মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার' বলছে, বাংলাদেশে চলতি বছরের প্রথম চারমাসে ক্রসফায়ারসহ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৭৩ জন৷ এই সংখ্যা গত বছরের প্রথম ছয় মাসের সমান৷
বিজ্ঞাপন
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের বছর ২০১৩ সালে ক্রসফায়ারের যে হার তার সঙ্গে এবারের হার প্রায় কাছাকাছি৷
অধিকার জানিয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল, এই চারমাসে ক্রসফায়ারে ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনে ৭৩ জন নিহত হয়েছে৷ অধিকারের হিসাব মতে, ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৫৪, ২০১৬ সালে ১৭৮, ২০১৫ সালে ১৮৬, ২০১৪ সালে ১৭২ এবং ২০১৩ সালে ৩২৯ জন নিহত হয়েছে৷
অধিকারের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত বছর ছয়মাসে ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে ৭৭ জন৷ চলতি বছরের প্রথম চারমাসেই তা গতবছরের ছয় মাসের সমান৷ নির্বাচনের আগের বছর ২০১৩ সালে প্রতিমাসে গড়ে ২৭ জন ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে৷ চলতি বছরেও প্রতিমাসে আগের বছরগুলোর তুলনায় ক্রসফায়ারে নিহতের হার বাড়ছে৷ এই হার প্রায় ১৯ জন৷ ২০১৩ সালের হারের পরই এর অবস্থান৷
‘এবছর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আবার বেড়ে যাচ্ছে এটা এলার্মিং’
অধিকারের পরিচালক নাসিরউদ্দিন এলান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এ বছর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আবার বেড়ে যাচ্ছে৷ এটা অ্যালার্মিং৷ ২০১৩ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অনেক বেশি ছিল৷ পরের বছরগুলোতে আবার কমে আসে৷ ২০১৪ সালে বিতর্কিত নির্বাচনের আগের বছর অনেক রাজনৈতিক নেতা-কর্মীও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছে৷ দমন, নির্যাতনের পরিস্থিতি ছিল তখন৷ এবছর আবার জাতীয় নির্বাচন হবে৷ তবে সে কারণে বিচারবহির্ভূত হত্যা বেড়ে যাচ্ছে কিনা তা বলার সময় এখনো আসেনি৷''
তবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বাড়ার প্রবণতার সঙ্গে নির্বাচনের সম্পর্ক দেখেন মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ক্রসফায়ার বেড়ে যাচ্ছে৷ গত বছরের প্রথম ছয়মাসের তুলনায় এবার তা চারমাসেই হয়েছে৷ আর যদি নির্বাচনের বছর ২০১৩-১৪ সালকে এই বছরের প্রবণতার সঙ্গে তুলনা করি তাহলে মিল পাই৷ তার মানে হলো যখন নির্বাচন সামনে আসে তখন এক ধরণের পরিস্থিতি তৈরি করা হয় বা তৈরি হয়, যে পরিস্থিতিতে নির্যাতন, ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেড়ে যায়৷''
তিনি বলেন, ‘‘এটা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, নির্বাচনকে সামনে রেখে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম বেড়ে যাচ্ছে৷ পরিসংখ্যান এটাই বলছে৷ এই বেড়ে যাওয়ার কারণ হল একটা ভয়ার্ত পরিবেশ তৈরি করা৷ যে পরিবেশের মাধ্যমে মানুষের বাকস্বাধীনতা ও সংগঠিত হওয়ার অধিকার ক্ষুন্ন করা যায় বা সংকুচিত করা যায় তার একটা চেষ্টা হতে পারে৷''
তবে মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকারের' মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিবেদনগুলোকে যথার্থ মনে করেন না বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু৷ তিনি বাংলাদেশের বাকস্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে, এই সংক্রান্ত মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক রিপোর্টের প্রতিক্রিয়ায় সম্প্রতি বলেন, ‘‘এ রিপোর্টে যে বেসরকারি সংস্থাগুলোর বরাত দেওয়া হয়েছে, তাদের বক্তব্যও পরস্পরবিরোধী৷ এদের মধ্যে একটির নাম ‘অধিকার'৷ ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকায় হেফাজতের সমাবেশ শেষে তারা হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল বলে প্রতিবেদন দেওয়ার পর তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে তালিকা চাওয়া হয়েছিল৷ এনজিও অধিকার তালিকা দিতে ব্যর্থ হয়৷ এমন এনজিওর বরাতে তৈরি প্রতিবেদন সঠিক হওয়ার কথা নয়৷''
গত ২০ এপ্রিল বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতায় নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্র৷ মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২০১৭ সালের বার্ষিক কংগ্রেশনাল-ম্যান্ডেটেড হিউম্যান রাইটস রিপোর্টে এই উদ্বেগের কথা তুলে ধরা হয়৷ এতে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে উদ্বেগ জানানোর পাশাপাশি ২০১৭ সালে বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা সংকুচিত হওয়ার কথা বলা হয়৷
২০১৪ সালের এই ছবিঘরটি দেখুন...
র্যাব – বিতর্কিত এক বিশেষ বাহিনী
শুরুটা হয়েছিল ২০০৪ সালে৷ সেসময় বাঘা বাঘা জঙ্গিদের কুপোকাত করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় ব়্যাব৷ কিন্তু অসংখ্য ক্রসফায়ার, অপহরণ, হত্যার দায়ে এখন সমালোচিত এই ‘এলিট ফোর্স’৷ র্যাব নিয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Getty Images/AFP
‘এলিট ফোর্স’
বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব নামক ‘এলিট ফোর্স’-এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালে৷ এই বাহিনীর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ‘‘পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমকে আরো গতিশীল ও কার্যকর করার লক্ষ্যে সরকার একটি এলিট ফোর্স গঠনের পরিকল্পনা করে৷’’ তবে এই বাহিনী এখন তুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন মহল৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সমন্বিত বাহিনী
বাংলাদেশ পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে র্যাব গঠন করা হয়৷ এই বাহিনীর উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাস প্রতিরোধ, মাদক চোরাচালান রোধ, দ্রুত অভিযান পরিচালনা এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কার্যক্রমে নিরাপত্তা প্রদান৷
ছবি: Getty Images/AFP
জঙ্গি তৎপরতা দমন
শুরুর দিকের ব়্যাবের কার্যক্রম অবশ্য বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল৷ বিশেষ করে ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে বাংলাদেশে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা উগ্র ইসলামি জঙ্গি তৎপরতা দমনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে র্যাব৷
ছবি: AP
জেএমবির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার
বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় ২০০৫ সালে একসঙ্গে বোমা ফাটিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা জেএমবির শীর্ষ নেতাদের আটক ব়্যাবের উল্লেখযোগ্য সাফল্য৷ ২০০৬ সালের ২ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমান (ছবিতে) এবং ৬ মার্চ সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয় ব়্যাব৷ একাজে অবশ্য পুলিশ বাহিনীও তাদের সহায়তা করেছে৷
ছবি: DW
ভুক্তভোগী লিমন
২০১১ সালে লিমন হোসেন নামক এক ১৬ বছর বয়সি কিশোরের পায়ে গুলি করে এক ব়্যাব সদস্য৷ গুলিতে গুরুতর আহত লিমনের বাম পা উরুর নীচ থেকে কেটে ফেলতে হয়৷ এই ঘটনায় ব়্যাবের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ তবে এখনো সুবিচার পায়নি লিমন৷ উল্টো বেশ কিছুদিন কারাভোগ করেছেন তিনি৷
ছবি: DW
‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’
জঙ্গিবাদ দমনে সাফল্য দেখালেও ক্রসফায়ারের নামে অসংখ্য ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব়্যাবের বিরুদ্ধে সমালোচনা ক্রমশ বাড়তে থাকে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করে জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বাহিনী ‘সিসটেমেটিক’ উপায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে৷
ছবি: DW
‘ক্রসফায়ার’
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ব়্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ২৪ জন৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দাবি অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১১ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে কমপক্ষে সাতশো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ব়্যাব জড়িত ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আলোচিত সাত খুন
২০১৪ সালের মে মাসে ব়্যাবের বিরুদ্ধে ৬ কোটি টাকা ঘুসের বিনিময়ে সাত ব্যক্তিকে অপহরণ এবং খুনের অভিযোগ ওঠে৷ নারায়ণগঞ্জে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিন ব়্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ৷ এই ঘটনার পর ব়্যাবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আবারো বিতর্ক শুরু হয়েছে৷
ছবি: DW
প্রতিষ্ঠাতাই করছেন বিলুপ্তির দাবি
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করেছেন৷ অথচ তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই ‘এলিট ফোর্স’৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিলুপ্তির দাবি নাকচ
বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিক স্তর থেকে ব়্যাবকে বিলুপ্তির দাবি উঠলেও বর্তমান সরকার সেধরনের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না৷ বরং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ব়্যাব বিলুপ্তির দাবি নাকচ করে দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘র্যাবের কোনো সদস্য আইন ভঙ্গ করলে তাদের চিহ্নিত করে বিচারিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়৷’’