ইউরোপীয় সমন্বয় প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে জার্মানির বিদায়ী চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল স্পেনের একটি পুরস্কার পাচ্ছেন৷ আন্তর্জাতিক, ইউরোপীয় ও জাতীয় পর্যায়ে তার অবদান নিয়েও আলোচনা চলছে৷
বিজ্ঞাপন
চলতি মাসের শেষেই জার্মানিতে সাধারণ নির্বাচন৷ দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর পর ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷ আগামী সরকার গঠিত হওয়া পর্যন্ত তিনি অবশ্য প্রথা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করে যাবেন৷ এখন থেকেই তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের মূল্যায়ন শুরু হয়ে গেছে৷ তার আমলেই জার্মানিতে সামরিক বাহিনীতে তরুণদের বাধ্যতামূলক কার্যক্রম শেষ হয়েছে৷ পরমাণু ও জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানি পুরোপুরি ত্যাগ করে ভবিষ্যতে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির পথে যাত্রাও শুরু হয়েছে৷ এছাড়া সমলিঙ্গের বিবাহ ও সদ্যোজাত সন্তানের দেখাশোনার জন্য পিতাদের জন্য ভাতা ও ছুটির মতো বেশ কিছু প্রগতিশীল সিদ্ধান্তও সমাজের উপর প্রভাব ফেলছে৷
তবে আন্তর্জাতিক আঙিনায় তার দৃঢ় অবস্থান গোটা বিশ্বে সমীহ আদায় করেছে৷ ইউরোপের সংকট সামলানো ও স্বার্থ রক্ষায় তার উদ্যোগ বার বার নজর কেড়েছে৷ বিশেষ করে ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকটের সময়ে তিনি জার্মানির মানুষের সঞ্চয় নিরাপদ হিসেবে ঘোষণা করে যথেষ্ট আস্থা অর্জন করেছিলেন৷ ঋণ সংকট থেকে ইউরোপীয় অভিন্ন মুদ্রা ইউরোকে রক্ষার ক্ষেত্রেও তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন৷ বাভেরিয়ার মুখ্যমন্ত্রী মার্কুস স্যোডার ম্যার্কলের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘‘আপনাকে কঠিন পরিস্থিতিতে দেশের হাল ধরতে হয়েছে৷ কোনো নির্বাচনি কর্মসূচিতে সেসব সংকট সামলানোর উল্লেখ ছিল না৷ রাতারাতি সেগুলি এসেছে৷ আপনাকে ভালোভাবে সেসব সামলাতে হয়েছে৷ আপনি ভালোভাবেই আমাদের দেশকে রক্ষা করেছেন৷’’
বিদায়ের আগেই ম্যার্কেল ইউরোপীয় সমন্বয় প্রক্রিয়ার প্রতি দীর্ঘ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে স্পেনের কার্লোস দ্য ফাইভ পুরস্কার পাচ্ছেন৷ পুরস্কারের প্রশস্তিপত্রে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইউরোপের কৌশলগত অবস্থানের প্রতি তার সমর্থনেরও উল্লেখ থাকছে৷ স্পেনের পশ্চিমে কাসেরেস প্রদেশের ইউস্টে ফাউন্ডেশনের ইউরোপীয় ও ইবেরো-অ্যামেরিকান সোসাইটি ১৯৯৫ সাল থেকে ইউরোপীয় সমন্বয় প্রক্রিয়ায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে৷
সাহসি পদক্ষেপ নিতে গিয়ে ম্যার্কেলের মতো পোড়খাওয়া রাজনীতিককেও সমস্যায় পড়তে হয়েছে৷ ২০১৫ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের জের ধরে শরণার্থীদের ঢল নামার সময়ে ম্যার্কেল তাদের জার্মানিতে স্বাগত জানিয়েছেন৷ ‘আমরা পারবো’ স্লোগান মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রশংসা কুড়ালেও জার্মানি তথা ইউরোপে এত সংখ্যক শরণার্থী গ্রহণের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ দেখা গেছে৷ এবার আফগানিস্তান সংকটের সময়েও সেই মনোভাব দেখা যাচ্ছে৷ আফগানশরণার্থীদের তুরস্কেই আটকে রাখতে ইউরোপের তৎপরতা বাড়ছে৷
ম্যার্কেল নিজে অসমাপ্ত কাজের উল্লেখ করেছেন৷ তার আমলে জার্মানি ডিজিটাল প্রযুক্তি সব স্তরে ছড়িয়ে দিতে যথেষ্ট সাফল্য পায়নি৷ করোনা সংকটের সময়ে স্থানীয় স্বাস্থ্য দফতর ফ্যাক্স যন্ত্রের উপর নির্ভর করায় সেই দৈন্য আরো স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷
এসবি/এসিবি (ডিপিএ, এপি)
ম্যার্কেল ও মার্কিন প্রেসিডেন্টদের রসায়ন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির বিশেষ সম্পর্কের ভিত্তি যথেষ্ট মজবুত হলেও শীর্ষ নেতাদের সম্পর্কের রসায়নের উপর তার বিবর্তন অনেকটাই নির্ভর করে৷ আঙ্গেলা ম্যার্কেল তাঁর ক্ষমতাকালে চারজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের দেখা পেলেন৷
ছবি: Reuters/F. Bensch
প্রথম সাক্ষাৎ
২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে আঙ্গেলা ম্যার্কেল মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন৷ সে সময়ে জার্মান চ্যান্সেলর ছিলেন গেয়ারহার্ড শ্র্যোডার৷
ছবি: AP
চ্যান্সেলর ও প্রেসিডেন্ট
২০০৮ সালের জুন মাসে বার্লিনের কাছে মেসেব্যার্গ-এ জার্মান সরকারের অতিথি নিবাসে মিলিত হয়েছিলেন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ৷ বুশ দুই দিনের সফরে জার্মানি এসেছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/G. Bergmann
পারিবারিক পরিবেশে বুশ-ম্যার্কেল
২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় জর্জ ডাব্লিউ বুশ ম্যার্কেলকে নিজের খামারবাড়িতে স্বাগত জানান৷ স্ত্রী লরা ও ম্যার্কেলের স্বামী ড. ইওয়াখিম সাউয়ারকে সঙ্গে নিয়ে নিজেই গাড়ি চালিয়েছিলেন বুশ৷
ছবি: AP
উষ্ণতার বহিঃপ্রকাশ
২০০৮ সালেই রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে জি-৮ শীর্ষ সম্মেলনে জর্জ ডাব্লিউ বুশ আচমকা ম্যার্কেল-এর কাঁধ মালিশ করে বসেন৷ তাঁর এই স্বতঃস্ফূর্ত উষ্ণতার প্রকাশে ম্যার্কেল অবশ্য কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলেন৷
নতুন সম্পর্ক
২০০৯ সালে জার্মানির বাডেন বাডেন শহরে ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে আসেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা৷ ম্যার্কেল তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
ম্যার্কেল-ওবামা রসায়ন
একই বছর ওয়াশিংটন সফরে জান ম্যার্কেল৷ ধীরে ধীরে ওবামা ও ম্যার্কেলের ব্যক্তিগত উষ্ণতা গড়ে উঠতে শুরু করে৷
ছবি: AP
বিশেষ সম্মান
২০১১ সালে ওয়াশিংটন সফরের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘মেডেল অফ ফ্রিডম’ হাতে পান আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷ কিন্তু তার ঠিক পরে এনএসএ কেলেঙ্কারির ফলে ওবামা প্রশাসনের সঙ্গে ম্যার্কেলের সম্পর্ক কিছুটা শীতল হয়ে পড়ে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নতুন পরিস্থিতি
২০১৫ সালে বাভেরিয়ার মনোরম পরিবেশে জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে আসেন ওবামা৷ ততদিনে ভ্লাদিমির পুটিনের সঙ্গে বেড়ে চলা সংঘাতের কারণে রাশিয়া একঘরে হয়ে পড়েছে৷
ছবি: Reuters/M. Kappeler
আবেগঘন বিদায়
২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে কার্যকালের শেষ পর্যায়ে বার্লিন সফরে আসেন বারাক ওবামা৷ পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসেবে তিনি ম্যার্কেলের নাম উল্লেখ করেন৷
ছবি: Reuters/F. Bensch
নতুন চ্যালেঞ্জ
২০১৭ সালটি অ্যামেরিকা ও জার্মানি – দুই দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল৷ জানুয়ারি মাসে ওয়াশিংটনে ক্ষমতায় এলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ ম্যার্কেলও আবার ক্ষমতায় এলেন।
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Kappeler/R. Sachs
বিরোধ
২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ট্রাম্পের আমলে অ্যামেরিকা ও জার্মানির মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়। ন্যাটো নিয়ে ট্রাম্প ও ম্যার্কেলের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। ট্রাম্পের অ্যামেরিকা ফার্স্ট নীতিও ম্যার্কেল মানতে পারেননি। জার্মানি থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করেছেন ট্রাম্প। ফলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হয়েছে।
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Vucci
বাইডেনের আমলে
২০২১ সালে জি৭ বৈঠকের ফাঁকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে ম্যার্কেলের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়েছে। এবার ম্যার্কেল অ্যামেরিকা গেছেন। চ্যান্সেলার হিসাবে তার সম্ভবত এটাই শেষ সফর। বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকে করবেন তিনি। সেখানে কি সম্পর্কের বরফ গলবে?
ছবি: Adam Schultz/White House/Planet Pix/Zuma/picture alliance