এতদিন তিনি ছিলেন কার্যকরি সভাপতি, অমিত শাহ সভাপতি৷ এবার জে পি নাড্ডা অনুষ্ঠানিকভাবে বিজেপির সভাপতি নির্বাচিত হলেন৷
ছবি: IANS
বিজ্ঞাপন
গত এক বছরে পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে হয় হার হয়েছে অথবা ক্ষমতা হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে বিজেপির৷ সিএএ নিয়ে দেশজুড়ে ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপক বিক্ষোভ চলছে৷ দিল্লি বিধানসভায় কঠিন লড়াইও চলছে৷ এই আবহে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজেপির সভপতি হলেন জগত প্রকশ নাড্ডা। যিনি জে পি নাড্ডা বলেই বেশি পরিচিত৷ প্রায় ছয় বছর সভাপতি থাকার পর আপাতত বিদায় নিলেন অমিত শাহ৷ সাধারণত, বিজেপিতে 'এক ব্যক্তি এক পদ' নীতি অনুসরণ করা হয়৷ কিন্তু বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন থাকায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পরেও অমিত শাহ সভাপতির দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন৷ নাড্ডা ছিলেন কার্যকরি সভাপতি৷ তাঁকে হাতে কলমে কাজ শেখাচ্ছিলেন অমিত শাহ৷ পূর্ব পরিকল্পনামতোই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন অমিত শাহ৷ এ দিন শুধুমাত্র নাড্ডার মনোনয়নপত্রই জমা পড়েছে৷ ফলে কোনওরকম প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই নাড্ডা বিজেপি সভাপতি হয়েছেন৷
তবে দলের পক্ষে একটা কঠিন সময়ে নাড্ডা সভাপতি হলেন৷ সামনেই দিল্লি বিধানসভার নির্বাচন৷ প্রাক নির্বাচনী সমীক্ষা বলছে, দিল্লিতে কেজরিওয়াল এগিয়ে৷ দিল্লিতে যদি শেষ পর্যন্ত কেজরিওয়াল জিতে যান, তা হলে নাড্ডাকে হার দিয়েই শুরু করতে হবে৷ দিল্লির ভোটপর্ব শেষ হওয়ার পর এই বছর আর একটি রাজ্যেই বিধানসভা নির্বাচন হবে-- বিহার৷ নীতীশ কুমারের রাজ্যে ভোট নভেম্বরের মধ্যে করতে হবে৷ নীতীশের সঙ্গে জোট বহাল থাকলে বিহারে বিজেপি ভালো করতে পারে, কিন্তু লড়াই হবে৷ ২০২১ এ অসম, পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, পুডুচেড়িতে ভোট হওয়ার কথা৷ প্রতিটি রাজ্যেই কড়া মোকাবিলার মধ্যে পড়তে হবে বিজেপিকে৷ কেরল ও পুডুচেড়িতে বিজেপির উপস্থিতি সামান্য৷ প্রবল লড়াই হতে পারে অসম ও পশ্চিমবঙ্গে৷ ফলে নাড্ডার কাছে আগামী দিন খুব মসৃন নাও হতে পারে৷ লোকসভা নির্বাচনকে বাদ দিলে অমিত শাহের কাছেও গত একবছর নিঃসন্দেহে কঠিন ছিল৷ তৃণমূলের সাংসদ সুখেন্দু শেখর রায় ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, বিজেপির রাজনৈতিক রেখচিত্র এখন নিচের দিকে৷ এই অবস্থায় নাড্ডার কাজটা কঠিন৷ গত প্রায় ন-বছর ধরে তাঁকে রাজ্যসভায় দেখেছি৷ তিনি বলা যেতে পারে দলের নরমপন্থী মুখ৷ কিন্তু পিছনের আসল চেহারা তো মোদী-শাহ৷
প্রশ্ন হল, নাড্ডা বিজেপি সভাপতিহলেও দলের রাশ কি মোদী-শাহের হাতেই থাকবে? তাঁরা যেভাবে আগে চালাতেন, সেভাবেই কি চালাবেন, কেবল সামনে থাকবেন নরমপন্থী নাড্ডা? এমনিতে ধারেভারে অমিত শাহের ধারেকাছে নাড্ডা আসতে পারবেন না৷ তিনি হিমাচলের মতো ছোট রাজ্যের নেতা৷ সেরকম দাপুটে নেতাও নন৷ এমনিতে নাড্ডা খুবই ভদ্র ও কেন্দ্রে এবং রাজ্যে মন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও সেরকম সর্বভারতীয় ভাবমূর্তি নেই৷ অবশ্য বিজেপি সভাপতি হওয়ার সুবাদে অদূর ভবিষ্যতে তা পেয়ে যাবেন তিনি৷ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু ডয়েচে ভেলেকে বলেছেন, ''মোদী-শাহ দলকে যে জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন, সংগঠনকে য়ে রূপ দিয়েছেন, তাতে চাপ নিয়েই কাজ শুরু করতে হবে নাড্ডাকে। তবে আমি মনে করি, তিনি সেই পরীক্ষায় ভালোভাবেই উত্তীর্ণ হবেন৷''
সুখেন্দু শেখর বলছেন, ''নাড্ডা আসলে কাঠের পুতুল৷ তাঁকে যেভাবে চালানো হবে, তিনি সেভাবেই চলবেন৷ সে জন্যই তাঁকে গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয়েছে৷ দল আসলে চলবে মোদী-শাহের অঙ্গুলিহেলনেই৷ তাঁর দায়িত্ব হবে মোদী-শাহ ফর্মুলাকে রূপায়ণ করা৷''
বিজেপির একটা মজবুত পরিকাঠামো আছে৷ মোদী-শাহর কাজের একটা ধারা আছে৷ তাঁরা অনেক আগে থেকে পরিকল্পনা ছকে রাখেন৷ এ সবের পরেও বেশ কয়েকটি রাজ্যে সম্প্রতি বিজেপিকে হারতে হয়েছে বা জোটসঙ্গী জোগাড় করে কোনওমতে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পেরেছে তারা৷ ফলে নরমপন্থী নাড্ডার কাছে সামনের চ্যালেঞ্জ সত্যিই রীতিমতো বড়৷
বিজেপিকে চিনে নিন
ভারতে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি৷ বর্তমানে জাতীয় ও রাজ্যস্তরে সর্বাধিক প্রতিনিধিত্ব রাখা দলটি সদস্য সংখ্যায় বিশ্বের বৃহত্তম৷ ঐতিহাসিকভাবে হিন্দু-জাতীয়তাবাদী অবস্থানের বিজেপির গল্প এই ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/R. K. Singh
আদর্শগত উৎস
বিজেপিকে চিনতে হলে ‘সংঘ পরিবার’-এর অন্তর্গত হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলির উৎস আরএসএস অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘকে জানা দরকার৷ বিশ্বের বৃহত্তম এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা মারাঠি চিকিৎসক কেশব হেডগেওয়ার৷ ১৯২৫ সালে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি৷ ভি ডি সাভারকরের ‘হিন্দুত্ব’ চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণই আরএসএস-এর প্রধান উদ্দেশ্য৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে দূরত্ব
কংগ্রেসের নেতৃত্বে চলা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে দূরে ছিল আরএসএস৷ ১৯৪০-এর দশকে সংগঠনের নেতা হিসেবে এম এস গোলওয়ালকর হিন্দু রাষ্ট্র গড়তে ব্রিটিশ বিরোধিতার বদলে ধর্ম ও সংস্কৃতি রক্ষার ডাক দেন৷ উল্লেখ্য, পরবর্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়া অটলবিহারী বাজপেয়ী ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সময় সত্যাগ্রহীদের সাথে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন৷ লিখিত মুচলেকা দিয়ে আন্দোলনে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে ছাড়া পান তিনি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M.Desfor
দেশভাগ ও আরএসএস
দেশভাগের সময় আরএসএস পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুদের সাহায্য করে৷ আরএসএস ও বর্তমানের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির কর্মীরা মনে করেন, দেশভাগ মুসলিমদের প্রতি নরম আচরণের ফল৷ এজন্য গান্ধী ও নেহরুকে বিশেষভাবে দায়ী মনে করেন তাঁরা৷ স্বাধীনতার পর কংগ্রেসকে ঠেকাতে ১৯৫১ সালে জনসংঘ প্রতিষ্ঠা করেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়৷ সেই জনসংঘই আসলে বিজেপির উৎস৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
জরুরি অবস্থা ও জনতা পার্টির জন্ম
১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করেন৷ বিক্ষোভে অংশ নেয়ার কারণে জনসংঘের অসংখ্য সমর্থককে গ্রেপ্তার করা হয়৷ ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থা শেষে অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন৷ কংগ্রেসকে হারাতে অন্যান্য দলের সঙ্গে মিলে যায় জনসংঘ, জন্ম নেয় জনতা পার্টি৷ নির্বাচনে জিতেও যায় জনতা পার্টি৷ প্রধানমন্ত্রী হন মোরারজি দেশাই৷ স্বাধীন ভারতে সূচিত হয় হিন্দুত্ববাদীদের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ জয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিজেপির জন্ম
১৯৮০’র পর দল ও আরএসএসের দ্বৈত সদস্য হবার বিধান না থাকায় জন্ম নেয় ভারতীয় জনতা পার্টি৷ নতুন দলে নতুন সদস্য যোগ দিলেও, গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিল পুরোনোদের দাপট৷ প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন বাজপেয়ী৷ মূলত, ইন্দিরা হত্যার পর ভোটে খারাপ করার কারণেই নেতৃত্বে এই পরিবর্তন৷ তবে বিজেপির উত্থান শুরু ১৯৮৪ সালে৷ সে বছর দলের সভাপতি হন লালকৃষ্ণ আডবানি৷ রাম জন্মভূমির দাবিকে ঘিরে তাঁর নেতৃত্বেই শক্তিশালী হতে থাকে বিজেপি৷
ছবি: Getty Images/AFP/Raveendran
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও বাবরি মসজিদ
নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই বিজেপি সরাসরি ধর্মের রাজনীতিতে নামে৷ বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির গঠনের দাবিতে সারা দেশ থেকে অযোধ্যার পথে রওয়ানা দেয় হাজার হাজার ‘করসেবক’৷ পুলিশের সাথে সংঘর্ষের ফলে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে উত্তেজিত জনতা বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলে৷ এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিহত হন দু’ হাজারেরও বেশি মানুষ৷
ছবি: Getty Images/AFP/D .E. Curran
সরকার গঠন ও জোটের রাজনীতি
সাম্প্রদায়িক আবেগকে হাতিয়ার করে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিজেপি ১৬১টি লোকসভা আসনে জয়ী হয়৷ প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নেন অটলবিহারী বাজপেয়ী৷ কিন্তু ১৩ দিন পর, লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে ব্যর্থ হওয়ায় সরকার গঠন করতে পারেনি বিজেপি৷ ১৯৯৬ সালে আঞ্চলিক দলগুলির একটি জোট সরকার গঠন করে৷ কিন্তু সেই সরকারের স্থায়িত্ব দীর্ঘ হয়নি৷ ১৯৯৮ সালে আবার নির্বাচন হয়৷
ছবি: UNI
প্রথম এনডিএ সরকার
নির্বাচনে জিতে বিজেপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট (এনডিএ) সরকার গড়ে৷ জোটে অংশগ্রহণ করে সমতা পার্টি, অকালী দল, শিব সেনা, নিখিল ভারত আন্না দ্রাবিড় মুন্নেত্র কড়গম (এআইএআইডিএমকে), বিজু জনতা দল ও শিব সেনা৷ ১৯৯৯ সালে তাঁরা সংসদে ৩০৩টি আসন জিতলে বাজপেয়ী তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন৷ পাঁচ বছরের পূর্ণমেয়াদী এই জোট সরকার প্রতিরক্ষা ও সন্ত্রাসের মোকাবিলার পাশাপাশি নব্য-উদার অর্থনীতির ওপর জোর দেয়৷
ছবি: Imago/photothek/T. Koehler
দুর্নীতি ও দাঙ্গায় কোণঠাসা বিজেপি
বিজেপির জয়রথে প্রথম ‘বাধা’ গোধরা দাঙ্গা৷ তীর্থযাত্রীবাহী ট্রেনে আগুন লাগাকে ঘিরে প্রায় ২০০০ মানুষ মারা যান৷ তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীসহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিজেপি নেতার নাম এই দাঙ্গার সাথে জড়ায়৷ বিজেপি-প্রধান বঙ্গারু লক্ষ্মণের বিরুদ্ধে ওঠে দুর্নীতির অভিযোগ৷ সব মিলিয়ে বিপন্ন বিজেপিকে হারিয়ে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ জোট ২০০৪ সালে নতুন সরকার গড়ে৷ প্রধানমন্ত্রী হন মনমোহন সিং৷
ছবি: AP
নেতৃত্বে কে? মোদী, না আডবাণী?
২০১৪’র লোকসভা নির্বাচনে জেতার পর নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে মনোনীত করে বিজেপি৷ অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, দলের নেতৃত্বের দায়ভার বর্ষীয়ান নেতা এল কে আডবানির ওপর বর্তানোর কথা উঠলেও, বাস্তবে তা হয়নি৷
ছবি: AP
মোদীর উত্থান
বিজেপির ইতিহাসে ব্যক্তিকেন্দ্রীক নির্বাচনী প্রচার মোদীর ক্ষেত্রেই প্রথম৷ পূর্ববর্তী সরকারের দুর্নীতির সুযোগ নিয়ে মোদীর ‘গুজরাট মডেল’-কে আদর্শ হিসেবে তুলে ধরা হয় প্রচারে৷ সুবক্তা মোদী শীঘ্রই হয়ে ওঠেন তরুণ প্রজন্ম থেকে সংবাদমাধ্যম, সকলের প্রিয়পাত্র৷ নির্বাচনের আগে বিজেপি হিন্দু জাতীয়তাবাদকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে গেলেও, মোদীর প্রাক-নির্বাচন বক্তব্যের বড় অংশ জুড়েই ছিল ‘হিন্দুত্ব’৷
ছবি: picture alliance/AA/M. Aktas
মোদী থেকে ‘মোদীজি’
২০১৪ সালে বিজেপি ২৮২টি আসন জিতে ক্ষমতায় আসে৷ ভোটারদের কংগ্রেসের প্রতি অনাস্থার পাশাপাশি বিজেপির সাফল্যের আরেকটি কারণ ছিল আরএসএসের নিঃশর্ত সমর্থন৷ নরেন্দ্র মোদীই হন প্রধানমন্ত্রী৷ পিউ গবেষণা কেন্দ্রের একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে, প্রথম বছরের তুলনায় বর্তমানে মোদীর জনপ্রিয়তা আরো বেড়েছে, যা ২০১৯-র নির্বাচনে কংগ্রেস-সহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলির জন্যও নিঃসন্দেহে ভাবনার বিষয়৷