বাংলাদেশে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে এইচএসসি-তে ঢাকা বোর্ডের একটি বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত হওয়ার পর প্রতিক্রিয়া এসেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে৷ দাবি উঠেছে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির৷
বিজ্ঞাপন
গত ৩রা এপ্রিল শুরু হওয়া এ পরীক্ষায় বাংলাদেশের ১১ লাখ ৪১ হাজার ৩৭৪ জন শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছেন৷ বৃহস্পতিবার সকালে নির্ধারিত ছিল ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা৷ কিন্তু আগের দিন থেকেই বিভিন্ন স্থানে প্রশ্নপত্র ফাঁসের গুঞ্জন শুরু হয়৷ ঢাকার বিভিন্ন ফটোকপির দোকানে প্রশ্নপত্র বিক্রি হচ্ছে বলেও অভিযোগ ওঠে৷
এই পরিস্থিতিতে পরীক্ষার আগের দিন, অর্থাৎ বুধবার, পরীক্ষা স্থগিত করে দেয় ঢাকা বোর্ড কর্তৃপক্ষ৷ সামহয়্যার ইন ব্লগে পেলব চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘‘পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্নপত্র পাবার জন্য মুখিয়ে থাকে অনেক ছাত্র-ছাত্রী৷ শর্ত থাকে, প্রশ্ন মিলে গেলে তবেই টাকা দেবেন৷ সেই প্রশ্নপত্রের দাম আকাশছোঁয়া৷ লাখ লাখ টাকায় সেসব প্রশ্নপত্র বিক্রি হয়৷ চোখের পলকেই সেই প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে যায় মুঠোফোন থেকে মুঠোফোনে৷ ফেসবুক থেকে ফেসবুকে৷ ই-মেল থেকে ই-মেলে৷''
একই ব্লগে ইমতিয়াজ ইমন লিখেছেন, ‘‘এদেশে প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়৷ কারা প্রশ্ন ফাঁস করছে সেটাও নিশ্চয়ই তাঁর (শিক্ষামন্ত্রী) জানার কথা৷ তারপরও কেন এই ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হয় না সেটাই এক রহস্য৷ সরকারের উচিত প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িত সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া৷ এই জঘন্য কাজের জন্য এর চেয়ে ছোট কোনো শাস্তি আর নেই৷''
তাঁর এই লেখায় আমিনুর রহমান মন্তব্য করেছেন, ‘‘প্রশ্নপত্র ফাঁস এখন ভাইরাসের মতো ছড়াচ্ছে!....আজিব দেশে বাস করছি!''
সব দেশেই শিক্ষার ধরণ আলাদা
বিশ্বের প্রায় সব দেশেই শিক্ষকরা চক দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখেন – এ দৃশ্য তাই সবারই জানা৷ কিন্তু তারপরও দেশ ভেদে এর পার্থক্য রয়েছে, বিশেষকরে আজকের এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে৷
ছবি: Getty Images
সব স্কুল কি এক রকম?
সারা বিশ্বের ছাত্ররা একইভাবে পড়ালেখা শেখে? না, তবে প্রায় সব দেশেই শিক্ষকরা চক দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখেন – এ দৃশ্য তাই সবারই জানা৷ কিন্তু তারপরও দেশ ভেদে এর পার্থক্য রয়েছে৷ কোনো দেশে ছাত্র-ছাত্রীরা খোলা আকাশের নীচে মাটিতে পা মুড়ে বসে লেখাপড়া করে, কোথাও আবার স্কুল বেঞ্চে বসে৷ আবার কোনো কোনো দেশের ছাত্রদের রয়েছে নিজস্ব ল্যাপটপ৷
ছবি: AP
ডিজিটাল স্কুলের বই
দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি ডিজিটাল সিস্টেমে চলে৷ প্রতিটি ক্লাস রুমেই রয়েছে কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট৷ সরকারের ইচ্ছে সব স্কুল বই পুরোপুরিই ই-বুকে রূপান্তরিত করার৷ ডিজিটাল সিস্টেমে লেখাপড়া করতে কোনো ছেলে-মেয়ের যেন অসুবিধা না হয় এবং ডিজিটাল বইয়ের অভাবে যেন কারো লেখাপড়া বন্ধ না হয়, সেজন্য সরকার বিনা মূল্যে তাদের ট্যাবলেট এবং কম্পিউটার দিয়ে থাকে৷
ছবি: AP
গ্রামের স্কুলে যাওয়ার অসুবিধা
অন্যভাবেও পড়াশোনা চলতে পারে৷ কোনোরকমে ঝুলানো একটি ব্ল্যাকবোর্ড এবং কয়েকটি কাঠের বেঞ্চই আফ্রিকার ঘানার এই স্কুলটির জন্য যথেষ্ট৷ এই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে লেখা পড়া করা যায়, যদিও কাগজে কলমে রয়েছে ক্লাস নাইন পর্যন্ত লেখপড়া বাধ্যতামূলক৷ পড়াশোনার মাধ্যম ইংরেজি হওয়ায় গ্রামের ছাত্রদের অনেকেরই লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন হয়৷
ছবি: Fotolia/Living Legend
টাচপ্যাডের মাধ্যমে লেখা শেখা
তবে জার্মানির এই স্কুলটি ব্যতিক্রম৷ কাগজ, পেন্সিল ছাড়া ছাত্ররা পুরোপুরি স্মার্টবোর্ড এবং নেটবুকের মাধ্যমে লেখা শেখে৷ ডিজিটাল নেটওয়ার্কিং-এর ছাত্রদের যোগাযোগের কাজে সাহায্য করে এবং কর্মদক্ষতা বাড়ায়৷ জার্মানিতে এখনো দুই মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ লিখতে পড়তে পারেন না, যদিও পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে জার্মানির সবাই লেখাপড়া জানেন৷
ছবি: AP
শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ছোটবেলা থেকেই সুবিধা
শিল্পোন্নত দেশ মানেই সে দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের অন্যদেশের চেয়ে লেখাপড়ায় অনেক বেশি এগিয়ে থাকা৷ এমনকি ছোট বাচ্চাদেরও সেভাবেই তৈরি করা হয়, যেমন অ্যামেরিকার এই স্কুলটিতে৷ শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ছোটবেলার শিক্ষাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং ৭০ শতাংশ বাচ্চাই প্রাইমারি স্কুলে যাওয়ার আগে অনেককিছু শিখে ফেলে৷ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ১০ জনের মধ্যে হয়ত তিনজন কিন্ডারগার্টেনে যাওয়ার সুযোগ পায়৷
ছবি: AP
যেখানে শিক্ষা অর্থের জন্য বাঁধাগ্রস্থ
কেনিয়াতে সব ছাত্রই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়তে পারে৷ তারপরও অনেকে তার আগেই স্কুল ছেড়ে দেয়৷ স্কুল ড্রেস, বই, খাতা, জুতো ইত্যাদি জোগাড় করা অনেক বাবা মায়ের জন্য কষ্টকর হয় দাঁড়ায়৷ সেখানে ছাত্রের সংখ্যা অনেক বেশি এবং পড়াশোনার মানও নিম্ন৷ যাঁদের সামর্থ রয়েছে সে রকম অনেক বাবা-মা তাঁদের বাচ্চাদের প্রাইভেট স্কুলে পাঠান৷
ছবি: DW/J.Bruck
স্কুল ড্রেস পরে লেখাপড়া
ইংল্যান্ডে স্কুল ড্রেস ছাড়া কেউ স্কুলে যায় না৷ ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য স্কুল ড্রেস পরা বাধ্যতামূলক৷ কারণ স্কুল ড্রেস যার যার স্কুলের পরিচয় বহন করে এবং পড়াশোনার প্রতি উৎসাহী করে৷ দরিদ্র পরিবাররের ছেলে-মেয়েরা স্কুল ড্রেসের জন্য স্কুল থেকে টাকা পেয়ে থাকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb
খোলা আকাশের নীচে ক্লাসরুম
একটি পাবলিক পার্কে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে পাকিস্তানের একটি স্কুলে৷ গরিব বাবা-মায়েরা পয়সার অভাবে এমন স্কুলেই তাঁদের সন্তানদের পাঠিয়ে থাকেন৷ পাকিস্তানে শিক্ষা খাতে ব্যয় কমানো হয়েছে, কারণ সরকার শিক্ষার চেয়ে সামরিক খাতে বেশি খরচ করে৷ যা ছাত্ররাও বুঝতে পারছে৷
ছবি: AP
কমপক্ষে মৌলিক শিক্ষা থাকতে হবে
আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ ও নানা সমস্যার কারণে ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত৷ বিশেষকরে মেয়েদের ক্ষেত্রে একথাটি বেশি প্রযোজ্য৷ প্রতি দশজনের একজন লিখতে পড়তে পারে সেখানে৷ তবে এ হার পুরুষদের ক্ষেত্রে শতকরা ৪০ জন৷ তাছাড়া স্কুলগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট স্কুলও নেই, অভাব রয়েছে শিক্ষক এবং শিক্ষার সরঞ্জামেরও৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মেয়েরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত
আফগানিস্তানের মতো প্রায় একই অবস্থা দক্ষিণ সুদানেও৷ এদেশেও মেয়েদের প্রতি পাঁচজনের একজন লিখতে ও পড়তে পারে৷ সেজন্যই বিদেশি সাহায্য সংস্থাগুলো সুদানের মেয়েদের শিক্ষার দিকে বিশেষ নজর দিয়ে থাকে৷ বহু বছরের গৃহযুদ্ধ সে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ঘুণ ধরিয়ে দিয়েছে৷ অনেক স্কুলেই বই-খাতা এবং টেবিল-বেঞ্চও ঠিকমতো নেই৷
ছবি: dapd
কো-এডুকেশন পছন্দ নয়
কো-এডুকেশন? না, ইরানে সেটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়৷ ছেলে এবং মেয়ে আলাদাভাবে পড়াশোনা করে ইরানে৷ এমন কি এই ইহুদি স্কুলেও ইসলামিক স্কুল ড্রেস পরা বাধ্যতামূলক৷ এখানে মেয়েরা যে ধর্মেরই হোক না কেন সবাইকেই চুল ঢেকে রাখতে হবে, অর্থাৎ হিজাব পরতে হবে৷
ছবি: AP
ধনী-গরিবের পার্থক্য
ব্রাজিলের গ্রামাঞ্চলের ছাত্রদের জন্য লেখাপড়া করা বেশ কঠিন৷ কারণ সেখানকার স্কুলগুলোতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই৷ যেমন মন্টে আলেগ্রের এই স্কুলটির মতো ৷ যদিও ব্রাজিল শিল্পোন্নত দেশগুলোর একটি, তারপরও এদেশে গরিব এবং ধনীদের মধ্যে অনেক পার্থক্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাংলাদেশের অবস্থা অনেকটা একই রকম
বাংলাদেশের গ্রামের স্কুল এবং রাজধানী ঢাকা শহরের স্কুলের মধ্যে বিশাল পার্থক্য৷ বড় শহরগুলোতে ছাত্ররা কম্পিউটার বা ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে৷ আর গ্রামের স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের কম্পিউটার ব্যবহার করার ইচ্ছা – এখনো স্বপ্ন!
ছবি: Getty Images
13 ছবি1 | 13
আনোয়ার কামালের মন্তব্য, ‘‘জড়িতদের বিচার হয় না বলেই বার বার প্রশ্ন ফাঁস হয়৷''
পেলব চক্রবর্তী তাঁর ব্লগে লিখেছেন, ‘‘প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণের সঙ্গে জড়িত থাকার শাস্তি তিন বছর থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড৷'' তাঁর কথায়, ‘‘এই বিধানের পরও অসংখ্য পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে৷ হাতে গোনা কয়েকটির তদন্ত হয়েছে৷ যাদের হাত দিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, তারা হয়ত মাঝে-মধ্যে ধরা পড়েছে৷ আবার ছাড়াও পেয়েছে৷ কিন্তু এর কল-কব্জা যারা নাড়াচ্ছে, আইন তাদের স্পর্শ করতে পারছে না৷ অদূর ভবিষ্যতে পারবে বলে মনেও হয় না৷''
এই লেখায় আমিনুর রহমানের মন্তব্য, একটি প্রশ্ন ফাঁস হলে মেলের মাধ্যমে দেশের আনাচে কানাচে মিনিটের মধ্যে ছড়িয়ে যায়৷ তাই সেন্ট্রাল প্রেসগুলোতে যারা চাকরি করেন, তাদের ওপর কড়া নজর রাখা দরকার৷ তিনি লিখেছেন, ‘‘আমার কষ্ট লাগে সেই অভিভাবকগুলোকে দেখলে যারা প্রাইমারি পড়া সন্তানকে কীভাবে ফাঁসকৃত প্রশ্ন দেয়! আরে বাবা, একটা কোমলমতি বাচ্চা পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট না করলে কী এমন যাবে আসবে!''