বিতর্কিত আইপিএস রাজ্য পুলিশের ডিজি পদে
২৮ ডিসেম্বর ২০২৩২০১৯ সাল থেকে বিতর্ক তাড়া করছে রাজীবকে। কেন্দ্রীয় সংস্থা তার বাসভবনে অভিযান চালালে খোদ মুখ্যমন্ত্রী ধর্নায় বসেছিলেন। লোকসভা নির্বাচনের আগে তাকে পুলিশের শীর্ষ পদে বসানো হল।
ডিজি রাজীব
রাজ্য পুলিশের ডিজি পদে মনোজ মালব্যsর কার্যকালের মেয়াদ শেষ হয়েছে বুধবার। তিনি 'এক্সটেনশন' না পাওয়ায় নবান্ন ঘোষণা করেছে, বৃহস্পতিবার থেকে নতুন ভারপ্রাপ্ত ডিজি রাজীব কুমার। মালব্য এদিন থেকেই রাজ্য পুলিশের উপদেষ্টার পদে থাকবেন তিন বছরের জন্য।
১৯৮৯ ব্যাচের আইপিএস রাজীব দক্ষ পুলিশ অফিসার হিসেবেই পরিচিত। সিআইডিতে যোগ দিয়ে আমেরিকান সেন্টারে হানা, খাদিম কর্তা অপহরণ-সহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। বিধাননগর ও কলকাতা পুলিশের কমিশনারের পদও তাকে দেয়া হয়।
বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থা সারদার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের বিপুল টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ ওঠে এরপর। যে কেলেঙ্কারির সঙ্গে তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের যোগ রয়েছে বলে হইচই পড়ে যায়। ২০১৩ সালে রাজ্য সরকার এই মামলার তদন্তভার দেয় রাজীব কুমারকে।
নজরে সারদা
অর্থলগ্নি সংস্থার বিপুল টাকা আত্মসাতের নেপথ্যে কারা রয়েছে, সেটাই তদন্ত করে দেখার ভার ছিল রাজীবের উপর। কিন্তু তার বিরুদ্ধেই এই মামলায় তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগ ওঠে। পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় সংস্থা এই মামলার তদন্তভার পায়। সিবিআই রাজীবের বিরুদ্ধেই তদন্ত শুরু করে ২০১৯ সালে।
এরপর নাটকীয় মোড় নেয় রাজীব পর্ব। সেই বছরের ফেব্রুয়ারিতে পুলিশকর্তার সরকারি আবাসনে অভিযান চালায় সিবিআই। এই খবর পেয়ে সেখানে পৌঁছে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সিবিআই অভিযানের প্রতিবাদে ধর্মতলায় শীর্ষ পুলিশ আধিকারিকদের নিয়ে ধর্নায় বসেন মুখ্যমন্ত্রী।
এর এক সপ্তাহের মধ্যে মেঘালয়ের শিলংয়ে সিবিআই জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়েন রাজীব। সেখানে ডেকে পাঠানো হয় সারদা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া কুণাল ঘোষকে। তাদের মুখোমুখি বসিয়ে প্রশ্ন করা হয়।
কুণালের 'বোমা'
রাজীব কুমার যখন সারদা তদন্তের দায়িত্বে সেই সময় রাজ্যের পুলিশ গ্রেপ্তার করে শাসক দলের সাবেক সাংসদ কুণালকে। সাড়ে তিন বছর জেলে কাটাতে হয় তাকে। সেই সময় মুখ্যমন্ত্রী-সহ সাংসদ, মন্ত্রীদের দিকে আঙুল তোলেন কুণাল। এমনকি মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেপ্তারের দাবিও তোলেন। তার কণ্ঠস্বর চাপা দিতে পুলিশকে প্রিজন ভ্যান চাপড়াতে দেখা যেত।
এভাবে যে কুণালের মুখ বন্ধ করতে চাইত পুলিশ, তিনিই এখন শাসক দলের এক নম্বর মুখপাত্র। রাজীব ডিজি হওয়ার পর বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন তিনি। কুণাল বলেন, "এই দায়িত্বের জন্য শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। তবে আমার মত নির্দোষকে কারো নির্দেশে আর বলি দেবেন না। তাতে আগামী দিনগুলি ভালো যাবে না।"
বিরোধীদের বক্তব্য, রাজীব রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের অধীনেই কাজ করতেন, যার মাথায় ছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। তার নির্দেশে কুণালকে গ্রেপ্তার করা হয়, এমন ইঙ্গিত কি দিতে চেয়েছেন তৃণমূল মুখপাত্র?
বিরোধীদের সমালোচনা
সারদা বিতর্কে জড়িয়ে পড়া রাজীব গত কয়েক বছর এ রাজ্যে দায়িত্বে ছিলেন না। সিবিআই তার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে প্রমাণ লোপাটের অভিযোগ জানিয়ে হলফনামা দিলেও মামলায় বিশেষ অগ্রগতি হয়নি। গ্রেপ্তারের আশঙ্কায় কলকাতা হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন নিতে হয় রাজীবকে। আগামী ৪ জানুয়ারি সেই মামলার শুনানি হওয়ার কথা শীর্ষ আদালতে।
এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিধানসভার বিরোধী দলনেতার শুভেন্দু অধিকারী। তার মন্তব্য, "সারদা মামলার নথি নষ্ট করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাইরে থাকার সুযোগ করে দিয়েছিলেন রাজীব কুমার। তার বিনিময়ে ডিজি পদে নিয়োগ করে নতুন বছরের উপহার দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু সিবিআই কেন এ নিয়ে বিশেষ তৎপর নয় সেটা দেখতে হবে।"
২০১৯-এ রাজীবকে ঘিরে নয়া বিতর্কের সূত্রপাত হয় তার নিয়োগ ঘিরে। তাকে তথ্যপ্রযুক্তি দপ্তরের প্রধান সচিব নিয়োগ করে নবান্ন। সাধারণত আইএএস অফিসাররা এই পদে বসেন।
এই বিষয়টি টেনে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেন, "আইটি দপ্তরের সচিব পদে বসিয়েছিলেন বিরোধীদের উপরে নজরদারি করতে। পেগাসাস ধরনের সফটওয়্যার ব্যবহার করে আড়িপাতার কাজ করেছেন প্রতিবাদী এবং বিরোধীদের উপরে।"
নজরে নির্বাচন
কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনে রাজীবের নিয়োগকে চ্যালেঞ্জ করার কথা বলেছেন সেলিম। আগামী বছরের গোড়ায় ভারতে লোকসভা নির্বাচন। তার আগে ডিজি পদ থেকে রাজীবের অপসারণ চাইতে পারে বিরোধীরা।
অতীতেও এমন নজির রয়েছে। ২০১৬ সালে কলকাতার পুলিশ কমিশনার নিযুক্ত হন রাজীব। সেই বছরে বিধানসভা নির্বাচনের আগে কমিশন সরিয়ে দেয় তাকে। ভোটের পর নবান্ন ফের তাকে বহাল করে।
প্রবীণ সাংবাদিক দেবাশিস দাশগুপ্ত বলেন, "সুপ্রিম কোর্ট সারদা কেলেঙ্কারির নেপথ্যে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র প্রকাশ্যে আনতে বলেছিল। সেই তদন্ত শীতঘুমে চলে গিয়েছে। সারদার তথ্যপ্রমাণ লোপাটে অভিযুক্ত যে পুলিশ অফিসার সরকার ও তৃণমূলের নেতাদের বাঁচিয়েছিলেন, তিনি পুরস্কার পেলেন। অনেকটা গিভ এন্ড টেক পলিসি-র মতো।"
এতে পুলিশের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে বলে মনে করা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাজা ধর চক্রবর্তী বলেন, "পুলিশের যিনি সর্বোচ্চ পদে, তিনি অভিযুক্ত। তার বিরুদ্ধে আদালতে হলফনামা দিয়েছে তদন্তকারী সংস্থা। সাধারণ মানুষ এটা বুঝতে পারছে, এই অফিসারকে মাথায় রেখে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ পুলিশ ব্যবস্থা সম্ভব নয়। কমিশন সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ করতেই পারে।"