যুগে যুগে নারীদের অবদান সম্পর্কে কোনো সংশয় না থাকলেও তাঁদের অনেকেই প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা পাননি৷ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জগতেও এমন দৃষ্টান্তের অভাব নেই৷
ছবি: picture alliance/Mary Evans Picture Library
বিজ্ঞাপন
ইতিহাসে প্রথম নারী চিকিৎসকের উল্লেখ পাওয়া যায় প্রাচীন মিশরে৷ তাঁর নাম ছিল পেসেশেট৷ খ্রিষ্টপূর্ব ২,৬০০ সালে তিনি চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার পাশাপাশি একশ'রও বেশি ধাত্রীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন৷
খ্রিষ্টপূর্ব ১,২০০ সালের ব্যাবিলনীয় সভ্যতার সময়কার এক ফলক অনুযায়ী তাপুতি-বেলাতেকালিম বিশ্বের প্রথম রসায়নবিদ ছিলেন৷ সুগন্ধী সৃষ্টির পাশাপাশি তিনি তরল পদার্থ ‘ডিস্টিল' বা শোধনের এক যন্ত্র সৃষ্টি করেছিলেন৷ তাঁর সেই উদ্ভাবনের আধুনিক সংস্করণ আজও ব্যবহার করা হয়৷
বিজ্ঞানে অনুপ্রেরণা যেসব নারী
তরুণ বিজ্ঞানীদের সামনে অনুপ্রেরণা হিসেবে আছেন অনেক নারী৷ সমাজে পুরুষের আধিপত্যের মধ্যেও বিস্ময়কর সব আবিষ্কার করে তাক লাগিয়েছেন তাঁরা৷
ছবি: picture alliance/Mary Evans Picture Library
কবিকন্যার নতুন ভাষা
লর্ড বায়রনের মেয়ে আডা লাভলেসের জন্ম ১৮১৫ সালে৷ এই প্রতিভাধর গণিতজ্ঞ উনবিংশ শতকের মধ্যভাগে প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রাম লিখেন বলে ধারণা করা হয়৷ তখনো আবিষ্কার না হওয়া কম্পিউটার মানবজীবনে কতটা প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে, তা আডাই প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন বলে ধরে নেয়া হয়৷ চার্লস ব্যাবেজের ‘অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন’ নিয়ে আডার করা কাজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়৷
ছবি: public domain
দুই ক্ষেত্রে মহারথী
প্রথম নারী হিসেবে নোবেল জেতেন মারি কুরি৷ শুধু তাই নয়, দ্বিতীয়বার নোবেল জয়ী প্রথম ব্যক্তিও তিনি৷ ১৮৬৭ সালে পোল্যান্ডের ওয়ারশ’-তে জন্মগ্রহণ করেন তিনি৷ ১৯০৩ সালে তেজষ্ক্রিয়তা নিয়ে গবেষণায় অবদানের জন্য স্বামী পিয়েরে কুরি এবং পদার্থবিদ হেনরি বেকুয়ারেলের সাথে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পান তিনি৷ ১৯১১ সালে মৌলিক পদার্থ রেডিয়াম ও পোলোনিয়াম আবিষ্কারের জন্য রসায়নে নোবেল পান মারি৷
ছবি: picture alliance/United Archiv
ডিএনএ ডাবল হেলিক্স
রোজালিন ফ্র্যাঙ্কলিন কখনও নোবেল প্রাইজ পাননি৷ কিন্তু অনেকেই মনে করেন, তাঁর তা পাওয়া উচিত ছিল৷ জৈবপদার্থবিদ ফ্র্যাঙ্কলিন একজন এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফার ছিলেন৷ তাঁর কাজের ওপর ভিত্তি করে ডিএনএ ডাবল হেলিক্স আবিষ্কারের জন্য মেডিসিনে নোবেল পান জেমস ওয়াটসন ও ফ্রান্সিস ক্রিক৷ তবে এই পুরস্কার ঘোষণার আগেই ফ্র্যাঙ্কলিন ডিম্বাশয়ের ক্যানসারে মৃত্যুবরণ করেন৷
ছবি: picture-alliance/HIP
ইনসুলিন গবেষণা
ডরোথি হজকিন ফ্র্যাঙ্কলিনের সমসাময়িক জীবরসায়নবিদ৷ নিজ ক্ষেত্রের বিভিন্ন গবেষণাও তাঁরা একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করে করতেন৷ জৈব অণুর গঠন নিয়ে গবেষণায় ১৯৬৪ সালে তৃতীয় নারী হিসেবে নোবেল পান তিনি৷ এর পাঁচ বছর পর ইনসুলিনের গঠনের রহস্য উন্মোচন করেন হজকিন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Leemage
যৌবনের রহস্যভেদ
অস্ট্রেলিয়ান বংশোদ্ভূত অ্যামেরিকান বিজ্ঞানী এলিজাবেথ ব্ল্যাকবার্ন ২০০৯ সালে ফিজিওলোজি ও মেডিসিনে নোবেল পান৷ ক্রোমোজমের শেষ প্রান্তে অবস্থিত রক্ষাবর্ম টেলোমেরেস নিয়ে গবেষণায় আসে এ স্বীকৃতি৷ ব্ল্যাকবার্ন টেলোমেরাস নামে এক এনজাইমের যৌথ আবিষ্কারক৷ এই এনজাইম টেলোমেরেসের ঘাটতি পূরণ করে যৌবন ধরে রাখে বলে ধারণা করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S.Merrell
শিম্পাঞ্জি নিয়ে গবেষণা
ব্রিটিশ প্রাইমেটোলজিস্ট জেন গোডালকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শিম্পাঞ্জি গবেষক বলে বিবেচনা করা হয়৷ কয়েক দশক ধরে তিনি টানজানিয়ার গোম্বে ন্যাশনাল পার্কে বন্য শিম্পাঞ্জির সামাজিক ও পারিবারিক জীবন নিয়ে গবেষণা করেছেন৷ অনেক প্রাণীর নামকরণও করেছেন তিনি৷
ছবি: picture alliance/Photoshot
ক্যানসার গবেষণা
১৯০৯ সালে ইটালিতে জন্মগ্রহণ করেন রিটা লেভি-মন্টাচিনি৷ কিন্তু ফ্যাসিস্ট স্বৈরশাসক বেনিটো মুসোলিনি গবেষণাকর্ম থেকে ইহুদিদের নিষিদ্ধ করলেও তা দমাতে পারেনি রিটাকে৷ শোয়ার ঘরে গবেষণাগার বানিয়ে মুরগির ভ্রুণে স্নায়ুর কর্মকাণ্ড নিয়ে কাজ করেন তিনি৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে সফলভাবে ক্যানসার টিস্যু থেকে নার্ভ গ্রোথ ফ্যাক্টর আলাদা করেন রিটা৷ ১৯৮৬ সালে এ আবিষ্কারের জন্য স্ট্যানলি কোহেনের সাথে যৌথ নোবেল পান তিনি৷
ছবি: picture-alliance/maxppp/Leemage
পালসার আবিষ্কার
১৯৬৭ সালে নর্থ আইরিশ বিজ্ঞানী জোসেলিন বার্নেল রেডিও টেলিস্কোপ ব্যবহার করে মহাকাশে একটি নিরবচ্ছিন্ন সংকেত শনাক্ত করেন৷ শুরুতে এটিকে অ্যালিয়েনের বার্তা বলে ধরে নিয়ে ‘লিটল গ্রিন ম্যান’ নাম দেয়া হলেও পরে তা ভুল প্রমাণিত হয়৷ গবেষণায় প্রমাণিত হয়, এটি একটি দ্রুত ঘূর্ণায়মান নিউট্রন স্টার– মানুষের আবিষ্কৃত প্রথম পালসার৷ এ গবেষণায় বার্নেলের সুপারভাইজার ১৯৭৪ সালে নোবেল পেলেও তাঁর ভাগ্যে জোটেনি কোনো স্বীকৃতি৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Cizek
8 ছবি1 | 8
৪০০ খ্রিষ্টাব্দে আলেক্সান্ড্রিয়া শহরের হাইপেশিয়া ছিলেন এক গণিতজ্ঞ৷ প্রথম নারী হিসেবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে অধ্যাপনা করেছেন৷ খ্রিষ্টান মৌলবাদী জনতার প্রহারে তাঁর মৃত্যু হয়৷ ইতিহাসের বইয়ে সেই হত্যাকাণ্ড নথিভুক্ত রয়েছে বটে, কিন্তু বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর সাফল্য তাতে স্থান পায় নি৷
অনেক শতাব্দী ধরে নারীরা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছেন৷ ১৭৮৬ সালে কারোলিন হ্যার্শেল প্রথম নারী হিসেবে একটি ধূমকেতু আবিষ্কার করেন৷ তিনি জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন৷ অথচ নারী বিজ্ঞানীরা আজও তাঁদের প্রাপ্য স্বীকৃতি পাচ্ছেন না৷
এমন বঞ্চনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলেন ব্রিটেনের গণিতজ্ঞ অ্যাডা লাভলেস৷ কম্পিউটার সায়েন্সের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেও তিনি জীবদ্দশায় যথেষ্ট সমাদর পান নি৷ ১৮৪৩ সালে তিনি ‘অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন'-এর জন্য প্রথম অ্যালগোরিদম সৃষ্টি করেন, যা আজকের ডিজিটাল কম্পিউটারের তাত্ত্বিক প্রোটোটাইপ হিসেবে পরিচিত৷ তাঁকে বিশ্বের প্রথম প্রোগ্রামার বলা হয়৷
তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে যুগান্তকারী কাজ করে মারি ক্যুরি অবশ্য স্বীকৃতি পেয়েছেন৷ পোল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করা এই বিজ্ঞানী প্রথমে পদার্থবিদ্যায় যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পান৷ পরে রসায়নের ক্ষেত্রেও নোবেল জয় করেন তিনি৷
নিউক্লিয়ার ফিসন আবিষ্কারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সত্ত্বেও অস্ট্রিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী লিসে মাইটনার নোবেল পুরস্কার পাননি৷
বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা প্রথম নারী বিজ্ঞানীদের কথা
03:17
This browser does not support the video element.
ব্রিটেনের রসায়নবিদ রোসালিন্ড ফ্রাংকলিন ডিএনএ অণুর প্রথম এক্সরে ছবি সৃষ্টি করেছিলেন, যা তার কাঠামো শনাক্ত করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ৷ তিনিও বঞ্চনার শিকার হয়েছেন৷
১১৮ বছর আগে নোবেল পুরস্কার দেওয়া শুরু হবার পর থেকে মাত্র ৩ শতাংশ নারী বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই পুরস্কার করেছেন৷ তার মধ্যে একমাত্র নারী ছিলেন ক্রিস্টিনে ন্যুসলাইন-ফোলহার্ড৷ ফ্রুট ফ্লাই প্রজাতির জিনগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা করে তিনি চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে নোবেল পান৷
অতি সম্প্রতি, অর্থাৎ ২০১৮ সালে পাল্সড লেজার নিয়ে পথিকৃতের কাজ করে ক্যানাডার ডনা স্ট্রিকল্যান্ড পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান৷ ৫৫ বছর পর এই প্রথম কোনো নারী এই পুরস্কার পেলেন৷