লিমন৷ উল্টো বেশ কিছুদিন কারাভোগ করেছেন তিনি৷
ছবি: DW
‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’
জঙ্গিবাদ দমনে সাফল্য দেখালেও ক্রসফায়ারের নামে অসংখ্য ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব়্যাবের বিরুদ্ধে সমালোচনা ক্রমশ বাড়তে থাকে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করে জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বাহিনী ‘সিসটেমেটিক’ উপায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে৷
ছবি: DW
‘ক্রসফায়ার’
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ব়্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ২৪ জন৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দাবি অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১১ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে কমপক্ষে সাতশো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ব়্যাব জড়িত ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আলোচিত সাত খুন
২০১৪ সালের মে মাসে ব়্যাবের বিরুদ্ধে ৬ কোটি টাকা ঘুসের বিনিময়ে সাত ব্যক্তিকে অপহরণ এবং খুনের অভিযোগ ওঠে৷ নারায়ণগঞ্জে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিন ব়্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ৷ এই ঘটনার পর ব়্যাবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আবারো বিতর্ক শুরু হয়েছে৷
ছবি: DW
প্রতিষ্ঠাতাই করছেন বিলুপ্তির দাবি
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করেছেন৷ অথচ তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই ‘এলিট ফোর্স’৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিলুপ্তির দাবি নাকচ
বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিক স্তর থেকে ব়্যাবকে বিলুপ্তির দাবি উঠলেও বর্তমান সরকার সেধরনের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না৷ বরং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ব়্যাব বিলুপ্তির দাবি নাকচ করে দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘র্যাবের কোনো সদস্য আইন ভঙ্গ করলে তাদের চিহ্নিত করে বিচারিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়৷’’