যুদ্ধাপরাধ মামলার দুই আসামি ব্রিটেন প্রবাসী চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আ্যমেরিকা প্রবাসী আশরাফুজ্জামানকে আইনি প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে আনার সুযোগ নেই৷ তাই তাঁরা স্বেচ্ছায় না আসলে তাঁদের অনুপস্থিতিতেই বিচার শুরু হবে৷
বিজ্ঞাপন
চৌধুরী মঈনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ যে তাঁরা একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন৷ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দু'জন ছাত্র আলবদর বাহিনীর সদস্য হিসেবে ১৪ই ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকা থেকে শিক্ষকদের ধরে নিয়ে যেতে সরাসরি সহায়তা করেন৷ গত ২৪শে জুন তাঁদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গ্রহণ করে মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল৷ তাঁদের বিরুদ্ধে ১১টি মানবতাবিরোধী অভিযোগ আনা হয়েছে৷ চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান – দু'জনই এখন প্রবাসী৷
ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দলের প্রধান আব্দুল হান্নান খান ডয়চে ভেলেকে জানান, তাঁদের দু'জনের বিরুদ্ধেই ট্রাইব্যুনাল গ্রেপ্তারি পরওয়ানা জারি করেছে৷ এর আগে চৌধুরী মঈনুদ্দীন ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়ার কথা বলেছিলেন৷ তবে সম্প্রতি তিনি একটি বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন যে, তিনি বাংলাদেশে আসবেন না৷ ওদিকে, আশরাফুজ্জামানও কোনো সাড়া দিচ্ছেন না৷ তাই তাঁদের দু'জনের অনুপস্থিতেই বিচার শুরু হবে৷
গোলাম আযমের শাস্তি, প্রাণহানি
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১৷ তবে এই রায়ে সন্তুষ্ট নয় সাধারণ জনতা৷ এই নিয়ে সংঘর্ষে কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
আমৃত্যু কারাদণ্ড
একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে পাঁচ ধরনের অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে – একথা উল্লেখ করে সোমবার (১৫.০৭.১৩) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বলেছে, ‘‘তার অপরাধ মৃত্যুদণ্ডের৷ তবে আযমের বয়স এবং অসুস্থতার কথা বিবেচনা করে তাকে আমৃত্যু কারাগারে রাখার জন্য ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে৷’’
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭১ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ৷ আন্তর্জাতিক মহল মনে করে, সেই যুদ্ধে তিন থেকে পাঁচ লাখ প্রাণহানি হয়৷ তবে বাংলাদেশের দাবি, মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ এবং সেসময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দুই লাখের মতো বাংলাদেশি নারীকে ধর্ষণ করেছিল৷
ছবি: AP
সন্ত্রাসী সংগঠন ‘‘জামায়াতে ইসলামী’’
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সোমবার দেওয়া রায়ে তার দল জামায়াতে ইসলামীকে ‘‘সন্ত্রাসী সংগঠন’’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে আদালত৷ রায়ে বলা হয়েছে, ‘‘গোলাম আযম একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই সংগঠনের প্রধান ছিলেন৷ তার নির্দেশে এবং পরিকল্পনাতেই একাত্তরে বাংলাদেশে হত্যা, ধর্ষণ এবং লুটতরাজসহ মানবতাবিরোধী অপরাধগুলি সংঘটিত হয়৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa
‘‘তার মৃত্যুদণ্ডই প্রাপ্য ছিল’’
এই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় অধ্যাপক মুনতাসির মামুন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আদালত বলেছে তার অপরাধ মৃত্যুদণ্ডের৷ তাই তার মৃত্যুদণ্ডই প্রাপ্য ছিল৷’’ অন্যদিকে বীরাঙ্গনা ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিনী রায় শুনে পুরোপুরি হতাশ৷ তিনি বলেন, ‘‘মৃত্যুদণ্ড ছাড়া আর কোনো শাস্তি নেই গোলাম আযমের জন্য৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa
নিহত কমপক্ষে তিন
সোমবার (১৫.০৭.১৩) গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার দিন স্থানীয় সময় বিকেল ছয়টা পর্যন্ত কমপক্ষে তিন ব্যক্তি নিহত হয়েছে৷ বাংলাদেশের ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের বরাতে ফরাসি বার্তাসংস্থা এএফপি জানিয়েছে, ‘‘কুষ্টিয়ায় রাস্তা ব্লক করার চেষ্টার সময় গণপিটুনিতে প্রাণ হারায় দুই জামায়াতে ইসলামী কর্মী৷ এছাড়া চাপাইনবাবগঞ্জে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারায় আরেক ব্যক্তি৷’’ (ফাইল ফটো)
ছবি: Reuters
সন্তুষ্ট আওয়ামী লীগ
গোলাম আযমের ৯০ বছর কারাদণ্ড হওয়ায় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘সরকার এই রায়ে সন্তুষ্ট৷ আদালত স্বাধীনভাবে রায় দিয়েছে৷’’
ছবি: Harun Ur Rashid Swapan
আপিলের ঘোষণা
তবে গোলাম আযমের আইনজীবীদের একজন তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, এই রায় ন্যায়ভ্রষ্ট এবং আবেগতাড়িত৷ তাই এ রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করবেন৷ আদালতের রায়ে একাত্তরে জামায়াতকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলারও সমালোচনা করেছেন তাজুল ইসলাম৷ তিনি বলেন, ‘‘আদালত তার আওতার বাইরে গিয়ে এই মন্তব্য করেছে৷’’
ছবি: Harun Ur Rashid Swapan
সজাগ গণজাগরণ মঞ্চ
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ গোলাম আযমের বিপক্ষে দেওয়া আদালতের রায় প্রত্যাখ্যান করেছে৷ তাদের দাবি, গোলাম আযমকে ফাঁসি দিতে হবে৷ এই দাবি নিয়ে সোমবার আবারো শাহবাগে সমাবেত হয়েছেন অনেকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফেসবুকে প্রতিবাদের ঝড়
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার পর প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ সাইট ফেসবুকে৷ প্রতিবাদ গোলাম আযমের শাস্তি হওয়ায় নয়, বরং তার ফাঁসির আদেশ না হওয়ায়৷ ডয়চে ভেলের ফেসবুক পাতায় রায়ের প্রতিক্রিয়ায় আহসান টিটু লিখেছেন, ‘‘এক কথায় খুশি না! ফাঁসি চাই৷’’
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
বিতর্কিত ট্রাইব্যুনাল
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে৷ তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বিএনপি মনে করে, সরকার বিরোধী দলকে দুর্বল করতে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
হান্নান খান জানান, চৌধুরী মঈনুদ্দীন লন্ডনে আছেন৷ তিনি সেখানকার নাগরিকত্ব পেয়েছেন বলে জানা গেছে৷ আর আশরাফুজ্জামান থাকেন নিউ ইয়র্কে৷ তাঁরা দু'জনই প্রবাসে ইসলামিক সেন্টার নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত৷ তাঁদের বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেপ্তারি পরওয়ানা ১৫ দিনের মধ্যে ফেরত আসার কথা৷ তারপরই বিচার কাজ শুরু হবে৷ হান্নান খানের কথায়, তাঁদের অনুপস্থিতিতে এই বিচার কাজ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করার তেমন কোনো আইনগত সুযোগ নেই৷ তিনি বলেন, রায়ে তাঁদের দণ্ড হলে যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে তাঁদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে৷ এর কারণ, ঐ দু'টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দি বিনিময় চুক্তি নেই৷ এছাড়া, মঈনুদ্দীন ব্রিটেনের নাগিরিকত্ব পাওয়ায় বিষয়টি বেশ জটিল৷ তাই শাস্তি হলে এ ব্যাপারে ইন্টারপোলের সহযোগিতাও নেয়া যাবে৷ তবে তাঁদের শেষ পর্যন্ত ফেরত আনা যাবে কিনা – তা সময়ই বলে দেবে বলে জানান তিনি৷
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দলের প্রধান আব্দুল হান্নান খান বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলারও তদন্ত সমন্বয়কারী কর্মকর্তা ছিলেন৷ তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় বজলুল হুদা এবং মহিউদ্দিন আহমেদকে বিদেশ থেকে ফেরত আনা হয়েছিল মামলার রায়ের পর৷ এঁদের মধ্যে বজলুল হুদাকে ব্যাংকক থেকে ফেরত আনা হয় দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ভিত্তিতে৷ আর মহিউদ্দিন আহমেদ অ্যামেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন৷ কিন্তু তাঁর আবেদন গ্রহণ না হওয়ায় তাঁকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায় মার্কিন সরকার৷