উপনির্বাচনে শাসক দলের জয়ের পরে চলে গেল একটি প্রাণ। কালীগঞ্জে তৃণমূলের বিজয় মিছিলে বোমা ফেটে মৃত্যু হল নাবালিকার। চারজন গ্রেপ্তার হলেও আদালতে যাওয়ার হুঁশিয়ারি মৃতের মায়ের।
ফাইল চিত্রছবি: Srijit Roy
বিজ্ঞাপন
নদিয়ার কালীগঞ্জ উপনির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় পেয়েছে তৃণমূল। নাসিরউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুতে আসনটি খালি হয়েছিল। বিধানসভা নির্বাচনের ১১ মাস আগে উপনির্বাচনে প্রয়াত বিধায়কের কন্যা আলিফা আহমেদ জয়ী হলেন।
বোমাবাজিতে মৃত্যু
উপনির্বাচনের গণনা যত এগোচ্ছিল, ততই ব্যবধান বাড়াচ্ছিলেন তৃণমূল প্রার্থী। দুপুরের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে তৃণমূলের ভোট বাড়তে চলেছে এই কেন্দ্রে। অতি উৎসাহী কর্মী-সমর্থকেরা বিজয় মিছিল শুরু করে দেন ভোট গণনা শেষ হওয়ার আগেই।
কালীগঞ্জ থানার বড়চাঁদঘর এলাকার মোলান্দি গ্রামে বিজয় মিছিলের সময়ে বোমার টুকরো লেগে মারা যায় চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়া তামান্না খাতুন। পুকুর থেকে স্নান সেরে মায়ের সঙ্গে বাড়ি ফিরছিল সে। বিজয় মিছিল তাদের কাছাকাছি এলে জোরালো শব্দে বোমা বিস্ফোরণ হয়। তাতেই ছিটকে পড়ে বছর নয়েকের মেয়েটি। তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। বোমার আঘাতে গলায় গভীর ক্ষত তৈরি হয় শিশুটির।
বোমার আঘাতে ছিটকে পড়েন নাবালিকার মা সাবিনা ইয়াসমিন। তার বক্তব্য, "আমি ওর হাত ধরে বাড়ি ফিরছিলাম। হঠাৎ বিকট আওয়াজ। চারদিক ধোঁয়ায় ঢেকে যায়। মেয়েটা আমার হাত ছেড়ে একদিকে পড়ে যায়, আমি অন্যদিকে ছিটকে যাই। ধোঁয়া কেটে গেলে দেখলাম, মেয়েটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে।"
নিজেকে সিপিএম সমর্থক দাবি করে সাবিনা বলেন, "ওদের ভোট দিইনি বলে এটা করলো। আমরা রাজনীতি করি না। বাবার আমল থেকে সিপিএম-কে ভোট দিই। আমি দেখেছি কারা বোমা মেরেছে। ওদের নাম না জানলেও সকলের মুখ চেনা। সবাই তৃণমূল করে।"
সহিংসতা, মামলা, গ্রেপ্তার ও আতঙ্কের সন্দেশখালিতে ভোটের প্রচার
শেখ শাহজাহান ও তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে জমিদখল, সহিংসতা, নারী নির্যাতন, সন্ত্রাসের অভিযোগে সন্দেশখালি উত্তাল হয়ে উঠেছিল। সিবিআই শাহজাহান ও তার একাধিক সঙ্গীকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু ভোট যত এগিয়ে আসছে ততই উত্তাল হচ্ছে জনপদ। সন্দেশখালির সার্বিক দায়িত্ব আদালত সিবিআই-এর ওপর ছেড়ে দিলেও এলাকাবাসীদের একাংশের বিরুদ্ধে সক্রিয় হচ্ছে রাজ্য পুলিশ। জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা হচ্ছে। গ্রেপ্তারির ভয়ে অনেকে বাড়িছাড়া।
ছবি: Subrata Goswami/DW
একের পর এক ঘটনা
সম্প্রতি স্টিং অপারেশনের আদলে একটি ভিডিও প্রকাশ করে ‘উইলিয়াম’ নামের একটি পেজ। প্রবল বিতর্ক শুরু হয়। তৃণমূলের এক বিধায়ক বিষয়টি নিয়ে পুলিশে চিঠি লেখেন। সেটাকে এফআইআর হিসাবে নিয়ে বিজেপি প্রার্থী রেখা পাত্রসহ শাহজাহান বাহিনীর বিরুদ্ধে আন্দোলন করা নারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে পুলিশ। এ পরিস্থিতিতে ভুয়া ভিডিও তৈরির অভিযোগে তৃণমূল নেতা দিলীপ মল্লিক ও দুই কর্মীকে মারধর করা হয়৷ পুলিশ আরো সক্রিয় হয়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ঘরছাড়া মানুষ
পুলিশ ইতিমধ্যে চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। অনেকেই গ্রেপ্তারের ভয়ে ঘরছাড়া। তারা এখন এমন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন, যেখানে কেউ এলে অনেক আগেই দেখা যায়। ভয়ে ভয়ে দিন কাটাচ্ছেন তারা।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ঘরছাড়া নারীর কাহিনি
এমনই একজন নারী কথা বলেছেন ডিডাব্লিউর সঙ্গে। তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে এক জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন। গ্রেপ্তার ও পুলিশি নির্যাতন এড়াতে পরিবার-পরিজন ছেড়ে থাকছেন তিনি।
ছবি: Subrata Goswami/DW
বোনের খোঁজে দাদা
সন্দেশখালির আন্দোলনকারী জবারানির দাদা ডিডাব্লিউকে বলেন, জবারানির বাড়ি বন্ধ। তিনি কোথায় জানেন না। তিনি শুধু জানেন, জবারানির বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগে মামলা করা হয়েছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
নারীদের পাহারা
সন্দেশখালিতে এখন নারীরা রাতে পাহারা দিচ্ছেন। পুলিশ অতর্কিতে এসে নির্দোষ গ্রামবাসীকে যাতে তুলে নিয়ে যেতে না পারে, ‘প্রতিপক্ষ’ যাতে হামলা চালাতে না পারে তাই 'রাত জাগো' কর্মসূচি নিয়েছেন নারীরা। তারা লাঠি, ঝাঁটা নিয়ে রাতে পাহারা দিচ্ছেন। তাদের নিয়ে শুরু হয়েছে বিজেপি-তৃণমূল দ্বন্দ্ব৷
ছবি: Subrata Goswami/DW
বিজেপি নেত্রীর বিরুদ্ধে জামিন-অযোগ্য মামলা, হাইকোর্টের পদক্ষেপ
সন্দেশখালির বিজেপি নেত্রী মাম্পি দাসের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা করে। মাম্পি আত্মসমর্পণ করতে গেলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় ও নিম্ন আদালত তাকে ১২ দিনের হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেয়। মাম্পি অভিযোগ করেন, তার বিরুদ্ধে প্রথমে জামিনযোগ্য মামলা দেয়া হলেও পরে জামিন-অযোগ্য ধারা যোগ করে পুলিশ৷ হাইকোর্ট তাকে জামিন দিয়েছে। বিচারপতি জয় সেনগুপ্ত জানতে চান, ''গ্রেপ্তারের মাস্টারমাইন্ড কে? কোন অফিসার গ্রেপ্তার করেছেন?''
ছবি: Jagannath Raul/Dinodia/IMAGO
কী বললেন বিচারপতি?
বিচারপতি জয় সেনগুপ্ত জানান, এমন গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ আছে। পুলিশের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ''আপনারা না হয় এই আদালতকে গুরুত্ব দেন না, কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশগুলিকে তো মানুন।'' সন্দেশখালিতে ধর্ষণের ভুয়া অভিযোগসহ বেশ কিছু অভিযোগ তোলা হয়েছে মাম্পির বিরুদ্ধে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
আরেক নারীর অভিযোগ
বৃহস্পতিবার সন্দেশখালিতে এক নারী অভিযোগ করেন, তাকে রাতের আঁধারে মুখ চেপে নিয়ে যাওযার চেষ্টা করা হয়৷ ওই সময় কুকুর ডেকে ওঠে৷ তার সন্তানও তাকে ডাকতে শুরু করলে প্রতিবেশীরা এগিয়ে আসেন৷ তখন তাকে ফেলে চলে যায় দুর্বৃত্তরা৷ ওই নারীর বক্তব্য পুলিশ রেকর্ড করেছে বলে সূত্র জানাচ্ছে। তার এই অভিযোগ নিয়ে নতুন করে সোরগোল শুরু হয়েছে। উপরের ছবিটি সন্দেশখালি থানার।
ছবি: Subrata Goswami/DW
তৃণমূল কর্মীর অভিযোগ
এই তৃণমূল কর্মীর নাম তাতান। যেদিন দিলীপ মল্লিকসহ তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার অভিযোগ, সেদিন তাতানও সেখানে ছিলেন। নিজেও বেধড়ক মার খেয়েছেন বলে দাবি তার। তাকে বিরোধীরা মেরে ফেলতেই চেয়েছিল বলে মনে করেন তাতান। তার অভিযোগ, বিজেপি-র নারী কর্মীরা তাদের আক্রমণ করে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
'অত্যাচার হয়েছে'
সন্দেশখালিতে অত্যাচার হয়েছে, জমি ও ভেড়ি-দখলের অভিযোগ আছে, দল না করায় বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে পেটানো হয়েছে, এই সব বিষয় কম-বেশি সব পক্ষই স্বীকার করছে। তাছাড়া তিন শতাধিক ব্যক্তির জমি রাজ্য সরকারের উদ্যেগে ইতিমধ্যে ফেরতও দেয়া হয়েছে৷ এখন বিতর্ক চলছে ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে। সেই বিষয়ে রাজনীতির রং লেগেছে। তৃণমূল বনাম বিজেপির রাজনীতির রং৷
ছবি: Subrata Goswami/DW
কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন
ভোট উপলক্ষে সন্দেশখালিতে কেন্দ্রীয় বাহিনী পৌঁছে গেছে। তারা রুট মার্চ করছে। ফলে সন্দেশখালিতে এখন পুলিশের পাশাপাশি আধা সামরিক বাহিনীও রয়েছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সিবিআই শিবির
সন্দেশখালির মানুষকে যাতে কলকাতায় সিবিআই অফিসে আসতে না হয়, নিজেদের জায়গাতেই তারা যাতে সিবিআইয়ের কাছে অভিযোগ জানাতে পারেন, তাদের কথা বলতে পারেন, সেজন্য সন্দেশখালিতে সিবিআই শিবির বসেছে। সেখানে প্রহরার কাজে আছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, মানুষ চাইলে ই মেইল করেও অভিযোগ জানাতে পারেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সন্দেশখালিতে তৃণমূল প্রার্থী
এরই মধ্যে সন্দেশখালিতে লোকসভা নির্বাচনের প্রচার চলছে। সন্দেশখালি বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে। এবার সেখানে নুসরত জাহানকে বাদ দিয়ে হাজী নুরুল ইসলামকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। তিনি বলেছেন, ''ভালোবাসা দিয়ে সন্দেশখালির মানুষের মন জয় করবো।''
ছবি: Subrata Goswami/DW
সন্দেশখালিতে বিজেপি প্রার্থী
বসিরহাটে বিজেপি প্রার্থী হলেন রেখা পাত্র। তিনি সন্দেশখালিতে অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। তিনি এখন সন্দেশখালিসহ পুরো বসিরহাট ঘুরে ভোটের প্রচার করছেন। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ''সন্দেশখালির এক নম্বর, দুই নম্বর এলাকা সুরক্ষিত নয়। মানুষ বিপদের মধ্যে আছে। যারা দোষী, তাদের নয়, যারা আন্দোলন করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। অত্যাচার হচ্ছে। আমাদের অপরাধ, আমরা প্রতিবাদ করেছি।''
ছবি: Subrata Goswami/DW
সিপিএমের প্রার্থী সন্দেশখালিতে
সন্দেশখালিতে ব্যাপক সন্ত্রাস, নির্যাতনের কথা আগে একাধিকবার বিধানসভায় তুলেছেন সিপিএম নেতা নিরাপদ সর্দার। সেই নিরাপদ সর্দারই এবার বসিরহাট কেন্দ্রে সিপিএমের প্রার্থী৷ সন্দেশখালি আন্দোলন শুরুর পর তিনি জেলও খেটেছেন। তিনি বলেন, ''বিজেপি আসলে রেখা পাত্রকে প্রার্থী করে রাজ্য জুড়ে মহিলা এবং গরিব মানুষের ভোট লুট করতে চায়। তিনি মনে করেন, এই নির্বাচন আসলে সংবিধান রক্ষার লড়াই ছাড়া আর কিছুই নয়।''
ছবি: Subrata Goswami/DW
16 ছবি1 | 16
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক্স হ্যান্ডেলে কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়ে লেখেন, "আমি গভীরভাবে মর্মাহত। নিহতের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই। পুলিশ আইনি পদক্ষেপ নেবে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নেবে পুলিশ।"
এই ঘটনায় ২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। মৃতের পরিবার পুলিশকে ২৪ ঘণ্টা সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে সব অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা, গ্রাম থেকে বোমা উদ্ধার ও শান্তি নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি পুলিশকে দিতে হবে। সাবিনার কথায়, "পুলিশ ব্যবস্থা না নিলে আদালতে যাব। সিবিআই তদন্ত চাইবো।"
বিজ্ঞাপন
রাজনীতি ও হিংসা
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির সঙ্গে হিংসা জড়িয়ে গিয়েছে ওতপ্রোতভাবে। কয়েক দশক ধরেই এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। নির্বাচন এলে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ে। বিশেষ করে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়। গত পঞ্চায়েত ভোটেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
২০২৬ সালের মে মাসে বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা। সেই হিসেবে চলতি বিধানসভার মেয়াদ আর ১১ মাসের মতো। তার আগে একটি কেন্দ্রের উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করেও নিরীহ শিশুর প্রাণ চলে গেল, যা নিয়ে সর্বত্র নিন্দার ঝড় উঠেছে। পাল্টা সাফাই দিচ্ছে শাসক দলও।
কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী বলেন, "জিতলে মানুষ আনন্দ করে। এরা তা নয়। জিতলে তৃণমূল বদলা নেয়। যারা ভোট দেয়নি, তাদের উপরে হামলা করলো।''
তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ বলেন, "পুলিশ খোঁজ নেবে যে, তৃণমূলের এই বিপুল জয় কোনোভাবে কালিমালিপ্ত করার জন্য, ভিতর থেকে কেউ ওখানে গ্রামের মধ্যে এমন কিছু করে দিয়েছে কিনা, যাতে খারাপ ধারণা তৈরি হয়।"
তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে এই ঘটনা ঘটেছে কিনা, তা-ও তদন্তের আওতায় রয়েছে। কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার সুপার অমরনাথ কে বলেন, "২০২৩ সাল থেকে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল ওই এলাকায়। তার জেরে এই ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।"
সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, "কে কোন দল করে বড় কথা নয়, গ্রামের রাস্তায় একটা নয় বছরের শিশুর উপরে বোমা মারা হয়েছে, এটাই খুব দুর্ভাগ্যজনক।"
সাবেক পুলিশকর্তা সলিল ভট্টাচার্য বলেন, "বাংলার মানুষ জানতে চায় আইনের শাসন সম্পর্কে পুলিশ-প্রশাসনের কী ভূমিকা? জেলাশাসক, কৃষ্ণনগর পুলিশের এসপির ভূমিকা কী? সংবেদনশীল জায়গাগুলো কি চিহ্নিত করা হয়েছিল?"
সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য বলেন, "কোনোভাবেই এই ঘটনাকে আড়াল করা যাবে না বা অজুহাত দিয়ে চাপা দেয়া যাবে না। গত কয়েক বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি ক্রমশ গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, তোলাবাজির অভিযোগে দীর্ণ হয়ে উঠেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হিংসা। আমাদের সমাজ যেন মবোক্রেসি দ্বারা আক্রান্ত না হয়ে যায়, যেখানে অন্য সবকিছুকে ভুলে গিয়ে রাস্তার বিচার বা হিংসা একমাত্র নির্ণায়ক হয়ে ওঠে।"
রাজনৈতিক বিশ্লেষক, অধ্যাপক মইদুল ইসলাম বলেন, "পশ্চিমবঙ্গে গত দেড়-দুই দশকের রাজনীতিতে অনেক অপরাধী ঢুকে গিয়েছে। একটা বিজয় মিছিলে হবে, সেখানে বোমা পড়ার কোনো কারণ নেই। তার মানে যারা বিজয় উল্লাস করছিল, তাদের মধ্যে গুন্ডা-মস্তান ছিল। এটাকে মবোক্রেসি বলতে আমি রাজি নই। ভোট তো শান্তিতেই মিটেছিল। বিরোধীরাও সেভাবে পুনর্নির্বাচনের দাবি করেনি। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন যে ভোট পরিচালনা করে, সেটা মোটের উপরে শান্তিতেই হয়। তবে ভোট পরবর্তী হিংসা কিন্তু হয়েই চলেছে।"
রাজ্যজুড়েই সহিংসতা হয়েছে। অভিযোগের আঙুল তৃণমূলের দিকে। ভাঙড়, চোপড়া, বাঁকুড়া-সহ রজ্যের বহু জায়গায় রক্ত ঝড়েছে মনোনয়নপর্বে। অভিযোগ, বিভিন্ন জায়গায় মনোননপত্র জমা দিতে দেয়া হয়নি বিরোধী প্রার্থীদের। বিজেপি-র এই প্রার্থী সহিংসতার শিকার। বাঁশ, রড দিয়ে মারা হয়েছে তাকে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
আহত মানুষেরা
আরেকজন আহত মানুষ। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় মনোনয়ন ঘিরে এতটাই সংঘর্ষ হয়েছে যে, প্রচুর মানুষ আহত। ভাঙড়ে মুড়ি-মুড়কির মতো বোমা ও গুলি চলেছে। চোপড়ায় সিপিএমের মিছিলের উপর লাঠি, রড, বন্দুক নিয়ে আক্রমণ করা হয়।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
দীনেশ মণ্ডলের দাবি
দীনেশ মণ্ডল জানিয়েছেন, তার স্ত্রী সোনামণি মণ্ডল মনোনয়নপত্র জমা দিতে গেছিলেন। সেখানেই ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা তাদের আক্রমণ করে। তার বুকে একের পর এক ঘুষি মারা হয়।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
উত্তম বাগ মার খেয়েছেন
উত্তম বাগের স্ত্রী ঝুমা বাগ বিজেপি-র হয়ে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। মনোনয়নপত্র পেশ করতে যেতেই শুরু হয় ব্যাপক মার। রীতিমতো আহত উত্তম। রাজ্যের ৫০ শতাংশ পঞ্চায়েত আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত। তাই প্রার্থীর সঙ্গে তার স্বামী বা পরিবারের সদস্যরাও মনোনয়ন পেশের সময় যান।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মার অতীন্দ্র হালদারকে
অতীন্দ্র হালদার ডায়মন্ড হারবার দুই নম্বর ব্লকের প্রার্থী ছিলেন। তাকে বিডিও অফিসে ঢুকতে দেয়া হয়নি। বেধড়ক মারা হয়েছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বিমান বসুর নেতৃত্বে
চোপড়ায় সিপিএম ও কংগ্রেস প্রার্থীরা মিছিল করে মনোনয়নপত্র দিতে যাচ্ছিলেন। সেসময় তাদের মিছিলে হামলা হয়। একজন মাথায় গুলি লেগে মারা যান। গুরুতর আহত দুইজন। এরপর বিমান বসুর নেতৃত্বে সিপিএম ও কংগ্রেস নেতা-কর্মীরা রাজ্য নির্বাচন কমিশনের অফিসে যান। নির্বাচন কমিশনারকে স্মারকলিপি দেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
পুলিশের সঙ্গে বিরোধ
নেতারা ভিতরে গিয়েছিলেন স্মারকলিপি জমা দিতে। বাইরে রাস্তায় বসে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন, বাম ও কংগ্রেস কর্মীরা। পুলিশ তাদের সরাতে যায়। শুরু হয় ধাক্কাধাক্কি। পুলিশ ব্যারিকেড দেয়। কর্মীরা সেই ব্যারিকেড ফেলে দিয়ে এগোতে চায়।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
পুলিশের সঙ্গে তর্কাতর্কি
সিপিএমের এই নারী কর্মী পুলিশের সঙ্গে তর্কাতর্কি জুড়ে দেন। তিনি চিৎকার করে বলতে থাকেন, চোপড়ায় গুলিতে আমাদের সহকর্মীরা মারা যাচ্ছেন, ভাঙড়ে সহযোগী দলের কর্মীরা মারা যাচ্ছেন। আপনারা কোথায় ছিলেন?
ছবি: Satyajit Shaw/DW
রাস্তায় বসে প্রতিবাদ
সিপিএমের এই বয়স্ক মানুষটি রাস্তায় বসে পতাকা হাতে নিয়ে প্রতিবাদ দেখালেন। দলের সহকর্মীদের সুরক্ষার জন্য। সহিংসতা বন্ধের দাবিতে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
আইএসএফ নেতার দাবি
ভাঙড়ে মনোনয়ন জমা দেয়া নিয়ে তৃণমূল ও আইএসএফের মধ্যে ব্যাপক গোলমাল হয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশে পুলিশি নিরাপত্তায় শেষ পর্যন্ত আইএসএফ প্রার্থীরা মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। আইএসএফ নেতা নওসাদ সিদ্দিকি এসেছিলেন নির্বাচন কমিশনে, গ্রামবাসী ও কর্মীদের নিরাপত্তার দাবি নিয়ে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বিজেপি নারী মোর্চার প্রতিবাদ
পঞ্চায়েত নির্বাচনে সহিংসতার প্রতিবাদে বিজেপি নারী মোর্চার সদস্যরা রাস্তায় বসে প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
প্রতিবাদে কংগ্রেসও
রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সামনে কংগ্রেস কর্মীরাও প্রতিবাদ জানান। চোপড়া, ভাঙড়, মুর্শিদাবাদে কংগ্রেস কর্মীরাও সহিংসতার শিকার হয়েছেন, একজন মারা গেছেন বলে অভিযোগ।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
দাঙ্গাবিরোধী পুলিশ
বিরোধীদের প্রতিবাদ সামলাতে নামানো হয়েছিল দাঙ্গাবিরোধী পুলিশও। অথচ, রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় যখন সহিংসতা হয়েছে, তখন উপযুক্ত সংখ্য়ায় পুলিশ ছিল না বা থাকলেও তারা নীরব দর্শক ছিল বলে অভিযোগ বিরোধী দলগুলির।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
13 ছবি1 | 13
ভোট রাজনীতি অঙ্ক
কালীগঞ্জ সংখ্যালঘু অধ্যুষিত একটি কেন্দ্র, এখানে ৫৯ শতাংশ মানুষ মুসলমান সম্প্রদায়ের। হিন্দুরা ৪১ শতাংশ। বাম আমলে আরএসপির ধনঞ্জয় মোদক এই কেন্দ্রে জয়ী হয়েছেন। গত কয়েকটি নির্বাচনে সংখ্যালঘু প্রার্থীরাই কালীগঞ্জ থেকে নির্বাচিত হয়েছেন, এবারও তার ব্যতিক্রম হল না।
২০১৬-র বিধানসভা ভোটে প্রায় ৪৭ হাজার ভোটে জিতেছিলেন নাসিরউদ্দিন। তার কন্যা জয়ী হয়েছেন ৫০ হাজারের বেশি ভোটে। গত বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ছিল যথাক্রমে ৫৪ ও ৪৭ শতাংশ। পেশাদার সফটওয়্যার কর্মী আলিফার প্রাপ্ত ভোট ৫৫ শতাংশের বেশি।
এখানে বিজেপি প্রার্থী আশিস ঘোষ ৫২ হাজারের কিছু বেশি ভোট পেয়েছেন। বাম সমর্থিত জোট প্রার্থী, কংগ্রেসের কাবিলউদ্দিন আহমেদ ২৮ হাজারের কিছু বেশি ভোট পেয়েছেন, যা প্রদত্ত ভোটের ১৫ শতাংশ। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের তুলনায় বিজেপির ভোট এখানে তিন শতাংশের বেশি কমেছে। এই ভোট বাম-কংগ্রেস পেলে তাদের ভোট কিছুটা বাড়ত, বরং তৃণমূলের ভোট বেড়েছে উপনির্বাচনে।
গত কয়েক মাসে নিয়োগ দুর্নীতি থেকে ওয়াকফ বিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে বিজেপি চড়া হিন্দুত্ববাদী প্রচার চালিয়েছিল। মুর্শিদাবাদ, মালদায় গন্ডগোল হয়েছিল। তার কোনো প্রভাব কি কালীগঞ্জের ফলে পড়ল না?
যারা বিজয় উল্লাস করছিল, তাদের মধ্যে গুন্ডা-মস্তান ছিল: সুমন ভট্টাচার্য
This browser does not support the audio element.
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বিজেপির ভোট কমা সত্ত্বেও দাবি করেছেন, "নদিয়ার হিন্দু অধ্যুষিত কেন্দ্রে ৭০-৮০ শতাংশ মানুষ বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের ৭০ শতাংশ হিন্দু ভোট একত্রিত হলে আমরা সরকার গড়তে পারব।"
কিন্তু কালীগঞ্জে যে এক লক্ষের উপর হিন্দু ভোট রয়েছে, তাদের ৫০ শতাংশ ভোটারের সমর্থন কি বিজেপির দিকে গিয়েছে? প্রশ্ন উঠেছে, বিজেপি তা হলে কেন ৫২ হাজারের বেশি ভোট পেল না। বাকি হিন্দু ভোটের একটা বড় অংশ তৃণমূল পেয়েছে। কিছুটা পেয়েছে কংগ্রেস।
সাংবাদিক প্রসূন আচার্য বলেন, "মুর্শিদাবাদ ও মালদার ১০-১১টি বিধানসভা আসনে বাম-কংগ্রেস জোট প্রার্থীরা লোকসভা নির্বাচনে এগিয়েছিলেন। যদি জোট এই সংখ্যা বিধানসভা ভোটে ১৫টিতে নিয়ে যেতে পারে তাহলে ক্ষতি হবে তৃণমূলের। কালীগঞ্জে মুসলিম ভোটের বিভাজন হয়েছে বলেই সিপিএম সমর্থকের বাড়িতে বোমা পড়েছে। যারা গ্রেপ্তার হয়েছে, তারা মুসলমান। ভোটারদের হিন্দু ও মুসলমানে ভাগ করার যে প্রবণতা ২০১৪ সাল থেকে দেখা যাচ্ছে, সেটা ভয়ঙ্কর। বিজেপি হিন্দু ভোটের কথা বলছে, আর তৃণমূল জগন্নাথধামের প্রসাদ বিলি করছে। মানুষ কিন্তু এর বাইরে গিয়ে পেটের কথা চিন্তা করে, দৈনন্দিন জীবনের কথা ভেবেও ভোট দেয়।"
রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় তৃণমূলের মুসলমান ভোট কিছু অংশ হলেও সিপিএম ও কংগ্রেসের জোট প্রার্থীর দিকে চলে যাওয়া চিন্তায় রাখবে রাজ্যের শাসক দলকে।
সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য বলেন, "আমি বলব না যে, সংখ্যালঘু ভোট সম্পূর্ণ সরে গিয়েছে। মুর্শিদাবাদ ও মালদার সাম্প্রতিক ঘটনার পরে বাঙালি হিন্দু যেমন আশঙ্কিত, তেমনি শান্তিপ্রিয় মুসলিমরাও যথেষ্ট চিন্তিত। তারা অবশ্যই রাজ্যের শাসক দলকে বার্তা পাঠাচ্ছে। সেই বার্তা রাজ্যের শাসক দলকে পড়তে হবে। যদি তারা কংগ্রেসের দিকে সরতে শুরু করে, তাহলে অবশ্যই চিন্তার বিষয় আছে। এখনো হয়তো সংখ্যালঘু ভোট পুরো সরেনি। কালীগঞ্জের বার্তা এটাই, শান্তিপ্রিয় মুসলমানরা কোনো ধরনের অশান্তিকে প্রশ্রয় দিতে চান না। সেই বার্তা বা দেওয়াল লিখন রাজ্যের শাসক দলকে পড়তে হবে।"
মইদুল ইসলাম বলেন, "কোনো দলই কোনো সম্প্রদায়ের ১০০ শতাংশ ভোট পায় না। সামান্য কিছু ভোট তো যেতই বিরোধী শিবিরে। বিজেপিও মুসলমানদের আট শতাংশের ভোট পায়। কালীগঞ্জে যদি বাম-কংগ্রেস কোনো প্রার্থী না-ও দিত, যদি একটা বৃহত্তর জোট হত যা অবশ্য মতাদর্শগত কারণে সম্ভব নয়, সে ক্ষেত্রেও বিরোধীদের মিলিত ভোট তৃণমূলের থেকে বেশি হত না। যে ব্যবধানে তৃণমূল জিতেছে, আর যে ভোট তারা পেয়েছে, সেটা দেখলে এটা বোঝা যাবে। মুসলমানদের ৭৫ শতাংশ ভোট গত কয়েকটা নির্বাচনে তৃণমূলের দিকে গিয়েছে। এবারও সেটা দেখা গেল। সাগরদিঘি একটা ব্যতিক্রম ছিল। তাও সেখানকার বিধায়ক বায়রন বিশ্বাস তৃণমূলে চলে গিয়েছেন।