মাস দেড়েক আগে বিহার ও উত্তর প্রদেশের কিছু আসনের উপনির্বাচনে বিজেপি ধাক্কা খাবার পর, অনেকেই মনে করেছিল মোদী সুনামি বুঝি থিতিয়ে এলো৷ কিন্তু হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্র বিধানসভা ভোট প্রমাণ করে দিল ‘মোদী ম্যাজিক’ এখনো অটুট৷
বিজ্ঞাপন
দিল্লি লাগোয়া হরিয়ানা এবং পশ্চিম ভারতের মহারাষ্ট্র – এই দুই রাজ্যে ভোটের লড়াইটা হয় একদিকে মোদী-কেন্দ্রিক বিজেপি আর অন্যদিকে যুযুধান অন্যসব রাজনৈতিক দল৷ বিনা গাঁটছড়ায় ‘একলা চলো' নীতিকে ভর করে বিজেপি যে সাফল্য পেয়েছে, তা আশাতীত৷ হরিয়ানায় একার জোরে সরকার গড়তে চলেছে বিজেপি৷ মোট ৯০টি আসনের মধ্যে বিজেপির ঝুলিতে ৪৭টি আসন৷
মহারাষ্ট্রে ২৮৮টি আসনের মধ্যে বিজেপি ১২২টি আসন নিয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ট দল হলেও, একা সরকার গড়ার মতো অবস্থায় নেই৷ কোনো না কোনো দলের হাত ধরতে হবে৷ স্বাভাবিকভাবে আদর্শগত দিক থেকে সেটা হতে পারে হিন্দুত্ববাদী আঞ্চলিক দল শিবসেনা, কারণ বিজেপির সঙ্গে শিবসেনার গাঁটছড়া ২৫ বছরের৷ তবে মহারাষ্ট্র বিধানসভা ভোটের আগে আসন বণ্টন নিয়ে মতভেদের কারণে সেই গাঁটছড়া ছিঁড়ে যায়৷ এরপরেও অবশ্য কেন্দ্রে মোদী সরকারের শরিক সম্পর্ক অটুট আছে৷ কিন্তু বিজেপিকে সরকার গড়ার জন্য বাইরে থেকে সমর্থন দেবার কথা আগেভাগেই ঘোষণা করে দিয়েছে শরদ পওয়ারের এনসিপি দল৷ এতে শিবসেনার সঙ্গে দরকষাকষিতে বিজেপির হাত যে শক্ত হবে, সন্দেহ নেই৷
একজন নরেন্দ্র মোদী
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd
চা ওয়ালা
১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI
গুজরাটের গদিধারী
১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reuters
দাঙ্গার কালিমা
মোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: AP
রূপান্তর
দাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNI
ভারতের পথে পথে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: AP
নতুন ইতিহাস
ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেষ হাসি
নির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd
7 ছবি1 | 7
‘মোদী ম্যাজিক'-এর আসল মন্ত্রটা কী? আমার মতে, পরিবার-কেন্দ্রীক গণতন্ত্রের বদলে দুর্নীতিমুক্ত প্রকৃত আর্থিক উন্নয়ন ও পরিবর্তন৷ গৈরিক রঙের ধ্বজা উড়তে দেননি মোদী৷ হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির অভিযোগ জমে আছে বহুদিন ধরে৷ সব অভিযোগ ধামা চাপা পড়ে আছে৷ আমজনতা এর একটা বিহিত চান৷ এটা জানা কথা, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে একটা কায়েমী স্বার্থ ডাল-পালা মেলে৷ অন্যদিকে, সাধারণ নির্বাচনের প্রায় মাস চারেকের মধ্যে মোদী সরকার নীতি পঙ্গুত্ব মুছে ফেলে সরকারের কাজকর্মে এনেছেন গতি৷
অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এবার মোদী বড়সড় আর্থিক সংস্কারে হাত দেবেন৷ ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে৷ মোদী সরকার ইতিমধ্যেই খাদ্য সুরক্ষা, জমি অধিগ্রহণ, শ্রম আইন সংশোধন, কর্মসংস্থান, শিক্ষার অধিকার ইত্যাদি প্রকল্প দ্রুত রূপায়ণে উদ্যোগী হয়েছে৷ সরকার এবং দলে মোদীর একমোদ্বিতীয়ম ছবি সরকারের ভেতরে ও বাইরে একটা শৃঙ্খলা আনার দিকে এগিয়ে চলেছে বলেই মনে হয় আমার৷ আমি দিল্লিবাসী হয়ে দিল্লিতেই তার একটা নমুনা দেখতে পাচ্ছি৷ মোদীর স্বচ্ছ-ভারত অভিযানে মহানগরীর রাস্তা ঘাট, পার্ক, পাবলিক টয়লেট আগের তুলনায় অনেক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়েছে৷ পরিতাপের বিষয়, ভারতের জাতীয় চরিত্রে রয়ে গেছে অনেক গলদ৷ সেটা দূর করতে বলা বাহুল্য সময় লাগবে৷ ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই৷ কাগজের ঠোঙা, যত্রতত্র পানের পিক ফেলা, ছেঁড়া কাগজ তিন ফুট দূরের ডাস্টবিনে না ফেলে ফেলবে পায়ের কাছেই৷ অবাক লাগে এ সব লোকেরাই যখন উন্নত দেশে যান, তখন কিন্তু সেটা করেন না, যে কারণেই হোক৷ আমার মতো অনেকেরই চোখে পড়ছে সরকারি কর্মচারিদের মধ্যে আগের সেই চিরাচরিত ঢিলেঢালা ভাবটা তুলনামূলকভাবে কম৷
মোদীর স্পষ্টবাদিতা, স্বচ্ছ ভাবমূর্তি এবং দৃঢ়সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা সুবিদিত৷ গুজরাট দাঙ্গা ছাড়া দুর্নীতি নিয়ে মোদীর গায়ে কালি ছেটাবার সাহস এ পর্যন্ত কেউ করেনি৷ তাই মোদীর চিত্রনাট্যের ওপর ভর করে এবার বিজেপির পরবর্তী চ্যালেঞ্জ হবে ঝাড়খন্ড ও জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভার আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন৷ কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন, গণতন্ত্রে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়া নতুন নয়৷ তবে কংগ্রেস যেভাবে মুখ থুবড়ে পড়ছে, তাতে অদুর ভবিষ্যতে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াবার আশা কম৷ বিশেষ করে, রাহুল গান্ধীর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে কংগ্রেসের অন্দরমহলেই৷