1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বিজয় উল্লাসে বোমা কেন?

পায়েল সামন্ত পশ্চিমবঙ্গ
২৪ জুন ২০২৫

উপনির্বাচনে শাসক দলের জয়ের পরে চলে গেল একটি প্রাণ। কালীগঞ্জে তৃণমূলের বিজয় মিছিলে বোমা ফেটে মৃত্যু হল নাবালিকার। চারজন গ্রেপ্তার হলেও আদালতে যাওয়ার হুঁশিয়ারি মৃতের মায়ের।

পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনে সহিংসতার ছবি
ফাইল চিত্রছবি: Srijit Roy

নদিয়ার কালীগঞ্জ উপনির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় পেয়েছে তৃণমূল। নাসিরউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুতে আসনটি খালি হয়েছিল। বিধানসভা নির্বাচনের ১১ মাস আগে উপনির্বাচনে প্রয়াত বিধায়কের কন্যা আলিফা আহমেদ জয়ী হলেন।

বোমাবাজিতে মৃত্যু 

উপনির্বাচনের গণনা যত এগোচ্ছিল, ততই ব্যবধান বাড়াচ্ছিলেন তৃণমূল প্রার্থী। দুপুরের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে তৃণমূলের ভোট বাড়তে চলেছে এই কেন্দ্রে। অতি উৎসাহী কর্মী-সমর্থকেরা বিজয় মিছিল শুরু করে দেন ভোট গণনা শেষ হওয়ার আগেই।

কালীগঞ্জ থানার বড়চাঁদঘর এলাকার মোলান্দি গ্রামে বিজয় মিছিলের সময়ে বোমার টুকরো লেগে মারা যায় চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়া তামান্না খাতুন। পুকুর থেকে স্নান সেরে মায়ের সঙ্গে বাড়ি ফিরছিল সে। বিজয় মিছিল তাদের কাছাকাছি এলে জোরালো শব্দে বোমা বিস্ফোরণ হয়। তাতেই ছিটকে পড়ে বছর নয়েকের মেয়েটি। তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। বোমার আঘাতে গলায় গভীর ক্ষত তৈরি হয় শিশুটির।

বোমার আঘাতে ছিটকে পড়েন নাবালিকার মা সাবিনা ইয়াসমিন। তার বক্তব্য, "আমি ওর হাত ধরে বাড়ি ফিরছিলাম। হঠাৎ বিকট আওয়াজ। চারদিক ধোঁয়ায় ঢেকে যায়। মেয়েটা আমার হাত ছেড়ে একদিকে পড়ে যায়, আমি অন্যদিকে ছিটকে যাই। ধোঁয়া কেটে গেলে দেখলাম, মেয়েটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে।"

নিজেকে সিপিএম সমর্থক দাবি করে সাবিনা বলেন, "ওদের ভোট দিইনি বলে এটা করলো। আমরা রাজনীতি করি না। বাবার আমল থেকে সিপিএম-কে ভোট দিই। আমি দেখেছি কারা বোমা মেরেছে। ওদের নাম না জানলেও সকলের মুখ চেনা। সবাই তৃণমূল করে।"

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক্স হ্যান্ডেলে কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়ে লেখেন, "আমি গভীরভাবে মর্মাহত। নিহতের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই। পুলিশ আইনি পদক্ষেপ নেবে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নেবে পুলিশ।"

এই ঘটনায় ২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। মৃতের পরিবার পুলিশকে ২৪ ঘণ্টা সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে সব অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা, গ্রাম থেকে বোমা উদ্ধার ও শান্তি নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি পুলিশকে দিতে হবে। সাবিনার কথায়, "পুলিশ ব্যবস্থা না নিলে আদালতে যাব। সিবিআই তদন্ত চাইবো।"

রাজনীতি ও হিংসা

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির সঙ্গে হিংসা জড়িয়ে গিয়েছে ওতপ্রোতভাবে। কয়েক দশক ধরেই এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। নির্বাচন এলে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ে। বিশেষ করে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়। গত পঞ্চায়েত ভোটেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। 

২০২৬ সালের মে মাসে বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা। সেই হিসেবে চলতি বিধানসভার মেয়াদ আর ১১ মাসের মতো। তার আগে একটি কেন্দ্রের উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করেও নিরীহ শিশুর প্রাণ চলে গেল, যা নিয়ে সর্বত্র নিন্দার ঝড় উঠেছে। পাল্টা সাফাই দিচ্ছে শাসক দলও।

কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী বলেন, "জিতলে মানুষ আনন্দ করে। এরা তা নয়। জিতলে তৃণমূল বদলা নেয়। যারা ভোট দেয়নি, তাদের উপরে হামলা করলো।''

তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ বলেন, "পুলিশ খোঁজ নেবে যে, তৃণমূলের এই বিপুল জয় কোনোভাবে কালিমালিপ্ত করার জন্য, ভিতর থেকে কেউ ওখানে গ্রামের মধ্যে এমন কিছু করে দিয়েছে কিনা, যাতে খারাপ ধারণা তৈরি হয়।"

তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে এই ঘটনা ঘটেছে কিনা, তা-ও তদন্তের আওতায় রয়েছে। কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার সুপার অমরনাথ কে বলেন, "২০২৩ সাল থেকে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল ওই এলাকায়। তার জেরে এই ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।"

সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, "কে কোন দল করে বড় কথা নয়, গ্রামের রাস্তায় একটা নয় বছরের শিশুর উপরে বোমা মারা হয়েছে, এটাই খুব দুর্ভাগ্যজনক।"

সাবেক পুলিশকর্তা সলিল ভট্টাচার্য বলেন, "বাংলার মানুষ জানতে চায় আইনের শাসন সম্পর্কে পুলিশ-প্রশাসনের কী ভূমিকা? জেলাশাসক, কৃষ্ণনগর পুলিশের এসপির ভূমিকা কী? সংবেদনশীল জায়গাগুলো কি চিহ্নিত করা হয়েছিল?"

সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য বলেন,  "কোনোভাবেই এই ঘটনাকে আড়াল করা যাবে না বা অজুহাত দিয়ে চাপা দেয়া যাবে না। গত কয়েক বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি ক্রমশ গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, তোলাবাজির অভিযোগে দীর্ণ হয়ে উঠেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হিংসা। আমাদের সমাজ যেন মবোক্রেসি দ্বারা আক্রান্ত না হয়ে যায়, যেখানে অন্য সবকিছুকে ভুলে গিয়ে রাস্তার বিচার বা হিংসা একমাত্র নির্ণায়ক হয়ে ওঠে।" 

রাজনৈতিক বিশ্লেষক, অধ্যাপক মইদুল ইসলাম বলেন, "পশ্চিমবঙ্গে গত দেড়-দুই দশকের রাজনীতিতে অনেক অপরাধী ঢুকে গিয়েছে। একটা বিজয় মিছিলে হবে, সেখানে বোমা পড়ার কোনো কারণ নেই। তার মানে যারা বিজয় উল্লাস করছিল, তাদের মধ্যে গুন্ডা-মস্তান ছিল। এটাকে মবোক্রেসি বলতে আমি রাজি নই। ভোট তো শান্তিতেই মিটেছিল। বিরোধীরাও সেভাবে পুনর্নির্বাচনের দাবি করেনি। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন যে ভোট পরিচালনা করে, সেটা মোটের উপরে শান্তিতেই হয়। তবে ভোট পরবর্তী হিংসা কিন্তু হয়েই চলেছে।"

ভোট রাজনীতি অঙ্ক 

কালীগঞ্জ সংখ্যালঘু অধ্যুষিত একটি কেন্দ্র, এখানে ৫৯ শতাংশ মানুষ মুসলমান সম্প্রদায়ের। হিন্দুরা ৪১ শতাংশ। বাম আমলে আরএসপির ধনঞ্জয় মোদক এই কেন্দ্রে জয়ী হয়েছেন। গত কয়েকটি নির্বাচনে সংখ্যালঘু প্রার্থীরাই কালীগঞ্জ থেকে নির্বাচিত হয়েছেন, এবারও তার ব্যতিক্রম হল না। 

২০১৬-র বিধানসভা ভোটে প্রায় ৪৭ হাজার ভোটে জিতেছিলেন নাসিরউদ্দিন। তার কন্যা জয়ী হয়েছেন ৫০ হাজারের বেশি ভোটে। গত বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ছিল যথাক্রমে ৫৪ ও ৪৭ শতাংশ। পেশাদার সফটওয়্যার কর্মী আলিফার প্রাপ্ত ভোট ৫৫ শতাংশের বেশি।

এখানে বিজেপি প্রার্থী আশিস ঘোষ ৫২ হাজারের কিছু বেশি ভোট পেয়েছেন। বাম সমর্থিত জোট প্রার্থী, কংগ্রেসের কাবিলউদ্দিন আহমেদ ২৮ হাজারের কিছু বেশি ভোট পেয়েছেন, যা প্রদত্ত ভোটের ১৫ শতাংশ। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের তুলনায় বিজেপির ভোট এখানে তিন শতাংশের বেশি কমেছে। এই ভোট বাম-কংগ্রেস পেলে তাদের ভোট কিছুটা বাড়ত, বরং তৃণমূলের ভোট বেড়েছে উপনির্বাচনে।

গত কয়েক মাসে নিয়োগ দুর্নীতি থেকে ওয়াকফ বিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে বিজেপি চড়া হিন্দুত্ববাদী প্রচার চালিয়েছিল। মুর্শিদাবাদ, মালদায় গন্ডগোল হয়েছিল। তার কোনো প্রভাব কি কালীগঞ্জের ফলে পড়ল না? 

যারা বিজয় উল্লাস করছিল, তাদের মধ্যে গুন্ডা-মস্তান ছিল: সুমন ভট্টাচার্য

This browser does not support the audio element.

বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বিজেপির ভোট কমা সত্ত্বেও দাবি করেছেন, "নদিয়ার হিন্দু অধ্যুষিত কেন্দ্রে ৭০-৮০ শতাংশ মানুষ বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের ৭০ শতাংশ হিন্দু ভোট একত্রিত হলে আমরা সরকার গড়তে পারব।" 

কিন্তু কালীগঞ্জে যে এক লক্ষের উপর হিন্দু ভোট রয়েছে, তাদের ৫০ শতাংশ ভোটারের সমর্থন কি বিজেপির দিকে গিয়েছে? প্রশ্ন উঠেছে, বিজেপি তা হলে কেন ৫২ হাজারের বেশি ভোট পেল না। বাকি হিন্দু ভোটের একটা বড় অংশ তৃণমূল পেয়েছে। কিছুটা পেয়েছে কংগ্রেস।

সাংবাদিক প্রসূন আচার্য বলেন, "মুর্শিদাবাদ ও মালদার ১০-১১টি বিধানসভা আসনে বাম-কংগ্রেস জোট প্রার্থীরা লোকসভা নির্বাচনে এগিয়েছিলেন। যদি জোট এই সংখ্যা বিধানসভা ভোটে ১৫টিতে নিয়ে যেতে পারে তাহলে ক্ষতি হবে তৃণমূলের। কালীগঞ্জে মুসলিম ভোটের বিভাজন হয়েছে বলেই সিপিএম সমর্থকের বাড়িতে বোমা পড়েছে। যারা গ্রেপ্তার হয়েছে, তারা মুসলমান। ভোটারদের হিন্দু ও মুসলমানে ভাগ করার যে প্রবণতা ২০১৪ সাল থেকে দেখা যাচ্ছে, সেটা ভয়ঙ্কর। বিজেপি হিন্দু ভোটের কথা বলছে, আর তৃণমূল জগন্নাথধামের প্রসাদ বিলি করছে। মানুষ কিন্তু এর বাইরে গিয়ে পেটের কথা চিন্তা করে, দৈনন্দিন জীবনের কথা ভেবেও ভোট দেয়।"

রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় তৃণমূলের মুসলমান ভোট কিছু অংশ হলেও সিপিএম ও কংগ্রেসের জোট প্রার্থীর দিকে চলে যাওয়া চিন্তায় রাখবে রাজ্যের শাসক দলকে।

সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য বলেন, "আমি বলব না যে, সংখ্যালঘু ভোট সম্পূর্ণ সরে গিয়েছে। মুর্শিদাবাদ ও মালদার সাম্প্রতিক ঘটনার পরে বাঙালি হিন্দু যেমন আশঙ্কিত,  তেমনি শান্তিপ্রিয় মুসলিমরাও যথেষ্ট চিন্তিত। তারা অবশ্যই রাজ্যের শাসক দলকে বার্তা পাঠাচ্ছে। সেই বার্তা রাজ্যের শাসক দলকে পড়তে হবে। যদি তারা কংগ্রেসের দিকে সরতে শুরু করে, তাহলে অবশ্যই চিন্তার বিষয় আছে। এখনো হয়তো সংখ্যালঘু ভোট পুরো সরেনি। কালীগঞ্জের বার্তা এটাই, শান্তিপ্রিয় মুসলমানরা কোনো ধরনের অশান্তিকে প্রশ্রয় দিতে চান না। সেই বার্তা বা দেওয়াল লিখন রাজ্যের শাসক দলকে পড়তে হবে।"

মইদুল ইসলাম বলেন, "কোনো দলই কোনো সম্প্রদায়ের ১০০ শতাংশ ভোট পায় না। সামান্য কিছু ভোট তো যেতই বিরোধী শিবিরে। বিজেপিও মুসলমানদের আট শতাংশের ভোট পায়। কালীগঞ্জে যদি বাম-কংগ্রেস কোনো প্রার্থী না-ও দিত, যদি একটা বৃহত্তর জোট হত যা অবশ্য মতাদর্শগত কারণে সম্ভব নয়, সে ক্ষেত্রেও বিরোধীদের মিলিত ভোট তৃণমূলের থেকে বেশি হত না। যে ব্যবধানে তৃণমূল জিতেছে, আর যে ভোট তারা পেয়েছে, সেটা দেখলে এটা বোঝা যাবে।  মুসলমানদের ৭৫ শতাংশ ভোট গত কয়েকটা নির্বাচনে তৃণমূলের দিকে গিয়েছে। এবারও সেটা দেখা গেল। সাগরদিঘি একটা ব্যতিক্রম ছিল। তাও সেখানকার বিধায়ক বায়রন বিশ্বাস তৃণমূলে চলে গিয়েছেন।

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ