1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আইন পেশার নামে কোনোভাবেই যা খুশি তাই চলতে পারে না

শেখ হাফিজুর রহমান
শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন
১৩ জানুয়ারি ২০২৩

দিন কয়েক আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আদালত অঙ্গনে ঘটে যাওয়া একটি অনাকাঙ্খিত ঘটনার জের ধরে বর্তমানে সেখানে অচলাবস্থা বিরাজ করছে৷

ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতছবি: DW/M. Mostafigur Rahman

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, শীতকালীন ছুটির আগে গত ১ ডিসেম্বর ছিল আদালতের শেষ কার্যদিবস৷

ওই দিন তিনটি মামলা না নেওয়ায় ১ জানুয়ারি থেকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের (১) বিচারক জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যাদার মোহাম্মদ ফারুকের আদালত বর্জন করেন আইনজীবীরা৷ এরপর ২ জানুয়ারি ওই ট্রাইব্যুনালের এজলাসে বিচার চলাকালে বিচারক ফারুকের সঙ্গে আইনজীবীদের বাদানুবাদ হয় এবং তার একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে৷ ওই ভিডিওতে জেলা জজ শারমিন নিগারের বিরুদ্ধে অশ্লীল, ও কুরুচিপূর্ণ স্লোগান দিতে দেখা যায়৷ ৪ জানুয়ারি জেলা বিচার বিভাগীয় কর্মচারি অ্যাসোসিয়েশন আদালতের সব এজলাসের দরজা ও প্রধান ফটকে তালা দিয়ে এক দিনের কর্মবিরতি পালন করে৷ ৫ জানুয়ারি আইনজীবীরা ৩ কার্যদিবসের কর্মবিরতির ডাক দেন৷

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ৫ জানুয়ারি আইনজীবী সমিতির সভাপতি, ও সম্পাদকসহ ৩ আইনজীবীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেন; এবং এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে তাদেরকে ১৭ জানুয়ারি হাইকোর্টে হাজির হতে বলা হয়৷ এদিকে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা জজ শারমিন নিগারের বিরুদ্ধে অশ্লীল, ও কুরুচিপূর্ণ স্লোগান দিয়ে বিচারকাজ বিঘ্নিত করার অভিযোগের ব্যাখ্যা দিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আইনজীবী সমিতির ২১ জন আইনজীবীকে তলব করেন৷ ২৩ জানুয়ারি তাদের হাজির হয়ে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে৷ উল্লেখ্য যে, ৫ জানুয়ারি সকালে কর্মচারিরা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করলেও আইনজীবীদের কর্মবিরতি অব্যাহত আছে৷

পৃথিবীর যে কোনো দেশের বিচারবিভাগের সুষ্ঠু কার্যক্রম নির্ভর করে বেঞ্চ (বিচারকদের) ও বারের (আইনজীবীদের) সৌহার্দ্য ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার উপর৷ বিচারক ও আইনজীবী – কেউ কারো শত্রু নন, বরং পরস্পরের বন্ধু, সুহৃদ ও শুভাকাঙ্খী৷ একটি মামলা দায়ের, তার বিচার কার্যক্রম, ও তার চূড়ান্ত ফলাফল; অর্থাৎ মামলার রায় নির্ভর করে বিচারক ও আইনজীবীদের উত্তম বোঝাপড়া, নিষ্ঠা, এবং সাবস্ট্যানটিভ ও প্রসিডিউরাল আইন প্রয়োগে পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করার ওপর৷ এতে করে কাঙ্খিত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবার উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি হয়৷ শেষ পর্যন্ত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় কিনা এবং রায় বিচার প্রার্থীর কোনো কাজে লাগে কিনা - বাংলাদেশের বাস্তবতায় সেটি একটি জটিল প্রশ্ন৷

এ কথা বলছি এ কারণে যে, বাংলাদেশে মামলার যে খরচ, সেটি বহন করার আর্থিক সামর্থ্য অধিকাংশ মানুষের নেই৷ যিনি মামলা করেন, উকিলের ফি ও মামলার আনুষঙ্গিক খরচ বহন করতে গিয়ে তিনি প্রায় নিঃস্ব হয়ে যান৷ দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে মামলার নিষ্পত্তি হয় আশঙ্কিত হবার মতো বিলম্বে! যে মামলা ২ বছরে নিষ্পত্তি হওয়ার কথা, সেটি নিষ্পত্তি হয় ৬/৭ বছরে, যে মামলা ৫ বছরে নিষ্পত্তি হওয়ার কথা, তার নিষ্পত্তি হতে ১০, ১৫, এমন কি ২০-৩০ বছরের বেশি সময়ও লেগে যায়৷ ফলে মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার পরে মামলার রায় বিচারপ্রার্থীর কোনো কাজে লাগে না বললেই চলে৷ এ প্রসঙ্গে এ তথ্যটিও মনে রাখতে বলি যে, বর্তমানে বাংলাদেশের উচ্চ ও নিম্ন আদালতে ৩৫ লক্ষের অধিক মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ঝুলে আছে৷

এতদসত্ত্বেও এটি মানতে হবে যে, পাহাড়প্রমাণ সমস্যা সত্ত্বেও জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত কয়েক হাজার বিচারক আপ্রাণ চেষ্টা করছেন মামলা নিষ্পত্তি করতে৷ তবে এসকল বিচারকদের মধ্যে কারো কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতির ভয়াবহ অভিযোগ আছে এবং এজন্য বেশ কিছু বিচারককে চাকুরি থেকে অপসারণও করা হয়েছে৷ অন্যদিকে জেলা শহরগুলোর বার, ঢাকা বার ও সুপ্রিম কোর্ট বারে আইনজীবী হিসেবে আইন চর্চা করছেন শত শত আইনজীবী৷ এসকল আইনজীবীর মধ্যে ভালো যেমন আছেন, আবার খারাপও আছেন৷ তবে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, আইনজীবীদের নানা প্রভাবশালী গ্রুপ বিচারালয়কে জিম্মি করে ফেলেন এবং তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী কিছু না হলে সংশ্লিষ্ট বিচারকের আদালত বর্জন করেন৷

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন, ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষকছবি: Privat

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আদালত অঙ্গনে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্খিত ঘটনার আদ্যেপান্ত জানার পরে আমার মনে হয়েছে যে, ওখানকার আইনজীবী সমিতি বিচারালয়কে জিম্মি করে ফেলেছে৷ নারী জজ সম্পর্কে অশালীন ভাষা প্রয়োগ করার স্পর্ধাও তারা দেখিয়েছেন৷ এমনকি তারা হাইকোর্টের রুলকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে তাদের ধর্মঘট অব্যাহত রেখেছেন৷ পরিবহণ মালিক ও শ্রমিকরা যেমন যাত্রীদের জিম্মি করেন, ইন্টার্নী ডাক্তাররা যেমন রোগীদের জিম্মি করেন, আইনজীবীরাও তেমনি তাদের আধিপত্য বজায় রাখা ও বাণিজ্যিক স্বার্থ জারি রাখার জন্য আদালত, বিচারক ও বাদী-বিবাদীদের জিম্মি করে ফেলেন৷ সমস্যা যা-ই হোক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির নেতৃবৃন্দ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তার সুরাহা করতে পারতেন৷ আইনের পেশাজীবী হিসেবে উচ্চ আদালতের শুনানি, রুলিং ও চূড়ান্ত রায়ের ওপরও তাদের শ্রদ্ধা রাখা উচিত ছিল৷ 

যা-ই হোক, পরিশেষে বলতে চাই যে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অচলাবস্থার জন্য দায়ী আইনজীবীদের আদালত অবমাননার জন্য শাস্তি দেওয়া আইনের শাসনের স্বার্থেই প্রয়োজন৷ বিশেষ করে যে সকল আইনজীবী নারী বিচারক সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য করেছেন, তাদের আইনজীবীর লাইসেন্স বাতিল করে ফৌজদারি শাস্তির আওতায় আনা দরকার৷ বিচার অঙ্গনে আইন পেশার নামে কোনোভাবেই যা খুশি তাই চলতে পারে না৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ