২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল জনাদেশ নিয়ে নরেন্দ্র দামোদরভাই মোদী মঙ্গলবার ২০শে মে সংসদের সেন্ট্রাল হলে বিজেপি সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হন সর্বসম্মতিক্রমে যা সমর্থন করে বিজেপি শরিক দলগুলি৷ মোদীর নাম প্রস্তাব করেন দলের বর্ষীয়ান নেতা লালকৃষ্ণ আডবানি৷ তারপর বিজেপি এবং শরিক দলগুলির প্রতিনিধিসহ মোদী যান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যয়ের সঙ্গে দেখা করতে সরকার গঠনের প্রস্তাব নিয়ে৷ রাষ্ট্রপতির সম্মতির পর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান কবে হবে তার দিনক্ষণ এখনো চূড়ান্ত হয়নি৷ তবে খুব সম্ভবত হবে ২৪ অথবা ২৬শে মে৷ চূড়ান্ত হয়নি শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান কোথায় হবে৷ রাষ্ট্রপতি ভবনের দরবার হলে নাকি রাষ্ট্রপতি ভবনের সন্মুখ প্রাঙ্গণে?
এর আগে সকালের দিকে সংসদের কেন্দ্রীয় হলে ভাবি প্রধানমন্ত্রী মোদীর বক্তব্যে বার বার উঠে আসে আশার কথা৷ বলেন, ‘‘আমি চির জীবন আশাবাদী৷ তাই আমার কাজে থাকে ইতিবাচক দিশা৷ দেশের ১২৫ কোটি মানুষকে আশার আলো দেখাবে বিজেপি সরকার৷'' আবেগ মথিত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘‘সরকার কাজ করবে দেশের হয়ে, গরিবদের হয়ে, নবীন প্রজন্মের হয়ে, মা বোনেদের হয়ে৷ তাদের আশা আকাঙ্ক্ষা এবং প্রত্যাশা পূরণে চেষ্টার ত্রুটি থাকবে না৷'' ভাষণের মাঝে আবেগে কণ্ঠরুদ্ধ মোদীর চোখে জল ভরে আসে৷ কেন? মোদী যেন আমাদের প্রতি কৃপা করেন আডবানির এই কথায়৷ অভিমান ভেজা গলায় মোদীর উত্তর, ‘‘কৃপা? কৃপা কেন? বিজেপি আমার মা৷ মায়ের কাজ করলে সেটা কৃপা নয়, সেটা সন্তানের কর্তব্য৷ দল আমার কাঁধে ১২৫ কোটি দেশবাসীর যে দায়িত্ব দিয়েছে তাতেই আমি ধন্য,'' বলেন মোদী৷ সেটা কতটা করতে পেরেছি তার রিপোর্ট কার্ড নিয়ে আবার জনাদেশ নিতে যাব ২০১৯ সালে৷ ঘন ঘন টেবিল চাপড়ে উপস্থিত সাংসদরা অভিনন্দন জানান মোদীকে৷ বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিং বলেন, ‘‘আজকের দিনটি ভারতীয় রাজনীতির এক ঐতিহাসিক ক্ষণ৷''
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reutersমোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: APদাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNIভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: APভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpaনির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd
বুদ্ধিজীবী সমাজ অবশ্য মনে করেন, বলা আর করার মধ্যে পার্থক্য আছে৷ তবে মোদী যে তুলনামূলকভাবে দক্ষ প্রশাসক সে বিষয়ে সন্দেহ নেই৷ তাই শপথ নেবার আগে থেকেই তিনি প্রশাসনিক মহলের শীর্ষ আমলাদের ডেকে একপ্রস্থ কথা বলে নিয়েছেন অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, আর্থিক প্রবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি এবং প্রশাসনিক ঘাটতি ইত্যাদি নিয়ে৷ প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসার পর প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ের সচিবদের তাঁদের বিভাগীয় কাজকর্মের কতটা অগ্রগতি হয়েছে, কোথায় কোথায় কাজ আটকে আছে, কেন আটকে আছে, তার সম্ভাব্য সমাধান কী, সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সামনে প্রেজেন্টেশন দেবার নির্দেশ জারি করা হয়েছে৷ তবে সবকিছু সুফল রাতারাতি হবার নয়৷ অনেক ইস্যু আছে যা রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত৷ কোনো কোনো বিষয় আছে যার জন্য আইন সংশোধনের প্রশ্ন আছে৷ কিন্তু সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই৷
দেশের অর্থনীতিবিদদের মতে, উন্নয়নের স্লোগানকে বাস্তব করতে হলে মোদী সরকারকে প্রথমেই জোর দিতে হবে অবকাঠামো ক্ষেত্রে ব্যাপক বিনিয়োগ, ব্যবসা বাণিজ্য চালানো সহজ করতে লাল ফিতার ফাঁস আলগা করা, কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা গড়ে তোলা, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে বছরে ১ কোটি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো, বেসরকারি ব্যয় যেখানে সম্ভব নয়, সেখানে সরকারি ব্যয় বাড়ানো ইত্যাদি৷