গাইবান্ধার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীকে ক্লাসের মধ্যে যৌন হয়রানি করেন প্রধান শিক্ষক আয়নাল হক৷ এতে সাময়িকভাবে বরখাস্ত হলেও, তার বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷ এমনকি তাকে গ্রেপ্তারও করেনি পুলিশ৷
বিজ্ঞাপন
গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার উদাখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই ঘটনাই নয়, দেশের প্রতিটি স্কুলের অবস্থাও তথৈবচ৷ জানা যায়, ঘটনার পর প্রথম কয়েকদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকেন অভিযুক্ত শিক্ষক৷ তারপর আবারো ফিরে আসেন, যোগ দেন চাকরিতে৷ তিনিই স্কুলের প্রধান শিক্ষক, তাই হুমকি-ধামকি দিয়ে সবাইকে চুপ করিয়ে দেন৷ স্থানীয় প্রভাবশালীরাও অভিযুক্তের পক্ষ নেন৷ তাই বিপদে পড়ে ভুক্তভোগী পরিবার৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সাদেকা হালিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘স্কুল-কলেজ বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতন নতুন কিছু নয়৷ আমরা এখনও যেসব পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ করছি বা যেসব পুরুষ শিক্ষক ছাত্রীদের পড়াচ্ছেন, তাদের অনেকেই ছাত্রীকে ছাত্রী হিসেবে দেখেন না৷ ফলে তাদের হাতে ছাত্রীরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে৷ ২০০৯ সালে উচ্চ আদালতের একটি রায় আছে৷ সেখানে বলা আছে যে, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি থাকতে হবে৷ কিন্তু অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই সেটি নেই, প্রাইমারি স্কুল তো দূরের কথা৷ জেলা প্রশাসকরা এ নিয়ে একটি কমিটি করতে পারেন৷ তা-ও করেন না৷''
শিশুদের নিয়ে মন খারাপ করা কিছু খবর
বাংলাদেশে ২০১৩ সালে প্রণীত শিশু আইন অনুযায়ী, ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সকলকে শিশু বলে গণ্য করা হয়৷ শিশুদের নিয়ে ছবিঘরে থাকছে এমন কিছু তথ্য, যা পড়ে আপনার মন খারাপ হতে বাধ্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সাত মাসে ৬১ গণধর্ষণ
শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন ২৬৭টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ‘বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম’ এর হিসেবে, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে ৬১টি শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছে৷ সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এই তথ্য জানায় ফোরামটি৷ একই সময়ে ধর্ষণ, উত্ত্যক্তসহ যৌন সহিংসতার শিকার হয় ৩৪৭টি শিশু৷ এর মধ্যে চারটি ছেলেশিশুও রয়েছে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
বয়স ১৫ হওয়ার আগেই বিয়ে
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশে গড়ে ২৯ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় তাদের বয়স ১৫ পার হওয়ার আগে৷ আর ৬৫ শতাংশের বিয়ে হয় বয়স ১৮ পার হওয়ার আগে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশু
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৪৫ লাখেরও বেশি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত৷ এর মধ্যে প্রায় ১৭ লাখেরও বেশি শিশুর বাস খোদ ঢাকা শহরে৷ বাংলাদেশ সরকার ঝুঁকিপূর্ণ ৩৮টি কাজে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করলেও আদতে তা মানা হচ্ছে না৷ সরকারিভাবে নেই কোনো নজরদারির ব্যবস্থা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
কিশোর অপরাধী
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিবছর কমপক্ষে দুই হাজার শিশুকে নানা অপরাধে আটক করা হয়৷ শিশু অধিকার ফোরামের হিসেবে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ২৭৬ জন শিশুকে অস্ত্র ও মাদক বহনসহ নানা অভিযোগে আটক করা হয়৷
ছবি: bilderbox
মাত্র তিনটি
আইন অনুযায়ী শিশু-কিশোর অপরাধীদের বিচার করা হয় কিশোর আদালতে৷ এরপর বিচার শেষে শাস্তি ভোগের জন্য তাদের শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর কথা৷ কিন্তু বাংলাদেশে এমন কেন্দ্র আছে মাত্র তিনটি৷ গাজীপুরে দু’টি এবং যশোরে একটি৷ এর মধ্যে গাজীপুরের একটি মেয়েদের জন্য৷ সব মিলিয়ে এই তিনটির ধারণ ক্ষমতা ৬০০৷ অর্থাৎ আটক শিশুদের বড় একটি অংশের জায়গা উন্নয়ন কেন্দ্রে হয় না৷ ফলে তাদের কারাগারে থাকতে হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
5 ছবি1 | 5
সাদেকা হালিম বলেন, ‘‘কোনো ঘটনা মিডিয়াতে আসলে তার বিচার হয়৷ কিন্তু ক'টি ঘটনাই বা মিডিয়াতে আসে? ফলে অধিকাংশ ঘটনারই কোনো বিচার হয় না৷ এই বিচারহীনতার সংস্কৃতিই যৌন নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে৷ বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা গেলে স্কুল-কলেজ বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব হতো৷''
গত ২২শে ফেব্রুয়ারি রাজধানীর অদূরে খালিশপুর আলিম মডেল মাদ্রাসার নবম শ্রেণির এক ছাত্রী মাদ্রাসার শিক্ষক আব্দুর রউফের কাছে প্রাইভেট পড়তে যায়৷ কিন্তু সেসময় শিক্ষক উপস্থিত না থাকায় সে যখন ফিরে যাচ্ছিল, তখন মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা শফিকুর রহমান তাকে কৌশলে মাদ্রাসা সংলগ্ন নিজের বাসায় ডেকে নেন এবং এক পর্যায়ে ধর্ষণ করেন৷ বিষয়টি জানাজানি হলে শফিকুর রহমানের গ্রেপ্তারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়৷ কিন্তু পুলিশ এখনো তাকে গ্রেপ্তার করেনি৷ আর সেই সুযোগে এখন তিনি লাপাত্তা৷
নারায়ণগঞ্জ বন্দরে গত মে মাসে প্রাইভেট পড়তে গিয়ে আরেক মাদ্রাসা ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়৷ ঐ সময় এলাকাবাসী ধর্ষক, মাদ্রাসা শিক্ষক হাফেজ শাহ আলমকে আটক করে পুলিশকে সোপর্দ করেন৷ ঘটনাটি ঘটে আদর্শ কিন্ডারগার্টেন মাদ্রসার শিক্ষকের কক্ষে৷ এ ঘটনায় ধর্ষিতার পিতা বাদি হয়ে থানায় একটি মামলা দায়ের করেন৷ মামলায় কিছু দিন কারাগারে থাকার পর জামিনে মুক্তি পান ধর্ষক শিক্ষক৷ এখন তিনি উল্টে ছাত্রীর পরিবারকেই হুমকি দিচ্ছেন৷ আর শাহ আলমের পক্ষ নিয়ে মাঠে নেমেছেন এলাকার প্রভাবশালীরা৷
সাদেকা হালিম
গেল বছরের জুলাই মাসে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার শৌলখালীর সুহাসিনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির এক ছাত্রী ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষক পরবন্ধু হালদার হাতে ধর্ষিত হয়৷ কৌশলে ছাত্রীকে নিজের কক্ষে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করেছিলেন শিক্ষক ৷ ভয়ে ছাত্রীটি বিষয়টা প্রথমে কাউকে বলতে পারেনি৷ পরে যখন তার শারীরিক সমস্যা দেখা দেয় তখন সে তার মাকে বিষয়টি জানায়৷ বিষয়টি জানাজানি হলে শিক্ষক পালিয়ে যান৷ এখনো তাকে ধরা যায়নি৷ উল্টে ফোনে ধর্ষিত ছাত্রীর পরিবারকে আজও হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন ঐ শিক্ষক৷
বাংলাদেশে এ ধরনের অসংখ্য ছাত্রী-ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে৷ কিন্তু কোনো ঘটনারই সঠিক বিচার হচ্ছে না৷ মাদ্রাসাগুলোর অবস্থা আরো খারাপ৷ সেখানে যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও খবর বাইরে আসে না৷
অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, ‘‘মাদ্রাসাগুলোর অবস্থা আসলেই খারাপ৷ বাচ্চাদের এখানে দিয়ে যাওয়ার পর অভিভাবকরা তো খোঁজই নেন না৷ তাছাড়া মাদ্রাসাগুলো এমনভাবে আবদ্ধ করে রাখা হয় যে, সেখানে সাধারণ মানুষ ঢুকতেই পারে না৷ ফলে সেখানে কী ঘটে – তা কিন্তু বাইরের লোক জানতে পারে না৷ যে দু-একটি ঘটনা বাইরে আসে, তা একেবারেই বাধ্য হয়ে৷ না হলে সেগুলোও জানা যেত না৷ তাই আমার মনে হয়, মাদ্রাসাগুলোর দিকে সরকারের বিশেষ মনোযোগ দেয়া উচিত৷''
স্কুল-কলেজে যৌন হয়রানি বন্ধ করা যায় কীভাবে? জানান আমাদের, নীচের ঘরে৷
যৌন হয়রানির হাত থেকে কীভাবে বাঁচাবেন শিশুকে
শিশুরা বিকৃতকাম মানুষের সহজ শিকার৷ সারল্যের সুযোগ নিয়ে সহজে ভোলানো যায় তাদের৷ অনেক সময় শিশুরা বুঝতে পারে না, চিনতে পারে না পিশাচের থাবা৷ আর বুঝলেও করতে পারে না প্রতিবাদ, প্রতিরোধ৷ শুধু একটা অস্বস্তি থেকে যায় সারাটা জীবন৷
ছবি: picture alliance/abaca
ভয়াবহ অবস্থা ভারতে
ভারতের জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের অর্ধেকেরও বেশি বাচ্চা যৌন নিগ্রহের শিকার৷ তবে সবচেয়ে ভয়ংকর সত্য হলো, নাবালিকা বা শিশুর ওপর যৌন হেনস্থার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে পরিবারের মধ্যে, পরিবারেরই কোনো মানসিক বিকারগ্রস্ত সদস্যের হাতে৷ তাই সে সব ঘটনা পুলিশের কাছে পৌঁছাচ্ছে না, হচ্ছে না কোনো ডাইরি অথবা মামলা৷
ছবি: Fotolia/Gina Sanders
হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব
এভাবে প্রতিদিন বিকৃত যৌন নির্যাতনে হারিয়ে যাচ্ছে অগুন্তি শৈশব৷ অনেকক্ষেত্রেই শিশুরা বুঝে উঠতে পারছে না, বলে উঠতে পারছে না তাদের অমানবিক সেই সব অভিজ্ঞতার কথা৷ তাই শিশুদের প্রতি যৌনাসক্ত, বিকৃত মানুষগুলো থেকে যাচ্ছে লোকচক্ষুর আড়ালে৷ সমাজবিদরা বলছেন, এ জন্য আগাম সতর্কতার দায়িত্ব নিতে হবে অভিভাবক এবং স্কুলের৷ শিশুকে দিতে হবে তার প্রাপ্য শৈশব৷
ছবি: Fotolia/Kitty
যেভাবে বোঝাবেন বাচ্চাদের
সহজ ভাষায় খেলা বা গল্পচ্ছলে শিশুদের এ বিষয়ে একটা ধারণা গড়ে তোলা যেত পারে৷ বাচ্চাদের বলতে হবে যে, তাদের শরীরটা শুধুমাত্র তাদের৷ অর্থাৎ কেউ যেন তাদের ‘গোপন’ জায়গায় হাত না দেয়৷ তাই কোনো আত্মীয় বা পরিচিত ব্যক্তির আচরণ অস্বস্তিকর ঠেকলে, কেউ তাদের জোর ঘরে কোনো ঘরে নিয়ে গেলে, খেলার ছলে চুমু দিলে বা শরীরের কোথাও হাত দিলে – তা যেন মা-বাবাকে জানায় তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চিনিয়ে দিন যৌনাঙ্গ
অনেক বাবা-মা নিজ সন্তানের সঙ্গে যৌনাঙ্গ নিয়ে কথা বলতে কুণ্ঠা বোধ করেন৷ কিন্তু এই লজ্জা কাটিয়ে উঠতে হবে এবং খুব ছোটবেলাতেই ছবি এঁকে অথবা গল্পে-গানে বাচ্চাকে তার শরীরের অন্য সব অঙ্গের মতো যৌনাঙ্গ, লিঙ্গ ইত্যাদি চিনিয়ে দিতে হবে৷ এমনটা করলে কেউ যদি তাদের সঙ্গে পিশাচের মতো ব্যবহার করে, তাহলে শিশুরা সহজেই বলতে পারবে কে, কখন, কোথায় হাত দিয়েছিল৷
ছবি: DW/S.Rahman
শিশুর কথা শুনুন, তার পক্ষ নিন
শিশু যাতে আপনাকে বিশ্বাস করতে পারে, বন্ধুর মতো সবকিছু খুলে বলতে পারে – সেটা নিশ্চিত করুন৷ আপনার বাচ্চা যদি পরিবারের কাউকে বা আপনার কোনো বন্ধুকে হঠাৎ করে এড়িয়ে যেতে শুরু করে অথবা আপনাকে খুলে বলে বিকৃত সেই মানুষের কৃতকর্মের কথা, তবে সময় নষ্ট না করে শিশুটির পক্ষ নিন আর তিরস্কার করে বাড়ি থেকে বার করে দিন ঐ ‘অসুস্থ’ লোকটাকে৷
ছবি: Fotolia/pegbes
স্কুলেরও দায়িত্ব আছে
বাচ্চারা দিনের অনেকটা সময় স্কুলে কাটায়৷ তাই যৌন শিক্ষার ক্ষেত্রে স্কুলের একটা বড় দায়িত্ব থেকে যায়৷ তবে স্কুলের মধ্যে, বিদ্যালয় চত্বরেও ঘটতে পারে শিশু নির্যাতনের ঘটনা৷ তাই স্কুল থেকে ফেরার পর বাচ্চা যদি অতিরিক্ত চুপচাপ থাকে, একা একা সময় কাটায় বা পড়াশোনা করতে না চায়, তাহলে ওর সঙ্গে কথা বলুন৷ জানতে চান কী হয়েছে, প্রয়োজনে স্কুল কর্তৃপক্ষকেও জানান৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel
ছেলে-মেয়ে সমান!
আমাদের সমাজে ছোট থেকেই মেয়েদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়৷ মেয়ে হলেই হাতে একটা পুতুল আর ছেলে হলে ধরিয়ে দেয়া হয় বল বা খেলনার পিস্তল৷ ছেলের পাতে যখন তুলে দেয়া হয় মাছের বড় টুকরোটা, তখন মেয়েটির হয়ত এক গ্লাস দুধও জোটে না৷ এ বৈষম্য বন্ধ করুন৷ বাবা-মায়ের চোখে ছেলে-মেয়ে সমান – সেভাবেই বড় করুন তাদের৷ তা না হলে নারীর ক্ষমতায়ন হবে কীভাবে? কীভাবে কমবে শিশু নির্যাতন?