বিজেপি নেতার কুকথা সোফিয়া কুরেশির বিরুদ্ধে
১৫ মে ২০২৫
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন সিঁদুর' অভিযানে ভারতের মুখ হয়ে উঠেছেন সোফিয়া। সাংবাদিক বৈঠকে বিদেশ সচিবের সঙ্গে তাকে নিয়মিত দেখা গিয়েছে। ভারতীয় সেনার এই সংখ্যালঘু নারী আধিকারিকের বিরুদ্ধে মন্তব্য করেছেন বিজেপি নেতা ও মন্ত্রী বিজয় শাহ।
কী বলেছেন মন্ত্রী
সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে রামকুণ্ড গ্রামে আয়োজিত একটি সভায় কর্নেল কুরেশিকে নিয়ে বিজয় কদর্য মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ওরা (সন্ত্রাসবাদী) আমাদের বোনেদের সিঁদুর মুছেছিল। আমরা ওদেরই বোনকে পাঠিয়ে বদলা নিয়েছি। ওদের অবস্থা খারাপ করেছি। ওদের বোনকে পাঠিয়েই ওদের ধ্বংস করে দিয়েছি।'
গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পহেলগামে জঙ্গিরা খুন করে পর্যটকদের। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী, ধর্ম পরিচয় জানতে চেয়ে জঙ্গিরা গুলি চালায়। এ কারণে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের নাম রাখা হয় ‘অপারেশন সিঁদুর'। এর সঙ্গে যুক্ত দক্ষ সেনা আধিকারিক কুরেশিকে সন্ত্রাসবাদীদের বোন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিজয়। এই আধিকারিকের ধর্ম পরিচয়ের সূত্রেই তিনি এই কদর্য ভাষা ব্যবহার করেন।
ক্ষমা চাইলেও এফআইআর
বিজয়ের মন্তব্য প্রকাশ্যে আসতে কড়া সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। বিরোধী রাজনৈতিক দল তো বটেই, বিজেপি নেতা সমালোচিত হন দলের অন্দরেও। সমাজের সব স্তরের মানুষ কুরেশি সম্পর্কে মন্তব্যের জন্য বিজয়ের সমালোচনা করেছেন।
প্রবল চাপের মুখে পড়ে তড়িঘড়ি পিছু হটেন মন্ত্রী। নিজের মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চেয়ে নেন। সুর বদলে বলেন, "আমাদের বোন সোফিয়া জাতি ও ধর্মের উপরে উঠে ভারতের গৌরব বাড়িয়েছেন। তিনি আমাদের নিজের বোনের চেয়েও বেশি সম্মানিত। জাতির প্রতি তার সেবার জন্য আমি তাকে স্যালুট জানাই।" শাহের মন্তব্য সমাজ ও ধর্ম বিশ্বাসকে আঘাত করলে তিনি দশবার ক্ষমা চাইতে প্রস্তুত বলেও ঘোষণা করেন।
কিন্তু এই ক্ষমাপ্রার্থনায় চিঁড়ে ভেজেনি। মন্ত্রীর বিরুদ্ধে এফআইআর-এর নির্দেশ দিয়েছে মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্ট। বিজয়ের এই মন্তব্য ভয়ানক এবং ক্যানসারের মতো, এমনই পর্যবেক্ষণ ছিল হাইকোর্টের। তার কুকথাকে নর্দমার ভাষার তকমা দিয়েছে আদালত। অবিলম্বে তার বিরুদ্ধে এফআইআর-এর নির্দেশ দেওয়া হয়।
এর পরেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মোহন যাদব জানান, হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বুধবার রাতে এই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয় মানপুর থানায়।
গ্রেপ্তারি এড়াতে সুপ্রিম কোর্টে দরবার করেন বিজয়। কিন্তু সেখানেও স্বস্তি মেলেনি। বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি বিআর গাভাই কঠোর ভাষায় মন্ত্রীর সমালোচনা করেছেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, "আপনি কী ধরনের মন্তব্য করেছেন? ন্যূনতম দায়িত্বজ্ঞানের পরিচয় দিতে পারেননি। হাইকোর্টে গিয়ে ক্ষমা চান।"
শীর্ষ আদালতের মতে, বিজয়ের মন্তব্য একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রধান বিচারপতি মধ্যপ্রদেশের মন্ত্রীকে কোনো স্বস্তি না দিয়ে গ্রেপ্তারি থেকে বাঁচার রক্ষাকবচ দেননি। শুক্রবার মামলার শুনানি হবে সুপ্রিম কোর্টে।
কড়া সমালোচনার মুখে
বেফাঁস কথা বলে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছেন বিজয়। জাতীয় নারী কমিশনের চেয়ারপার্সন বিজয়া রাহাতকর পোস্ট করেন, "একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির তরফে নারীদের প্রতি এমন অবমাননাকর মন্তব্য মেনে নেওয়া যায় না। এটি নারীদের মর্যাদাকে আঘাত করার পাশাপাশি দেশের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বীরাঙ্গনাদের কাছেও অত্যন্ত অপমানজনক। কর্নেল সোফিয়া কুরেশিকে নিয়ে গোটা দেশ গর্বিত। তিনি সাহস ও নিষ্ঠার সঙ্গে দেশের সেবা করেছেন।"
মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপি নেত্রী উমা ভারতী সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখেন, "বিজয় শাহকে মন্ত্রিপদ থেকে বরখাস্ত এবং তার বিরুদ্ধে এফআইআর- দুটোই দ্রুত হওয়া দরকার। কারণ তিনি দেশবাসীকে লজ্জিত করেছেন।"
কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী বলেন, "পহেলগামের ঘটনার পর প্রথম শহিদ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ঝন্টু আলী শেখ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, ভারতের সকলের সহযোগিতায় আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এত বড় অভিযান করতে পেরেছি। তা যদি সত্যি হয়, তাহলে মধ্যপ্রদেশের বিজেপির একজন মন্ত্রী বিজয় শাহ কী করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পদস্থ অফিসার সোফিয়া কুরেশির বিরুদ্ধে অপমানজনক কথা বলতে পারেন। তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না কেন, এটা আমাদের প্রশ্ন।"
ভারতীয় সেনার সাবেক কর্নেল পৃথ্বীরঞ্জন দাস বলেন, "এইভাবে একটা কুৎসিত মন্তব্য, যেটা উনি চালাকি করে করতে গিয়েছিলেন, তাতে ওর ব্যক্তিগত রুচি প্রকাশিত হয়েছে। সেটা যারা সমর্থন করছে তাদেরও রুচি প্রকাশিত হয়েছে। এতে একজন নাগরিক হিসেবে শুধু নয়, ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন সাবেক সদস্য হিসেবে আমি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ। আমি খুশি যে হাইকোর্ট তৎপর হয়ে অ্যাকশন নিয়েছে।"
নারী আন্দোলনের কর্মী অধ্যাপক শাশ্বতী ঘোষ ডিডাব্লিউকে বলেন, "কোনো একজন মেয়ে মুখপাত্র হয়েছেন, এটাই বহু মানুষের গাত্রদাহের কারণ। যুদ্ধের মতো একটা তথাকথিত পৌরুষের লড়াই বা পুরুষালি ব্যাপারে একটি মেয়েকে দিয়ে বলানো হচ্ছে, এটা অনেকে মেনে নিতে পারছেন না। পাশাপাশি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা পুরোটাই একটা ইসলামি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে, সেখানে একজন সংখ্যালঘু বা মুসলিম মেয়েকে কেন বেছে নেওয়া হল এজন্য, অনেকেরই প্রশ্নের বড় উৎস। বিজেপি বিধায়ক হয়তো সরাসরি বলে ফেলেছেন, কিন্তু এই ভাবনাটা অনেকের মধ্যেই আছে বলে আমার বিশ্বাস।"
মন্তব্যের নেপথ্যে
কাশ্মীরে ধর্মীয় পরিচয় দেখে পর্যটকের হত্যার ফলে বিদ্বেষের বাতাবরণ তৈরি করেছে এক শ্রেণির মানুষ। তারই একটা প্রতিফলন দেখা গিয়েছে মন্ত্রীর বক্তব্যে। বিদ্বেষ এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে যে জঙ্গি হামলায় নিহতের স্ত্রী শান্তির বার্তা দিলে তিনিও আক্রমণের মুখে পড়েছেন।
নৌসেনা আধিকারিক লেফটেন্যান্ট বিনয় নারওয়াল পহেলগাঁওতে জঙ্গি হামলায় মারা যান। বিনয়ের স্ত্রী হিমাংশী নারওয়াল দিনকয়েক আগে শান্তি বজায় রাখার আবেদন জানিয়েছিলেন। মুসলিম বা কাশ্মীরিদের প্রতি কেউ যাতে ঘৃণা না ছড়ায়, সেই আহ্বানও জানান। এ কারণে তাকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। যুদ্ধবিরতি চুক্তি ঘোষণা হওয়ার পরে বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রিকেও কটাক্ষের শিকার হতে হয়। একই অভিজ্ঞতা হয় তার মেয়েরও।
এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে পহেলগাম ও তার পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে মন্তব্য করে রোষের মুখে পড়েছেন এক সংখ্যালঘু অধ্যাপক আলি খান মাহমুদাবাদ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ফেসবুকে মুসলমান সেনা আধিকারিকের সাংবাদিক সম্মেলন নিয়ে আপত্তিকর পোস্ট করেছেন তিনি।
অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান মাহমুদাবাদ লিখেছিলেন, "আমি খুব খুশি যে এত ডানপন্থি কর্নেল সোফিয়া কুরেশির প্রশংসা করছেন। তবে তারা দাবি করতে পারেন যে, গণপিটুনি, নির্বিচারে বুলডোজার চালানো এবং বিজেপির ঘৃণা ছড়ানোর শিকার অন্যান্যদের ভারতীয় নাগরিকদেরও সুরক্ষা দেওয়া হোক।" এরপরেই হরিয়ানার মহিলা কমিশন ওই অধ্যাপককে সমন পাঠিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, "এটা বিজেপির ইসলাম বিরোধিতা শুধু নয়, মনুবাদী যে সংস্কৃতি, যার উপর হিন্দুত্ববাদ দাঁড়িয়ে আছে, তার সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে যুক্ত। সোফিয়া কুরেশি আমাদের দেশের মেয়ে, যিনি নিজের যোগ্যতায় এতদূর উপরে উঠেছেন। যে যোগ্যতায় ওঠার ক্ষমতা বিজেপির ওই নেতা বা মন্ত্রীর নেই। তা সত্ত্বেও তিনি এ রকম কদর্য মন্তব্য করলেন, যা থেকে বোঝা যায় যে এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা সামগ্রিকভাবে বিজেপির সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত ইসলামের প্রতি ঘৃণা।"
তার বক্তব্য, "এটা মনে রাখতে হবে যে বিজেপি সেনাবাহিনীতে মহিলাদের পার্মানেন্ট কমিশনের অন্তর্ভুক্ত করেনি। সুপ্রিম কোর্ট যে সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেছিল।"