পোশাক কারখানা তুবা গ্রুপের শ্রমিকদের বেতন, ভাতা আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বিজিএমইএ নেতারা৷ তাঁরা বলেছেন, মালিক জেলে থাকায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
শ্রমিকরা ঈদ করতে না পারায় দুঃখও প্রকাশ করেন বিজিএমইএ নেতারা৷ তবে বকেয়া বেতন-ভাতার টাকা হাতে না পাওয়া পর্যন্ত অনশন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শ্রমিকরা৷
ঈদের ছুটি শেষ হওয়ার পর প্রথম কর্মদিবসে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে বিজিএমইএ নেতারা এই প্রতিশ্রতি দেন৷ তবে বিজিএমইএ-র বর্তমান কমিটির সভাপতি আতিকুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না৷ সাতদিনের মধ্যে বেতন-ভাতা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেন বিজিএমইএ-র সাবেক সহসভাপতি টিপু মুন্সি৷
বিজিএমইএ ভবনে বৃহস্পতিবার বিকেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে টিপু মুন্সি বলেন, ‘‘ঈদের মধ্যে শ্রমিকদের বেতন, বোনাস সংক্রান্ত যে ধরনের হয়রানি হয়েছে তার জন্য আমরা অত্যন্ত দুঃখিত৷ ব্যাংকের কাছ থেকে আমাদের যে টাকা পাওয়ার কথা ছিলো তা পাওয়া যায়নি বলেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷''
পোশাক শ্রমিকদের অনিশ্চিত ভবিষ্যত
বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের কর্ম পরিবেশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে আমাদের ঢাকা প্রতিনিধি হারুন উর রশীদ স্বপন সম্প্রতি গিয়েছিলেন একটি পোশাক কারখানায়৷ তাঁর অভিজ্ঞতা ছবিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই ছবিঘরে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
অনিশ্চিত ভবিষ্যত
ঢাকার পূর্ব রামপুরার টিএম গার্মেন্টস-এর এই কর্মীরা জানেন না তাঁদের ভবিষ্যত৷ কারণ তাঁদের এখানে শ্রম আইন এবং মজুরি বোর্ড পুরোপুরি কার্যকর নেই৷ তাঁদের অগ্নিনিরাপত্তাও পর্যাপ্ত নয়৷ এমনকি ভবনটিও পুরনো৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
সংসার চালানো কষ্টকর
টিএম গার্মেন্টস-এর পোশাক কর্মী সুফিয়া বেগম যে বেতন পান তা দিয়ে সংসার চালান কষ্টকর৷ তবুও তার এরচেয়ে বেশি কিছু করার সুযোগ নেই৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
সর্বনিম্ন বেতনও পান না
সর্বনিম্ন বেতন ৩০০০ টাকা দেয়ার কথা থাকলেও রাহেলা আক্তার তা পান না৷ তাঁকে বেতন দেয়া হয় ২৫০০ টাকা৷ সে নতুন বলেই তাঁকে নাকি কম বেতন দেয়া হয়৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
নতুন, তাই বেতন কম
সুমি বেগমেরও বেতন অনেক কম৷ কারণ তিনিও নতুন৷ খরচে পোষায় না বলে তাঁরা পাঁচজন মিলে একটি রুম ভাড়া নিয়ে থাকেন৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
গেটে তল্লাশি
এই পোশাক কর্মীদের গার্মেন্টস-এ প্রবেশ এবং বের হওয়ার আগে গেটে তল্লাশী চালানো হয়৷ আর ‘ফ্রেশ’ হতে গেলেও বলে যেতে হয়৷ আর ফিরতে যদি একটু দেরি হয়, তাহলে মেলে গালমন্দ৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ
ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করেন এঁরা৷ তাপ ওপর মেশিনপত্রও পুরনো৷ কাজ করতে গিয়ে পুরনো মেশিনপত্রের কোনো ক্ষতি হলে কখনো কখনো জরিমানাও করা হয় তাঁদের৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
রঙিন স্বপ্ন
রঙিন পোশাক আর রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় আসেন কুড়িগ্রামের মৌসুমী৷ পোশাক কারখানায় কাজ নেয়ার পর ধীরে ধীরে তাঁর স্বপ্ন ফিকে হয়ে আসছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
শ্রমিকরা অপুষ্টির শিকার
আছিয়া বেগমকে দেখেই বোঝা যায় তিনি অপুষ্টির শিকার৷ সকাল-সন্ধ্যা গার্মেন্টস-এ কাজ করেও তিনি জোটাতে পারেন তাঁর প্রয়োজনীয় খাবার৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
8 ছবি1 | 8
তিনি বলেন, ‘‘কিছু টাকা যা অন্যান্য জায়গা থেকে ব্যবস্থা করে তুবা গ্রুপের কয়েকটি কারখানায় পরিশোধ করা হয়৷ কিন্তু সব কারখানার শ্রমিকদের বেতন দেয়া যায়নি৷ আশা করছি, আগামী এক সপ্তাহ বা সাত কর্ম দিবসের মধ্যেই তুবার শ্রমিকদের বেতন, ভাতাদি পরিশোধ করা সম্ভব হবে৷''
তুবা গ্রুপের আমরণ অনশনে অংশ নেয়া শ্রমিকদের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে বিজিএমইএ-র দ্বিতীয় সভাপতি এসএম মান্নান কচি বলেন, ‘‘আপনাদের দাবির সঙ্গে আমরা শতভাগ একমত৷ একটু ধৈর্য্য ধরুন৷ আমাদের একটু সময় দিন৷''
সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ-র সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, ‘‘আমাদের কার্যক্রম শেষ করতে অন্তত সাত কার্যদিবসের দরকার৷ শ্রমিক ভাইবোনদের বলব একটু ধৈর্য্য ধরুন৷ আমরণ অনশন কোনো সমাধান না৷''
বিজিএমইএ নেতারা বলেন, তুবা গ্রুপের মালিক জেলে থাকায় বর্তমানে ক্রেতারা কার্যাদেশ দিতে অনীহা প্রকাশ করছে৷ অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারড বিল্ডিং-এ অবস্থিত হওয়ায় সাব সাব কন্ট্রাক্টের কাজও পাচ্ছেন না৷ এই পরিস্থিতিতে আর্থিক সংকটে পড়ায় মে, জুন, জুলাই মাসের শ্রমিকদের বেতন দিতে পারেনি গ্রুপটি৷
বিকেলে বিজিএমইএ-র সংবাদ সম্মেলনের পর সন্ধ্যায় শ্রমিকরা বেতন-ভাতা না পাওয়া পর্যন্ত অনশন আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন৷ আন্দোলনরত শ্রমিকরা বিজিএমইএ-র এই প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রাখতে পারছেন না৷ তাঁরা বলছেন, ‘‘টাকা হাতে না পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন থামবে না, আন্দোলন চলবেই৷''
পোশাক শিল্পে শ্রমশোষণ: ব্রিটেন থেকে বাংলাদেশ
দু মুঠো অন্নের সংস্থান করতে রানা প্লাজায় গিয়ে লাশ হয়ে ফিরেছিলেন এগোরো শ-রও বেশি মানুষ৷ যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের অনেকেরই বাকি জীবন কাটবে দুর্বিষহ কষ্টে৷ পোশাক শ্রমিকদের জীবনের এই নির্মমতার ইতিহাস কিন্তু অনেক দীর্ঘ৷
ছবি: DW/M. Mohseni
বৈশ্বিক শিল্প
প্রতিটি পোশাকে মিশে থাকে শ্রমিকের শ্রম-রক্ত-ঘাম৷ ১৯৭০-এর দশক থেকে ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো এশিয়া আর ল্যাটিন অ্যামেরিকার কিছু দেশ থেকে পোশাক কিনতে শুরু করে৷ খুব কম মজুরিতে শ্রমিক পাওয়া যায় বলে দাম পড়ে কম, লাভ হয় বেশি৷ এমন সুযোগ ছাড়ে তারা! কম টাকায় পণ্য কিনবেন, ছবির মতো পোশক তৈরি হবে মিষ্টির দোকানে – তারপর আবার শ্রমিকের অধিকাররক্ষা, পরিবেশ দূষণ রোধ করবেন – তাও কি হয়!
ছবি: picture-alliance/dpa
সবার জন্য পোশাক
বড় আঙ্গিকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পোশাক তৈরি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্রিটেনে, অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই শিল্পবিপ্লবের সময়টাতে৷ এখন বিশ্বাস করতে অনেকের হয়ত কষ্ট হবে, তবে ইতিহাস বলছে, শিল্পবিপ্লবের ওই প্রহরে ব্রিটেনের লন্ডন আর ম্যানচেস্টারও শ্রমিকদের জন্য ছিল আজকের ঢাকার মতো৷ শতাধিক কারখানা ছিল দুটি শহরে৷ শিশুশ্রম, অনির্ধারিত কর্মঘণ্টার সুবিধাভোগ, অল্প মজুরি, কারখানার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ – সবই ছিল সেখানে৷
ছবি: gemeinfrei
সেই যুক্তরাষ্ট্র এখন কর্তৃত্বে
যুক্তরাষ্ট্রেও পোশাকশ্রমিকরা স্বর্গসুখে ছিলেন না সব সময়৷ সেখানেও এক সময় কারখানায় আগুন লাগলে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের ভেতরে রেখেই সদর দরজায় তালা লাগাতো৷ ১৯১১ সালে তাই নিউ ইয়র্কের ট্রায়াঙ্গেল শার্টওয়েস্ট ফ্যাক্টরিতে পুড়ে মরেছিল ১৪৬ জন শ্রমিক৷ মৃতদের অধিকাংশই ছিলেন নারী৷ মজুরি, কর্মঘণ্টা, কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা – কোনো কিছুই এশিয়ার এখনকার কারখানাগুলোর চেয়ে ভালো ছিল না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পোশাক শিল্পে চীন বিপ্লব
পোশাক রপ্তানিকারী দেশগুলোর মধ্যে চলছে সবচেয়ে কম খরচে পোশাক তৈরির প্রতিযোগিতা৷ রপ্তানিকারী দেশগুলোর মধ্যে চীনের অবস্থা সবচেয়ে ভালো৷ রপ্তানি সবচেয়ে বেশি, শ্রমিকদের মজুরিও খুব ভালো৷ চীনে একজন পোশাক শ্রমিক এখন মাস শেষে ৩৭০ ইউরো, অর্থাৎ, বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৭ হাজার টাকার মতো পেয়ে থাকেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শ্রমশোষণ কাকে বলে...
ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য তামিলনাড়ুর সুমাংগলি৷ তামিল শব্দ ‘সুমাংগলি’-র অর্থ, ‘যে নববধু সম্পদ বয়ে আনে’৷ এলাকায় পোশাক এবং সুতা তৈরির প্রশিক্ষণের নামে খাটানো হয় প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার মেয়েকে৷ দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করে তাঁরা হাতে পান ৬০ ইউরো সেন্ট, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় ৬০ টাকা৷ সে হিসেবে মাস শেষে পান ১৮০০ টাকা৷ টাকাটা তাঁদের খুব দরকার৷ বিয়ের সময় বাবাকে তো যৌতুক দিতে হবে!
ছবি: picture-alliance/Godong
অধিকার আদায়ের করুণ সংগ্রাম
কম্বোডিয়াতেও অবস্থা খুব খারাপ৷ ৩ লক্ষের মতো পোশাক শ্রমিক আছে সে দেশে৷ কাজের পরিবেশ আর অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কেমন? মাসিক বেতন মাত্র ৫০ ইউরো, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় বড় জোর ৫ হাজার টাকা৷ মালিকের কাছে শ্রমিকদের মানুষের মর্যাদা প্রাপ্তি সৌভাগ্যের ব্যাপার৷ মজুরি বাড়ানোর দাবিতে মিছিলে নেমে শ্রমিকরা মালিকপক্ষের গুলিতে মরেছেন – এমন দৃষ্টান্তও আছে সেখানে৷
ছবি: Reuters
ট্র্যাজেডি
গত ২৪শে এপ্রিল বাংলাদেশের রানা প্লাজা ধসে পড়ায় মারা যান ১১শ-রও বেশি তৈরি পোশাককর্মী৷ দেয়ালে ফাটল ধরার পরও সেখানে কাজ চালিয়ে যাওয়ায় এতগুলো জীবন শেষ হওয়াকে বিশ্বের কোনো দেশই ভালো চোখে দেখেনি৷ ঘটনার পর জার্মানির এইচঅ্যান্ডএম, কেআইকে এবং মেট্রোসহ বিশ্বের ৮০টির মতো পোশাক কোম্পানি শ্রমিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য পোশাক রপ্তানিকারী কারখানাগুলোর সঙ্গে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে৷
ছবি: Reuters
আলোয় ঢাকা আঁধার
অভিজাত বিপণিবিতান কিংবা দোকানের পরিপাটি পরিবেশে ঝলমলে আলোয় ঝিকমিক করে থরে থরে সাজানো বাহারি সব পোশাক৷ দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায়৷ ক্রেতাদের ক’জনের মনে পড়ে রানা প্লাজা কিংবা অতীতের ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্রের ভাগ্যাহতদের কথা?
ছবি: DW/M. Mohseni
8 ছবি1 | 8
শ্রমিকরা বলেন, ‘‘গত তিনদিন ধরে অনাহারে থেকে আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি৷ ঈদও এই কারখানায় কেটেছে৷ আমাদেরকে মালিক ও বিজিএমই-র কেউ দেখতে পর্যন্ত আসেনি৷ এখন শ্রমিকদের আন্দোলন দেখে বিজিএমইএ-র টনক নড়েছে৷ তাই তাঁরা বলছে আগামী সাতদিনের মধ্যে বেতন-ভাতা পরিশোধ করবে৷''
তাঁরা বলেন, ‘‘আমরা তাঁদের এই কথায় আস্থা রাখতে পারছি না৷ কারণ এর আগেও মালিকপক্ষ বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা রক্ষা করতে পারেনি৷ তাই টাকা হাতে না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবেই৷''
প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ঈদের আগে বেতন-ভাতা না পেয়ে ঢাকার বাড্ডায় তুবা গ্রুপের পাঁচটি পোশাক কারাখানার ১,৬০০ শ্রমিক ঈদের আগের দিন সোমবার থেকে আমরণ অনশন শুরু করেন৷ ঈদের দিনও তাঁরা অনশন করে কাটিয়ে দেন৷
তিনদিনের অনশনে এরই মধ্যে ৬৫ জন শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন৷ তাঁদের মধ্যে ২১ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে৷ বাকিদের কারখানার ভেতরেই চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে৷