1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বিচারের দায়িত্ব কার?

২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১

বাংলাদেশে গত কয়েকবছরে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ বেশ বেড়েছে মনে হচ্ছে৷ আইন-আদালতের তোয়াক্কা না করে সোশ্যাল মিডিয়া, গণমাধ্যম ব্যবহার করেই বিচার-আচার হয়ে যাচ্ছে৷ আশঙ্কার কথা হচ্ছে, এই প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রও যুক্ত হচ্ছে৷

ছবি: Colourbox

এক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আলোচিত একটি মামলা নিয়ে দিন কয়েক আগে ফেসবুকে একটি মন্তব্য করেছিলাম৷ এমন এক আইনে কিছুদিন আগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল যার ব্যবহার স্বাধীন বাংলাদেশে শুধু বিরলই নয়, একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এই প্রথম৷

আন্তর্জাতিক অনেক বাকস্বাধীনতা এবং মানবাধিকার সংগঠনের মতো আমিও মনে করি, সেই সাংবাদিককে তার সাহসী পেশাদারি কাজ থেকে বিরত রাখতেই তার বিরুদ্ধে বিতর্কিত ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে’ মামলা করা হয়েছে৷ অতীতে একাধিকবার এই আইন বাতিলের দাবি উঠেছিল৷ 

গত কয়েকবছরে আলোচিত সাংবাদিকের করা দুর্নীতি বিষয়ক অনেক প্রতিবেদন সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল৷ এখন তার সময় কাটে এই মামলা নিয়ে৷ তিনি কাজে ফিরলেও তার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন আপাতত দেখা যাচ্ছে না, অদূর ভবিষ্যতে দেখা যাবে কিনাও তা বোঝা যাচ্ছে না৷ বরং তার এই পরিনতি তার মতো সাহসী অন্য সাংবাদিকদের মনে একধরনের ভীতি তৈরি করতে পারে৷ ফলে ‘সেল্ফ-সেন্সরশিপ’ আরো বেড়ে যেতে পারে, যা প্রকারান্তরে ক্ষমতাসীনদের জন্য উপকারী বলে মনে হতে পারে৷

যাহোক, আমার মন্তব্যের উত্তরে একজন জানালেন, তার স্বামী একটি মন্ত্রণালয়ে ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত৷ আর সেই সাংবাদিক তার স্বামীকে নাকি ‘অবৈধভাবে’ কাজ পাইয়ে দিতে চেয়েছিলেন৷

মন্তব্যটি আমাকে ভাবিয়েছে৷ আগেও দুয়েকজন একথা বলেছেন আমাকে৷ একজন সাংবাদিক নিজে নিজের অবস্থান স্বচ্ছ রাখার চেষ্টা করতে পারেন৷ তারপরও তার স্বামী বা স্ত্রী যদি কোনো ‘দুর্নীতি’ করে থাকে আর সেটার সঙ্গে তিনি যদি জড়িত হন সেটা নিয়ে অভিযোগ, তদন্ত হতেই পারে৷ কিন্তু তাকেতো কিছুদিন আগে তার স্বামীর কোনো কথিত অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়নি৷ তাহলে এই প্রশ্ন এখন কেন আসছে? অনেকে কেন যে অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সেটা নিয়ে কথা বলেন না? তারচেয়ে অন্য গুজব দিয়ে কেন বিরল মামলার বিষয়কে ‘হালাল’ করার চেষ্টা হচ্ছে?

একজন ব্যক্তিকে সামাজিকভাবে হেয় করার এমন প্রক্রিয়ার ব্যবহার ছোট-বড় সর্বত্র দেখা যায়৷ বাংলাদেশে কয়েকবছর আগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজনকে প্রধান বিচারপতি করা হলো, তিনি বীরদর্পে সেই পদে বসলেন, নানা রায় দিলেন যা জনগণকে এবং ক্ষমতাসীনদের সন্তুষ্ট করেছে৷ তিনি সেসব যখন করেছেন খুবই ভালো মিডিয়া কাভারেজ পেয়েছেন, অনেকে তার সততা, সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়েছেন৷ কিন্তু তারপরই সংবিধান সংক্রান্ত এমন এক রায় এবং পর্যবেক্ষণ তিনি দিলেন, যাতো নাখোশ হলেন ক্ষমতাসীনরা৷

ব্যস, রাতারাতি সেই বিচারপতি হয়ে গেলেন দুর্নীতিবাজ৷ গণমাধ্যমে তার দুর্নীতি নিয়ে বড় বড় প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো, টকশোতে ঝড় উঠলো৷ ‘মিডিয়া ট্রায়ালের’ দৌলতে অবস্থা এমন হলো যে তার কোনোরকমে নিজের দেশ ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে হলো৷

অথচ তার বিরুদ্ধে যেসব দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে শোরগোল হলো, তার অধিকাংশই কিন্তু পুরনো অভিযোগ৷ তাকে প্রধান বিচারপতির পদে বসানোর আগেই এসব দুর্নীতির অভিযোগ যাচাইবাছাই করা যেতো৷ তিনি দুর্নীতিবাজ প্রমাণিত হলে তাকে এই পদে নাও বসানো যেতো৷ রাষ্ট্রের কিন্তু তদন্তের সেই ক্ষমতা রয়েছে৷

কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সেসব করা হয়নি৷ বরং এসব অভিযোগ জমিয়ে রাখা হয়েছে যাতে তিনি ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে গেলে তাকে এসব দিয়ে রাতারাতি ধসিয়ে দেয়া যায়৷ হয়েছেও তাই৷ এক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগগুলো আদালতে প্রমাণিত হওয়া অবধিও অপেক্ষা করতে হয়নি৷ ‘মিডিয়া ট্রায়ালেই’ কাজ হয়ে গেছে৷   

বলছি না দুর্নীতিবাজকে শাস্তি দেয়া যাবে না৷ অবশ্যই দেয়া যাবে, দিতে হবে৷ সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি হলে সেটা সনাক্ত করা, প্রয়োজনে শাস্তি দেয়ার জন্য রাষ্ট্রের কত কত উদ্যোগ রয়েছে৷ কিন্তু কেউ ক্ষমতাসীনদের প্রিয় থাকলে তার অপরাধ জেনেশুনে লুকিয়ে রাখা, আর বিরাগভাজন হলেই তাকে অতিদ্রুত অপরাধী বানিয়ে ফেলাটাতে আপত্তি আমার৷

কেননা এই প্রক্রিয়া বিভিন্ন রাষ্ট্রীয়, সরকারি এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে অসীনদের ক্ষমতাসীনদের প্রতি একধরনের আনুগত্য বজায় রাখতে বাধ্য করবে৷ অনেকের মধ্যে এই ধারনাই তৈরি হবে যে ক্ষমতাসীনদের সন্তুষ্ট রেখে যেকোনো অপরাধ করেই পার পাওয়া যায়৷ গণতন্ত্রের জন্য এটা ক্ষতিকর৷

আরেকটি বিষয় হচ্ছে কেউ অপরাধী প্রমাণিত হওয়ার আগেই তাকে অপরাধীর মোড়কে বন্দি করার চেষ্টা৷ আর সেই চেষ্টায় যখন রাষ্ট্র বা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোযুক্ত হয়, তখনতো হতাশ হওয়া ছাড়া কিছু করার থাকে না৷ কারণ তাদের দায়িত্ব হচ্ছে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা, কেউ অপরাধী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে অপরাধী না বলার বিষয়টিও নিশ্চিত করা৷

সম্প্রতি সাংবাদিক নেতাদের ব্যাংক একাউন্ট হঠাৎ করে তলব নিয়ে বেশ সোরগোল হচ্ছে৷ যে নেতাদের ব্যাংক একাউন্ট তলব করা হয়েছে, তারা কেউই কিন্তু সেটা দিতে আপত্তি জানাননি৷ বরং এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, তাদের কাছে সরাসরি সেটা না চেয়ে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে চেয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’৷ এবং সেই চাওয়ার তথ্য গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে৷

আরাফাতুল ইসলাম, ডয়চে ভেলেছবি: DW/Matthias Müller

এক্ষেত্রে আমি ‘মিডিয়া ট্রায়ালের' একটি চেষ্টা দেখতে পাচ্ছি, যাতে শুরুতেই জনমনে এমন ধারনা তৈরি হতে পারে যে এই সাংবাদিক নেতারা দুর্নীতিবাজ৷ অতীতের মিডিয়া ট্রায়ালগুলোর আলোকে বিবেচনা করলে এই ধারণা অমূলক নয়৷ সাংবাদিক নেতাদের মূল আপত্তিটা ব্যাংক হিসাব চাওয়ার এই প্রক্রিয়া নিয়ে৷

জার্মানিতে দেখেছি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আইনি কাঠামোর মধ্যে থেকে চাইলে যেকোনো সময় যেকারো আর্থিক হিসাব চাইতে পারে৷ এই হিসাব নানা কাজে ব্যবহৃত হয়৷ এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া৷ তবে, এই প্রক্রিয়াটি হয় পুরোপুরি ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বজায় রেখে৷ এক্ষেত্রে যার হিসাব প্রয়োজন, তার কাছেই সেটা চাওয়া হয়৷ পরবর্তীতে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান সেটা নিশ্চয়ই আইনি প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনে নানাভাবে যাচাই করে৷ কিন্তু সেটাও করা হয় গোপনে৷ জার্মানির একটি নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান গণমাধ্যমকে জানান দিয়ে কারো ব্যাংক একাউন্ট তলব করেছে, এমনটা দেখিনি আমি৷ কারণ গণমাধ্যমকে এসব বিষয় জানানো তাদের কাজ নয়৷ গণমাধ্যম কারো দুর্নীতি অনুসন্ধান করে বের করলে সেটা আলাদা ব্যাপার৷

আমি মনে করি, প্রত্যেক মানুষই সম্মানের সঙ্গে জীবনযাপনের অধিকার রাখে৷ আর তার সেই অধিকার রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব৷ সেক্ষেত্রে কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ/অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তা গোপন রাখার বিষয়টিও নিশ্চিত করা উচিত৷ ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ রাষ্ট্রের কাজ নয়, বরং আইন-আদালতের মাধ্যমে যথাযথ প্রক্রিয়ায় ন্যয়বিচার নিশ্চিত করা এই ব্যবস্থার কাজ৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ