‘বিচারের ক্ষেত্রে কাউকে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে না সরকার’
১৫ এপ্রিল ২০২২
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রীর দাবি, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনার বিচার করছে সরকার৷ এক্ষেত্র কাউকে বিশেষ সুবিধা দেয়া হচ্ছে না৷ তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান৷
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে৷ ৭২ পৃষ্ঠার বাংলাদেশ নিয়ে প্রতিবেদনে নিরাপত্তা বাহিনীকে ব্যাপক দায়মুক্তি দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে৷ অবৈধ ও নির্বিচারে হত্যা, গুম, সরকার বা সরকারের পক্ষে কাজ করা এজেন্ট কর্তৃক অমানবিক ও পাশবিক অত্যাচারসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে৷
বাংলাদেশের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম মনে করেন, প্রতিবেদনটি বিভিন্ন বিষয়ে ঢালাওভাবে মন্তব্য করা হয়েছে৷ তার দাবি, মানবাধিকার লঙ্ঘন হলেও তার প্রতিকারের ব্যবস্থা রয়েছে এবং সরকার এক্ষেত্রে দায়ীদের বিচারের আওতায়ও আনছে৷
‘ডয়চে ভেলে খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায়’ ইউটিউব টকশোতে যোগ দিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘‘বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার আইন হয়েছিল৷ বিএনপি করেছিল দায়মুক্তি অধ্যাদেশ, আরেকটা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করা যাবে না এই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স৷ আজকে কোথাও কোনো অপরাধ হলে তার বিচার চাওয়া যাবে না এমন কোনো আইন নাই৷ যেকেউ বিচার চাইতে পারছেন৷’’ বিভিন্ন অপরাধ, দুর্নীতির ক্ষেত্রে সরকার নিজ দলের ব্যক্তিদেরও বিচারের মুখোমুখি করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘কারো জন্য স্পেশাল কোনো সুবিধা দেয়া হচ্ছে না৷’’
তবে তার কথার সঙ্গে একমত নন আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান৷ তার মতে, কক্সবাজারে মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের মতো শত শত ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটলেও সেগুলোর বিচার হয়নি৷ তিনি বলেন, ‘‘নারায়ণগঞ্জে সাতজনকে হত্যার বিচারের জন্য আমাদের সকলকে রাস্তায় নামতে হয়েছে৷...মায়ের ডাক বলে একটা সংগঠন বলে যাচ্ছে হয় আমাদের পরিবারের লাশ ফেরত দাও নতুবা বলো কোথায় কবর দিয়েছ আমরা গিয়ে কবরটা জিয়ারত করি৷ সকল মানুষের অধিকার আছে তার প্রিয়জন কোথায় আছে তা জানার৷’’
দেশের মানুষ দিনের পর দিন ভোট দিতে পারছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘ভারতের অনেক কিছু থেকে আমরা শিখি কিন্তু একটা বিষয় শিখলাম না কেমন করে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন রাখতে হয়৷’’
সম্প্রতি শ ম রেজাউল করিমের মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে৷ অনুষ্ঠানে এই বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, মুক্তিযোদ্ধা সনদের জন্য তিনি নতুন করে আবেদন করেননি৷ শুরু থেকেই গেজেটে তার নাম ছিল৷ মন্ত্রী বলেন, ‘‘মুক্তিযোদ্ধাকালীন আমার ভূমিকা সশস্ত্র না৷ ...আমার পরিবারের সবাই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল, সে সময় আমি হাইস্কুলের ছাত্র ছিলাম, তৎকালীন সময়ে আমি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ছিলাম৷’’
মুক্তিযুদ্ধকালে বয়স প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘স্কুলের রেজিস্ট্রেশনে যে বয়স দেয়া হয় সেটা কিন্তু অনেকের প্রকৃত বয়স অনেকের থাকে না৷ এই কারণে একজনের স্কুলের বয়স যেমন আঙ্গিকে ধরা সহজ নয়৷ অনুরূপভাবে কেউ যদি কিশোর মুক্তিযোদ্ধা থাকে, তাহলে কোথাও লেখা নাই যে কিশোর বয়সে সে অংশগ্রহণ করতে পারবে না, বা তাকে গ্রহণ করা যাবে না৷’’
আদালতের রায়েও মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো বয়স নির্ধারণ করা হয়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি৷
তথ্য, পরিসংখ্যানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড
একটি মানবাধিকার সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশে গত দুই দশকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন৷ তবে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধের মতো ঘটনাগুলো ঘটেনি৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Wire/M. Rakibul Hasan
দুই দশক
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০০১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তিন হাজার ৩৬৪ জন৷ বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে এ ধরনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছিল ২০০৫-০৬ সালে৷ ২০০৫ সালে ৩৭৭ জন এবং ২০০৬ সালে ৩৬২ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন৷ তবে আরেক মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাবে দুই দশকে এমন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা চার হাজারের বেশি৷
ছবি: Shahidul Alam/Drik/Majority World
আওয়ামী লীগের ইশতেহার
সেসময় ক্রসফায়ার নামে পরিচিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ছিল আওয়ামী লীগের৷ ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে দলটি এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেয়৷ সুশাসন প্রতিষ্ঠার অনুচ্ছেদে ৫.২ নং অঙ্গীকারে বলা হয়েছিল, ‘‘বিচারবিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হবে৷ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হবে৷’’
ছবি: Mustafiz Mamun
কথা রাখেনি সরকার
ক্ষমতায় এসে নির্বাচনী ইশতেহারে দেয়া প্রতিশ্রুতি রাখেনি আওয়ামী লীগ সরকার৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম বছরে ২০০ জনের বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন৷ ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে মারা গেছেন আড়াই হাজারের বেশি মানুষ৷ (২০১৮ সালের ডিসেম্বরের ছবি)
ছবি: picture-alliance/dpa/AP Photo/A. Nath
নির্বাচন ও ক্রসফায়ার
আসক এর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাংলাদেশ নির্বাচনী বছর ও তার আগের বছরে বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে৷ নির্বাচনের আগের বছর ২০১৩ সালে প্রতিমাসে গড়ে ২৭ জন বা মোট ৩২৯ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে৷ ২০১৮ সালের ৪৬৬ টি ঘটনা ঘটে যা আগের বছরের চেয়ে তিনগুণ বেশি৷ ২০১৯ সালে এমন ঘটনা ঘটেছে ৩৮৮ টি৷
ছবি: DW/A. Islam
২০২১ সাল নিম্নমুখী
আসকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২২২টি৷ সেখানে গত বছর এমন ঘটনা ঘটেছে মোট ৮০টি৷ এর মধ্যে ৩০টির সঙ্গে জড়িত র্যাব, ২৪টিতে পুলিশ, দুইটিতে র্যাব ও পুলিশ এবং ১৭টি ঘটনায় বিজিবির নাম এসেছে৷ ৪৮টি ক্ষেত্রেই গেপ্তারের আগে ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনা ঘটেছে৷
ছবি: Getty Images
নানা নাম
তবে এগুলোকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হিসেবে স্বীকার করে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী৷ কখনও ক্রসফায়ার, কখনও বন্দুকযুদ্ধ কখনওবা এনকাউন্টার হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়ে বিবৃতি দেয়া হয় বাহিনীগুলোর পক্ষ থেকে৷ সম্প্রতি র্যাব দাবি করেছে তাদের সদস্যদের সঙ্গে ‘ধস্তাধস্তিতে’ গাজীপুরে এক ব্যক্তি মৃত্যু হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Wire/M. Rakibul Hasan
একরামুল হত্যা
২০১৮ সালে ২৬ শে মে র্যাবের ‘মাদক বিরোধী অভিযানে’ কথিত 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হন কক্সবাজারের কাউন্সিলর একরামুল হক৷ কিন্তু স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে নিহত হওয়ার আগ মুহূর্তের মোবাইলের কথোপকথন ফাঁস হওয়ার পর র্যাবের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ ওঠে৷ এই ঘটনায় একরামুলের পরিবার মামলা করতে পারছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: DW/S. Kumar Dey
মেজর সিনহা হত্যা
বাংলাদেশে বিচার বহিভূত হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর একটি মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা৷ ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি৷ টেকনাফ থানার বহিষ্কৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ নয় পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন সিনহার বড় বোন৷ ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে আরো শতাধিক এমন হত্যার অভিযোগও রয়েছে৷
ছবি: bdnews24
র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের এলিট ফোর্স হিসেবে পরিচিত র্যাব ও এর সাবেক-বর্তমান কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র৷ এই নিষেধাজ্ঞা দেয়ার আগের পাঁচদিনে ‘ক্রসফয়ারে’ পাঁচজন নিহত হয়েছেন৷ কিন্তু এরপর আর এমন ঘটনা ঘটেনি৷
ছবি: DW
সরকারের বক্তব্য
তবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে কিছু হয় না বলে বারবারই দাবি করে আসা হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে৷ যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পরও সরকার এই কথা জোর দিয়ে বলে আসছে৷ আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশে কোনো ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি৷ এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে কোনো প্রকার আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ না দিয়ে এমন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে৷’’