বাংলাদেশে বিজ্ঞানচর্চা কমে যাচ্ছে, শিক্ষার্থীরাও আর বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে না৷ ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে এ কথাগুলো বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইব্রাহিম৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশে বিজ্ঞান আন্দোলনের পথিকৃত প্রবীণ এই অধ্যাপকের মতে, বিজ্ঞান শিক্ষায় এখন আর আনন্দ নেই, এটা হয়েছে যন্ত্রণাদায়ক৷ পাশাপাশি অভিভাবকরাই ঠিক করে দিচ্ছেন কে বিজ্ঞান পড়বে, আর কে পড়বে না৷ শিক্ষার্থীদের পছন্দ করে বিজ্ঞানে যাওয়ার সুযোগ কমে যাচ্ছে৷
ডয়চে ভেলে:বাংলাদেশে বিজ্ঞান শিক্ষাকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়?
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইব্রাহিম: গুরুত্ব তো দেয়া৷ আগে-পরে সবসময় বাংলাদেশে বিজ্ঞান শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়া হয়৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সঠিকভাবে দেয়া হয় কিনা? বা যারা শিক্ষার্থী তাদের মনে রেখাপাত করে কিনা? বা সঠিকভাবে তাদের মধ্যে উৎসাহটা সৃষ্টি করতে পারে কিনা?
নবম শ্রেণি থেকে শিক্ষার্থীরা বিভাগ পছন্দ করতে পারে৷ সেক্ষেত্রে বিজ্ঞানের প্রতি শিক্ষার্থীদের আকষর্ণ কতটা?
এটা একটা মারাত্মক ভুল কাজ৷ খুব তাড়াতাড়ি বিজ্ঞান থেকে চলে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে৷ অষ্টম শ্রেণির পর অনেককে আর বিজ্ঞানের মুখ দেখতেই হয় না৷ এটা ঠিক না, অতীতে এটা ছিল না, পরে এটা করা হয়েছে৷
‘ছাত্ররা বিজ্ঞান শিখছে ব্যথার মতো, আনন্দের মতো করে তাদের এটা শেখানো হচ্ছে না’
বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে, না কমছে?
এটা কমছে৷ প্রথমত বিজ্ঞানকে সবার থেকে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে৷ বলা হয়, যাদের এটার প্রতি ঝোঁক বা প্রস্তুতি আছে, তারাই শুধু পড়বে৷ এটা একটা ভুল কাজ৷ বিজ্ঞান সবার জন্য পড়ার জিনিস৷ মুষ্টিমেয় এটা পড়াতে বাকিরা বলছে, আমরা ওখানকার নই৷ কারণ এদের মধ্যে এক ধরনের ভয় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে৷ আর যাদের বিজ্ঞানে আনা হয়েছে তাদের জন্য ক্রমাগত চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করা হয়েছে, তাদের সিলেবাস কঠিন করা হয়েছে৷ আগে যেটা কলেজে পড়ানো হতো এখন সেটা স্কুলে পড়ানো হয়৷ এটা একটা যন্ত্রণার কাজে পরিণত হয়েছে৷ ছাত্ররা বিজ্ঞান শিখছে ব্যথার মতো, আনন্দের মতো করে তাদের এটা শেখানো হচ্ছে না৷ আনন্দের মধ্যে যদি আমরা বিজ্ঞানের বই পড়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারতাম তাহলে উপন্যাসের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে তারা বিজ্ঞানের বইও পড়ত৷
শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানচর্চা করে, নাকি চাকরির দিকে বেশি ঝোঁকে?
শুধু শিক্ষার্থীরা নয়, আমরা অভিভাবকরা, সমাজ সবকিছু মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ দিচ্ছি৷ ওরা চাকরির পেছনে দৌঁড়াচ্ছে না, অভিভাবকরা দৌঁড়াচ্ছে৷ শিক্ষার্থীরা আনন্দ চায়৷ এ কারণে অনেক শিক্ষার্থী সব অগ্রাহ্য করে চিত্রকলা পড়তে যায়৷ এটা কিন্তু অনেকেই পছন্দ করে না৷ সুযোগ দিলে সবাই নিজের আনন্দের পথেই চলত৷ সমাজ তাকে বাধ্য করছে তোমাকে চাকরির পথে হাঁটতে হবে৷ চাকরির বাজার যেখানে উঁচু, সেখানেই তোমাকে যেতে হবে৷ এ কারণে নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব বিভাগ বিজ্ঞানে অনেক অবদান রেখেছিল এখন সেখানে ছাত্র পাওয়া যায় না৷ পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞানের মতো জায়গায় ছাত্ররা আসে না৷
বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা
বিজ্ঞানে বাংলাদেশিদের অবদান কখনোই কম ছিল না৷ ঐতিহ্যগতভাবেই বাঙালি বিজ্ঞানীরা অসামান্য অবদান রেখে গেছেন৷ সেখান থেকে কয়েকজনের আবিষ্কার তুলে ধরা হলো৷ এর বাইরেও আরো অনেকেই অসাধারণ সব কাজ করে সমৃদ্ধ করেছেন বিজ্ঞানকে৷
ছবি: Bibliothèque nationale de France
আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু
সবর্প্রথম উদ্ভিদে প্রাণের অস্তিত্ব অনুভব করেছিলেন বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু৷ বিভিন্ন উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণার এক পর্যায়ে তার মনে হলো, বিদ্যুৎ প্রবাহে উদ্ভিদও উত্তেজনা অনুভব করে এবং সাড়া দিতে পারে৷ এর অর্থ, উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে৷ ১৯১০ সালের দিকে বিজ্ঞানী বসু তাঁর গবেষণার পূর্ণাঙ্গ ফলাফল বই আকারে প্রকাশ করেন৷
ছবি: Bibliothèque nationale de France
ড.কুদরাত-এ-খুদা
গবেষণা জীবনের এক পর্যায়ে, তিনি বনৌষধি, গাছগাছড়ার গুণাগুণ, পাট, লবণ, কাঠকয়লা, মৃত্তিকা ও অনান্য খনিজ পদার্থ নিয়ে কাজ করেন৷ বিজ্ঞানী হিসাবে তিনি ও তাঁর সহকর্মীদের ১৮টি আবিষ্কারের পেটেন্ট রয়েছে, যার মধ্যে ন’টি পাটসংক্রান্ত৷ এর মধ্যে পাট ও পাটকাঠি থেকে রেয়ন, পাটকাঠি থেকে কাগজ এবং রস ও গুড় থেকে মল্ট ভিনেগার আবিষ্কার উল্লেখযোগ্য৷ দেশে বিদেশে তাঁর ১০২টি গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে৷
ছবি: hybridknowledge.info
সত্যেন্দ্রনাথ বসু
১৯২২ সালে পার্টিকেল স্ট্যাটিস্টিক্স নিয়ে সত্যেন বোসের গবেষণাটি, যেটি আইনস্টাইন নিজে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন, অনেকের ভাষায় ২০ শতকের সেরা দশ কাজের একটি৷ যদিও তিনি নোবেল পুরস্কার পাননি, কোয়ান্টাম থিওরির অনেক গবেষণার পথ খুলে দেয় তাঁর গবেষণা৷ কোয়ান্টাম ফিজিক্সের অনন্য আবিষ্কার ‘গডস পার্টিকেলস’ বা ‘ঈশ্বর কণা’-র নামকরণ করা হয়েছে, তাঁর ও আরেক পদার্থবিজ্ঞানী পিটার হিগসের নামে – হিগস-বোসন পার্টিকেল৷
ছবি: public domain
পি সি রায়
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ভারতীয় উপমহাদেশের শিল্পায়নে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য৷ ১৮৯৫ সালে তিনি মারকিউরাস নাইট্রাইট আবিষ্কার করেন যা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে৷ এটি তার অন্যতম প্রধান আবিষ্কার৷ তিনি তার সমগ্র জীবনে মোট ১২ টি যৌগিক লবণ এবং পাঁচটি থায়োএস্টার আবিষ্কার করেন৷
মেঘনাদ সাহা
মেঘনাদ সাহা পরমাণু বিজ্ঞান, আয়ন মণ্ডল, পঞ্জিকা সংস্কার, বন্যা প্রতিরোধ ও নদী পরিকল্পনা নিয়ে গবেষণা করেন৷ তাপীয় আয়নবাদ সংক্রান্ত তত্ত্ব উদ্ভাবন করে জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন৷
আব্দুস সাত্তার খান
নাসা ইউনাইটেড টেকনোলজিস এবং অ্যালস্টমে কাজ করার সময়ে ৪০টিরও বেশি সংকর ধাতু উদ্ভাবন করেছেন বিজ্ঞানী খান৷ এই সংকর ধাতুগুলো ইঞ্জিনকে আরো হালকা করেছে, যার ফলে উড়োজাহাজের পক্ষে আরো দ্রুত উড্ডয়ন সম্ভব হয়েছে এবং ট্রেনকে আরো গতিশীল করেছে৷ তার উদ্ভাবিত সংকর ধাতুগুলো এফ-১৬ ও এফ-১৭ যুদ্ধবিমানের জ্বালানি সাশ্রয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে৷
ছবি: AP/NASA
ডাক্তার শাহ এম ফারুক
কলেরা রোগের কারণ আবিষ্কার করেছেন ডা. ফারুক৷ কলেরার ঘটক ‘ভিবরিও’ নামে এক ধরনের শক্তিশালী ব্যাক্টেরিয়ার সংস্পর্শে অন্যান্য ব্যাক্টেরিয়া এসে কীভাবে একে আরো কার্যকরী বা শক্তিশালী করে তোলে সেটিই ছিল তাঁর গবেষণা৷ আন্তর্জাতিক কলেরা রোগ গবেষণা কেন্দ্র বা আইসিডিডিআরবি-তে তিনি ও তাঁর গবেষণা দল এ আবিষ্কার করেন৷
ছবি: picture-alliance/Dr.Gary Gaugler/OKAPIA
ড. মাকসুদুল আলম
পাটের জিনের আবিষ্কারক ড. মাকসুদুল আলম৷ এই বাংলাদেশি জিনতত্ত্ববিদের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ডাটাসফটের একদল উদ্যমী গবেষকের যৌথ প্রচেষ্টায় ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময়ে সফলভাবে উন্মোচিত হয় পাটের জিন নকশা৷
ছবি: Bdnews24.com
ড. জামালউদ্দিন
বিশ্বের সবচেয়ে কার্যকর সৌর বিদ্যুৎ কোষ উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে ম্যারিল্যান্ডের কপিন স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং গবেষক বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. জামালউদ্দিন ইতিহাস গড়েছেন৷ ড. জামাল উদ্দিন এবং তার গ্রুপ সোলার সেল থেকে শতকরা ৪৩.৪ পুনঃব্যবহারযোগ্য শক্তি উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জন করেছে যা বিশ্বে এই উৎপাদনের সর্বোচ্চ মাত্রা৷
শুভ রায়
বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম কিডনি তৈরি করেছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানী শুভ রায়৷ এটি চিকিৎসাবিজ্ঞানে অসামান্য কীর্তি৷ ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার সহযোগী অধ্যাপক শুভ রায় তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে কৃত্রিম কিডনি তৈরির কাজ শুরু করেন৷ চলতি দশকের গোড়ার দিকে দলটি ঘোষণা দেয় যে, তাঁরা কৃত্রিম কিডনি তৈরি করে তা অন্য প্রাণীর দেহে প্রতিস্থাপন করে সফল হয়েছে৷
ছবি: hybridknowledge.info
হরিপদ কাপালী
হরিপদ কাপালী ছিলেন এক প্রান্তিক কৃষক৷ কিন্তু তাঁর আবিষ্কার হরিধান কৃষিবিজ্ঞানের এক অনন্য সাফল্য৷ প্রকৃতির কাছ থেকেই শিক্ষা৷ প্রকৃতিতেই তাঁর গবেষণা৷ তাঁর নামে নামকরণ করা এই ধানটি অন্য যে কোনো ধানের চেয়ে উচ্চ ফলনশীল৷ এতে সার ও ওষুধও লাগে অনেক কম৷ সব মিলিয়ে সোনার বাংলার সোনালি আবিষ্কার হরিপদ কাপালীর হরিধান৷
ছবি: Bdnews24.com
11 ছবি1 | 11
দেশে কি বিজ্ঞানের চর্চা কমে যাচ্ছে?
এতক্ষণ যা বললাম তার ফলশ্রুতিতে কী আশা করা যায়? যদি আনন্দ চলে যায়, আকাঙ্খা চলে যায়, নেশা চলে যায় তাহলে কি হবে? চর্চা জিনিসটা তো নেশা বা আকাঙ্খার ব্যাপার৷ আমরা ছোটবেলা থেকে যদি তাদের মধ্যে এটা ঢোকাতে পারতাম তাহলে দেখা যেত অনেক ছাত্র চর্চায় লেগে যেত৷ চর্চা তো এক ধরনের ত্যাগ স্বীকার করা, এটা এক ধরনের গবেষণা৷ এটা কর্পোরেট কাজ না৷ আমাদের দেশে কর্পোরেট গবেষণা নেই৷ বিশ্বের অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা গবেষণার জন্য কোটি কোটি ইউরো খরচ করছে, আমাদের দেশে এই ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই৷
বিজ্ঞানের প্রতি শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ বাড়ানোর কোনো পদক্ষেপ কি দেশে আছে?
অবশ্যই আছে৷ তবে সিস্টেম বদলাতে হবে৷ বিভাজনটা তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করতে হবে৷ অন্তত স্কুলে যতদিন আছি, বিজ্ঞানটা সবাইকে পড়তে হবে৷ এমনকি কলেজে গেলেও অন্য ছাত্রদেরও সাধারণ বিজ্ঞান পড়তে হবে৷ আর বিজ্ঞানের ছাত্রদের সাধারণ সমাজবিজ্ঞান থাকবে, যেটা আগে ছিল৷ অথচ ক্লাস এইটের একজন ছাত্রকে বলে দেয়া হচ্ছে এটা তোমার লাইন না, তোমার বিজ্ঞান পড়ার দরকার নেই৷ এরপর সে বিজ্ঞানে কি হচ্ছে বা না হচ্ছে সে তার কিছুই জানে না৷
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কি বিজ্ঞান পড়ানোর জন্য দক্ষ শিক্ষক আছেন? শিক্ষকের সংখ্যা কি পর্যাপ্ত?
শিক্ষক কে হবে? আমি যাদের কথা বলছি, এরাই তো শিক্ষক হবে৷ শিক্ষক তো আমি জার্মানি থেকে আনব না৷
বিজ্ঞান পড়লে খরচটা বেড়ে যায়, এমন একটি ধারণা কাজ করে আমাদের সমাজে৷ সেটা কি কমানো সম্ভব?
এটা আমার মনে হয় সত্য নয়৷ প্রথম কথা হল- আমাদের যে পাবলিক সিস্টেম সেখানে কোনটাতেই কোনো খরচ নেই৷ আর যেটা আছে, সেটা সমানভাবেই আছে৷ প্রাইভেট সিস্টেমে সবকিছুতেই খরচ৷ সেটা যদি আপনি ইংরেজি সাহিত্য পড়তে যান সেখানেও লাখ লাখ টাকা নেবে আপনার কাছ থেকে৷ আমাদের দেশে যে কোনো দেশের চেয়ে খরচ কম৷
বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে মূল সমস্যাগুলো কী?
সিস্টেমটাকে অন্য চোখে দেখতে হবে, সার্বজনীন করতে হবে৷ সবার কাছে বিজ্ঞান নিয়ে যেতে হবে, আনন্দদায়ক করতে হবে৷ বেশি উচ্চাকাঙ্খী হলে হবে না৷ তুমি বিজ্ঞানে এসেছ তোমাকে সব অংক করতে হবে, সবকিছু করতে হবে এমন করলে হবে না৷ এটা কোনো দেশেই নেই৷ বরং ভিত্তিটা ভালো করতে হবে৷ আমরা কিন্তু সেটাতে বিশ্বাস করি না৷ এ বছর যদি বই ৩০ পৃষ্ঠা থাকে তাহলে পরের বছর আমরা সেটা ৫০ পৃষ্ঠা করি৷ বলা হয় তার জ্ঞান বেড়ে গেছে৷ যদি জ্ঞান বেড়েই যায় তাহলে তো সেটা ৫০০ গুন হওয়ার কথা৷ জ্ঞান বাড়া আর ফাউন্ডেশন তৈরি এক জিনিস না৷ হ্যাঁ, প্রয়োজন হলে আমরা পরিবর্তন করব৷ কিন্তু তার মধ্যে আনন্দের জিনিস থাকতে হবে৷ এটা পেইনফুল হয়ে গেছে৷
আপনি তো এতক্ষণ নানা সমস্যার কথা বললেন৷ এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে পারি কীভাবে?
প্রথমত, সবাই বসে চিন্তা করতে হবে৷ অন্যের কথা শুনতে হবে, বলার একটা সুযোগ থাকতে হবে৷ কর্তৃপক্ষকে একটু বিনয়ী হতে হবে, যে আমরা যেটা বলে ফেলেছি, এটাই শেষ কথা নয়৷ যাদের সমস্যা তাদের নিয়ে বসতে হবে৷ ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে হবে, কেন তারা ভয় পাচ্ছে৷ অনেক সময় বলা হয় স্কুলটা ভালো না, শহরের স্কুল, না গ্রামের স্কুল – আসলে স্কুলটা কিন্তু অত গুরুত্বপূর্ণ না৷ বিজ্ঞানের ফাউন্ডেশনটা করতে হবে, অত বেশি যন্ত্রপাতি লাগে না৷ আমাদের রান্নাঘরে যা আছে তাই দিয়েও শুরু হতে পারে৷ আসলে পাগল শিক্ষক, পাগল ছাত্র না থাকলে তো এটা হবে না৷ এখনও অনেকে বিজ্ঞানের বই ঘাঁটে, কিন্তু যদি দেখে পরীক্ষায় সেটা লাগবে না তাহলে সে ওটা আর দেখে না৷ আমাদের লক্ষ্যটা ন্যারো হয়ে গেছে৷ অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক হয়ে গেছে৷ প্রতিযোগিতা ঠিক আছে, কিন্তু এর বিষয়টা আরো বিস্তৃত হওয়া দরকার৷
বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের ১১ উদ্ভাবন
বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) মূলত সায়েন্স ল্যাবরেটরি নামে পরিচিত৷ সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত এ প্রতিষ্ঠানটি ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়৷ প্রতিষ্ঠানটির উদ্ভাবিত কয়েকটি পণ্য ও প্রযুক্তি দেখে নেই চলুন৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
উদ্ভাবিত পণ্য ও প্রযুক্তির প্রদর্শন
ঢাকার এলিফেন্ট রোডের সায়েন্স ল্যাবরেটরি বা বিসিএসআইআর ক্যাম্পাসে ভেতরে দোতলা একটি ভবনে সম্প্রতি চালু হয়েছে বিসিএসআইআর ইনোভেশন গ্যালারি৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
ইনোভেশন গ্যালারি
ভবনের দোতলায় বিশাল একটি ঘরজুড়ে ১৩টি তাকে প্রদর্শিত হচ্ছে বিসিএসআইআর-এর দুই শতাধিক উদ্ভাবিত বৈজ্ঞানিক পণ্য ও প্রযুক্তি৷ বিসিএসআইআর-এর দেশজুড়ে ১১টি শাখা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন এই সব৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
ন্যাচারাল প্রিজারভেটিভ
বাংলাদেশে এখন এক আতঙ্কের নাম ফরমালিন৷ খাদ্যপণ্য বেশি সময় ভালো রাখার জন্য ব্যবহার করা হয় এই ফরমালিন৷ কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে এ খাবারই রূপ নেয় বিষে৷ সায়েন্স ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন এমনই এক প্রিজারভেটিভ যা একেবারেই স্বাস্থ্যসম্মত৷ আর প্রিজারভেটিভ তৈরি করেছেন চা পাতার উচ্ছ্বিষ্ট, সবজি ও বিভিন্ন ফলের খোসা থেকে৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
ফরমালিন ডিটেক্টর
বাংলাদেশে মাছসহ বিভিন্ন খাদ্যপন্যে মাত্রারিক্ত ফরমালিন ব্যবহারের ফলে সবসময়ই আতঙ্কে থাকেন ক্রেতারা৷ তবে বিসিএসআইআর উদ্ভাবিত ফরমালিন শনাক্তকরণ কিট ব্যবহার করে ঘরে বসেই যে কেউ পরিমাপ করতে পারবেন মাছ ও দুধে ফরমালিনের পরিমাণ৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
পলিমার মডিফাইড বিটুমিন
বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশের সড়কগুলোতে পিচ উঠে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে৷ ফলে বর্ষা মৌসুমের আগে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে সড়ক সংস্কার করা হলেও সে টাকা জলেই যায়৷ আর এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে সড়ক নির্মাণের জন্য বিসিএসআইআর উদ্ভাবন করেছে পলিমার মডিফাইড বিটুমিন৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
আর্সেনিক রিমুভাল ফিল্টার
বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার নলকূপের পানিতে মাত্রারিক্ত আর্সেনিক রয়েছে৷ আর আর্সেনিকযুক্ত এ পানি ফুটিয়েও বিশুদ্ধ করা সম্ভব নয়৷ ঐ সব এলাকার মানুষের জন্য আশার আলো দেখিয়েছেন বিসিএসআইআর-এর বিজ্ঞানীরা৷ তাঁরা এমন এক ফিল্টার উদ্ভাবন করেছেন, যা পানি থেকে আর্সেনিক দূর করবে৷ আর খরচও খুবই কম৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
সোলার ফার্ম হ্যাট
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এটি পরিচিত মাথাল হিসেব৷ কাঠফাটা রোদ্দুর থেকে বাঁচতে গ্রামের কৃষকরা ব্যবহার করেন এটি৷ তবে সায়েন্স ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত এ মাথাল কৃষকদের মাথায় কোমল বাতাসও দিবে৷ এই মাথালের ভেতরের এলইডি বাতিগুলো রাতের বেলা ঘরেও আলো দিবে৷ আর এ সব যুক্ত আছে মাথালের উপরের ছোট ছোট সোলার প্যানেলের সঙ্গে৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
সোলার চার্জিং ব্যাকপ্যাক
স্মার্টফোনের এই যুগে সবাই কম বেশি ভোগেন চার্জ নিয়ে৷ সেক্ষেত্রে সঙ্গে থাকা ব্যাকপ্যাকটিই যদি চার্জার হিসেবে ব্যবহৃত হয় তাতে সুবিধাটাই বেশি৷ সায়েন্স ল্যাবের বিজ্ঞানীরা এমনই এক ব্যাকপ্যাক আবিষ্কার করেছেন যার মাধ্যমে চার্জ করা যাবে সেলফোন৷ ব্যাকপ্যাকে থাকা সোলার প্যানেল থেকেই চার্জ হবে সেলফোন৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
সোলার ওভেন
এই ওভেন ব্যবহারের জ্বালানি খরচ নেই একেবারেই৷ রোদের তাপেই এ ওভেন দিয়ে রান্নাবান্নাসহ খাবার গরমও করা যাবে৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
স্পিরুলিনা
স্পিরুলিনা হলো অতিক্ষুদ্র নীলাভ সবুজ সামুদ্রিক শৈবাল যা সূর্যালোকের মাধ্যমে দেহের প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদন করে৷ এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ভিটামিন, লৌহ ও একাধিক খনিজ পদার্থ৷ সাধারণ খাদ্য হিসেবে তো বটেই নানা রোগ নিরাময়ে মূল্যবান ভেষজ হিসেবে দেশে-বিদেশে স্পিরুলিনার প্রচুর চাহিদা রয়েছে৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
নানা হারবাল পণ্য
বিসিএসআইআর-এর বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন নানারকম হারবাল পণ্য৷ এ সবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নিম ও অ্যালোভেরার তৈরি হারবাল হ্যান্ডওয়াশ, ত্বক উজ্জ্বল ও লাবণ্যময় করার জন্য অ্যালোভেরা জেল ইত্যাদি৷ এছাড়াও আছে অ্যালোভেরা ভ্যানিশিং ক্রিম, অ্যালোভেরা বডি লোশন, অ্যালোভেরা লেমন ড্রিংক, হারবাল তুলসি চা, অ্যালোভেরা টুথপেস্ট, অ্যালোভেরা শ্যাম্পু, লেবুর পাতার তৈরি শেভিং লোশন ইত্যাদি৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
বায়োগ্যাস প্লান্ট
দু’ধরনের বায়োগ্যাস প্লান্ট উদ্ভাবন করেছেন সায়েন্স ল্যাবের বিজ্ঞানীরা৷ একটি ফিক্সড ডোম বায়োগ্যাস প্লান্ট এবং অন্যটি ফাইবার গ্লাস বায়োগ্যাস প্লান্ট৷ জ্বালানি সংকটের এই যুগে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এসব বায়োগ্যাস প্লান্ট বেশ জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয়েছে৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
অ্যালুমিনিয়াম ব্লক
বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত অ্যালুমিনিয়ামের জন্য বাংলাদেশ পুরোটাই আমদানি নির্ভর৷ সায়েন্স ল্যাবের বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন রকম ইলেক্ট্রনিক বর্জ্য থেকে উদ্ভাবন করেছেন অ্যালুমিনিয়াম ব্লক, যা আমদানি নির্ভরতাকে কমাতে পারে৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
বিশেষ আটা
বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) উদ্ভাবন করেছে ‘হাই প্রোটিন সমৃদ্ধ আটা’৷ বাজারের যে কোনো আটা হতে এ আটা দ্বিগুণ প্রোটিন সমৃদ্ধ৷ এতে আছে ফাইটো-ক্যামিক্যালস, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, আইসোফ্লাভন, ক্যালসিয়াম এবং সব অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো-অ্যাসিড, যা মানব শরীরের প্রোটিন গঠনে এবং ক্যানসার, কোলেস্টোরল, অস্টিওপোরোসিস এবং ম্যাল-নিউট্রেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাসহ রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে৷