মুখে সবাই বিচার বিভাগ স্বাধীন দাবি করলেও, বাস্তবে পরিস্থিতি ভিন্ন বলে মনে করেন সাবেক জেলা জজ শাহজাহান সাজু৷ নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা প্রয়োগে বিচারকেরা ‘ভয় পান' বলেও মনে করেন তিনি৷
বিজ্ঞাপন
‘ডয়চে ভেলে খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায়' টকশোতে এ সপ্তাহের আলোচনার বিষয় ছিল ‘ক্ষমতার চাপে বিচারকেরা'৷ এবারের পর্বে সাবেক জেলা জজ শাহজাহান সাজুর সঙ্গে আলোচক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নুরজাহান বেগম মুক্তা৷
অতিথিদের কাছে প্রশ্ন ছিল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনা কি প্রমাণ করে যে, বিচারকেরা ক্ষমতার চাপে অসহায়? বিচার বিভাগ স্বাধীন হওয়া সত্ত্বেও বিচারকেরা কি স্বাধীনভাবে মামলা পরিচালনা করতে পারেন?
শাহজাহান সাজু এ প্রসঙ্গে দুই বছর আগে পিরোজপুরের একটি ঘটনার উদাহরণ তুলে ধরেন৷
পিরোজপুরের সাবেক সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম এ আউয়াল তিনটি মামলায় এবং তাঁর স্ত্রী লায়লা পারভীন একটি মামলায় ৩ মার্চ সকালে পিরোজপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন করেন৷ দুপুরে শুনানি শেষে বিচারক মো. আবদুল মান্নান জামিন নামঞ্জুর করে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন৷ বিকেলেই জেলা ও দায়রা জজ মো. আবদুল মান্নানকে বদলির চিঠি পাঠানো হয়৷
সাবেক জজ শাহজাহান সাজু প্রশ্ন তোলেন, ‘‘আমি জানি না, পৃথিবীর কোন ইলেক্ট্রনিক্স পদ্ধতিতে উনাকে (বিচারক) এজলাসে থাকা অবস্থায় তাৎক্ষণিক বদলি করে তাৎক্ষণিক স্ট্যান্ড রিলিজ করে দেয়া হলো৷ কখন এই প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে লেখা হলো, কখন উচ্চ আদালতের অনুমোদন নেয়া হলো, কখন সে চিঠি তৈরি হলো, কখন সেটা ফ্যাক্সে ওই জেলা জজের কাছে গেল এবং সেই জেলা জজ দায়িত্বভার হস্তান্তর করলেন একজন যুগ্ম জেলা জজের কাছে৷ কারণ তখন স্টেশনে কোনো অতিরিক্ত জেলা জজ ছিলেন না৷ ওই যুগ্ম জেলা জজ কোর্ট আওয়ারের মধ্যেই এমপি আউয়াল সাহেবকে জামিন দিলেন৷’’
অন্য জেলা জজরা এমন পরিস্থিতি দেখলে কেমন বোধ করেন, এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন শাহজাহান সাজু৷
সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নুরজাহান বেগম মুক্তা বিচার বিভাগকে স্বাধীন দাবি করে পালটা প্রশ্ন তোলেন, আইনজীবী নিজের ক্লায়েন্টের ভালো চেয়ে অন্যায় আবদার করলেও বিচারকেরা কেন সেটা মেনে নেন?
এ প্রসঙ্গে শাহজাহান সাজু দুইটি বিষয়ের অবতারণা করেন৷ প্রথমত, জেলা জজ হিসাবে যারা কাজ করতে আসেন, তারা কেউই খুব স্বচ্ছল পরিবার থেকে আসেননি৷ ফলে অনেকেই ক্যারিয়ারের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয় পান৷ তাছাড়া, নির্বাহী বিভাগ অনেকক্ষেত্রেই বিচার বিভাগের চেয়ে বেশি ক্ষমতা রাখে৷ ফলে এ নিয়েও সতর্ক থাকেন বিচারকেরা৷
শাহজাহান সাজু বলেন, ‘‘মাননীয় মন্ত্রী বলছেন বিচারবিভাগ স্বাধীন, আমিও বলি বিচার বিভাগ স্বাধীন৷ আমিও স্বাধীনভাবে কাজ করেছি৷ কিন্তু এটা হলো পুস্তকের কথা, বইয়ের কথা৷ কিন্তু বাস্তবে যা ঘটে, সেটা সংবিধানের পরিপন্থি, আইনের পরিপন্থি৷’’
এডিকে/এফএস
জামিন নাই, বিচার নাই
নিম্ন আদালত থেকে আপিল বিভাগ। অধিকাংশ মামলায় কেটে যায় দীর্ঘ সময়। একপ্রকার বিনা বিচারের কারা অভ্যন্তরে কাটে অভিযুক্তদের জীবন। রাষ্ট্রের কারণে কারো কারাজীবন দীর্ঘ হলে তিনি কি ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন? ছবিঘরে বিস্তারিত৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
১৭ বছরের কারাবাস, এরপর নির্দোষ শিপন
১৯৯৪ সালে ঢাকার সূত্রাপুরের একটি হত্যা মামলায় টানা ১৭ বছর বিনা বিচারে কারাগারে ছিলেন মো. শিপন। তিনি জামিনও পাননি, বিচারও হয়নি। তার বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনা আইনজীবী কুমার দেবুল দে বলেন, হাইকোর্ট তাকে জামিন দেয় এবং ছয় মাসের মধ্যে বিচার শেষ করতে বলে। সেই বিচারে নির্দোষ প্রমাণিত হন শিপন। মাঝখানে হারিয়ে গেছে ১৭টি বছর।
ছবি: Privat
‘অসহায়দের তথ্য উপাত্ত নিশ্চিতে কাজ করা জরুরি’
বিনা বিচারে গ্রেপ্তারদের জামিন নিয়ে কাজ করে লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স টু হেল্পলেস প্রিজনার্স অ্যান্ড পার্সন্স (এলএএইচপি) নামে একটি সংস্থা। এর চেয়ারম্যান ও মানবাধিকার কমিশনের সদস্য অ্যাডভোকেট তৌফিকা করিমের মতে, অনেকক্ষেত্রে তদবিরকারক না থাকায় অল্প অপরাধে অনেকে দীর্ঘমেয়াদে কারাগারে থাকেন। এদের অসহায়ত্বে অনেকাংশে ন্যায় বিচার ব্যাহত হয়। এই অসহায়দের তথ্য উপাত্ত নিশ্চিতে কাজ করা জরুরি।
ছবি: Privat
‘জামিনে ফ্যাক্ট কতটুকু দেখে ডাউট আছে’
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট ফাউজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, ‘‘নীচের কোর্টে এত এত ক্রাউড, সেখানে জামিনের আবেদন কতটুকু ফ্যাক্ট দেখে করে, সেটা আমার কাছে অনেক সময় সন্দেহ হয়। হাইকোর্ট একটা জামিনে আধা ঘণ্টা এক ঘণ্টাও শোনে। সেখানে আমরা তথ্য প্রমাণ সাইটেশন দিতে পারি। নীচের কোর্টে এই সুযোগ কম। এটা কেবল বাংলাদেশেই না। নিউ ইয়র্কের নাইট কোর্টেও আমি একই অবস্থা দেখেছি।’’
ছবি: Privat
আইনজীবীরা বললেও আদালত শোনে না
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, ‘‘জামিন অযোগ্য অপরাধে জামিন দেয়া ডিসক্রিয়েশন অব দ্য কোর্ট। ডিসক্রিয়েশন মানেই পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার। আমার সাবমিশন অপছন্দ। তিনি বলেন, রিমান্ডের ক্ষেত্রে আপিল বিভাগের কিছু নির্দেশনা (বাইরে আইনজীবীকে রেখে কাঁচে ঘেরা কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ) আছে। এটা কেবলমাত্র (আংশিক) ফলো করা হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বেলায়। অন্যদের ক্ষেত্রেও আইনজীবীরা আদালতে এগুলো বলে, কিন্তু শোনে না।’’
ছবি: Privat
কেউ শোনেনি জাহালমের কথা
বিনাদোষে কারাভোগ করা বহুল আলোচিত একটি নাম জাহালম। আসামির সাথে চেহারার মিল থাকায় সালেকের পরিবর্তে ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় এই পাটকল শ্রমিককে গ্রেপ্তার করা হয়। বিচারিক আদালতে তিনি বলেছিলেন, তিনি সালেক নন। কিন্তু কেউ শোনেনি তার কথা। ঘটনাটি আদালতের নজরে আনা চেম্বারের আইনজীবী সুভাষ চন্দ্র দাস বলেন, হাইকোর্ট তাকে জামিন দেয় এবং ১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেয়।
ছবি: Privat
‘কতদিনে নিষ্পত্তি করতেই হবে-সেই নিয়ম নাই’
বাগেরহাটের একটি আদালতে স্ত্রী-সন্তানকে হত্যার দায়ে ২০০০ সালে মৃত্যুদণ্ড হয় শেখ জাহিদের। ২০০৪ সালে হাইকোর্টের রায়ের ১৬ বছর পর আপিল বিভাগে তিনি খালাস পান। তার আইনজীবী সরোয়ার আহমেদ বলেন, যদি আইন হতো, এতদিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতেই হবে, না করতে পারলে সেটার বেনিফিট আসামি পাবে। তাহলে এগুলো কমতো। নির্ধারিত সময়ে নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণ মামলার সংখ্যা অনেক। বিপরীতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক নেই।
ছবি: Privat
‘বিচার না করে বৈষম্য করছে রাষ্ট্র’
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, প্রতিটা আইনেই তদন্ত ও বিচার শেষ করার সময় বলা আছে। অনেকক্ষেত্রে হয়ত ১৮০দিনের তদন্ত বহু বছরেও শেষ হয় না। আবার বিচারক নেই, কোর্ট নেই-এ রকম নানা কিছুও হয়। কিন্তু অভিযুক্ত জেলে। অথচ সংবিধান বলছে, কাউকে বিনা বিচারে আটক রাখা যাবে না। কোর্ট না থাকার জন্য আসামি কেন সাফার করবে? এটা অবশ্যই বৈষম্য। রাষ্ট্র ক্রমাগতভাবে এই বৈষম্য করে যাচ্ছে। এর জন্য কোন ক্ষতিপূরণও দেয়া হয় না।
ছবি: Privat
‘ক্ষতিপূরণ চাইতে পারে আসামি’
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, জামিন বৈষম্যের সুযোগ নেই। কারণ জামিন শুরু হয় জেলা আদালতে। সেখানে উপযুক্ত হওয়ার পরও কেউ জামিন না পেলে তিনি উপরের কোর্টে আসতে পারেন। বিনা বিচারে কারাগারে থাকলে তাকে আদালতেই যেতে হবে, সেখানে বলতে হবে। আদালত সেটা তখন দেখবেন। কেউ বিনা বিচারে দীর্ঘ সময়ে কারাগারে থাকলে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করতে পারেন।