জার্মানি বিদেশি চিকিত্সকদের স্বাগত জানায়৷ বেশ কিছু বিদেশি ডাক্তার কাজও করছেন দেশটিতে৷ কিন্তু জার্মান ভাষায় তাঁরা তেমন পারদর্শী নন৷ তাই বিভিন্ন রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রীরা ভাষা পরীক্ষায় কড়াকড়ি করার পরিকল্পনা করছেন৷
বিজ্ঞাপন
এক মহিলা স্কিং করতে গিয়ে হাঁটুতে আঘাত পেয়ে ভীষণ যন্ত্রণায় ভুগছেন৷ হয়ত ‘মিনিসকাস' ভেঙে গিয়েছে? সিরিয়ার নারী চিকিত্সক শনাক্ত করলেন পাঁয়ে থ্রম্বোসিস বা রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছে৷
পরে রোগীর অসুখের রেকর্ডে রোগীর বয়স ৫৩-এর বদলে ৩৫ লিখলেন৷ এই চিকিত্সক উচ্চশিক্ষিত৷ কিন্তু রাইনলান্ড-ফালৎস রাজ্যের চিকিত্সক সমিতি আয়োজিত ছদ্মবেশী রোগীর সঙ্গে কথোপকথনে স্পষ্ট হলো যে, তাঁর জার্মানভাষায় জ্ঞান চিকিত্সার জন্য পর্যাপ্ত নয়৷
ক্লিনিকগুলি অভিযোগ করে আসছে
বেশ কয়েক বছর ধরে জার্মানির ক্লিনিকগুলি বিদেশি চিকিত্সকদের ভাষা সমস্যার ব্যাপারে অভিযোগ করে আসছে৷ অনেকে বুকের ব্যথাকে পেটব্যথা বলে ভুল করছেন, কেননা জার্মান ভাষায় পেট ও বুক দুটি শব্দই ‘বি' দিয়ে শুরু হয়৷ এমনকি সাইকোসোমাটিক ক্লিনিকেও এমন চিকিত্সক কাজ করেন, যাঁরা জার্মান ভাষায় প্রায় কথাই বলতে পারেন না৷ ‘‘এটা কীভাবে সম্ভব, যেখানে রোগীর ব্যক্তিগত বিষয় নিয়েও কথাবার্তা বলতে হয়?'' বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন রাইনলান্ড-ফালৎস রাজ্যের চিকিত্সক সমিতির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইউর্গেন হফফার্ট৷
ভাষা সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামানো হয়নি
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বছরের পর বছর ধরে বিদেশ থেকে আসা চিকিত্সকদের জার্মান জ্ঞানের ব্যাপারে তেমন মাথা ঘামানো হয়নি৷ সমালোচনা করে বলেন এই চিকিৎসক৷ ‘‘ভাষা কোর্সের একটি সাধারণ সার্টিফিকেট পেলেই যে বিদেশি ডাক্তার রোগীর সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলতে পারবেন, তা বলা যায় না, জানান হফফার্ট৷
এই সমস্যার সমাধানে রাইনলান্ড-ফালৎসকে অগ্রণী বলা যায়৷ রাজ্যটিতে ২০১২ সালের আগস্ট মাস থেকে বিদেশ থেকে আসা সব চিকিত্সককে কঠিন ভাষা পরীক্ষায় পাশ করতে হয়৷ চিকিৎসাবিষয়ক ল্যাটিন শব্দগুলিকে অনুবাদ করতে হয়৷ ডাক্তার ও রোগীর কথোপকথন অনুকরণ করতে হয়৷ এছাড়া রোগ নির্ণয় করে লিখিত আকারে রেকর্ড করে রাখতে হয়৷ এপর্যন্ত ৩৬০ জন বিদেশি চিকিত্সকের ভাষা পরীক্ষা নিয়েছেন হফফার্থ৷
জার্মান ভাষা জানার বিকল্প নেই
জার্মান ভাষা আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত৷ ভারত-বাংলাদেশের মতো বিশ্বের আরো অনেক দেশে এ ভাষা শেখার জন্য রয়েছে গ্যোটে ইন্সটিটিউট৷ তবে জার্মানিতে থেকে সে’ দেশের ভাষা না জানলে যে পদে পদে সমস্যা!
ছবি: POOSHdesign/Reza Alaeddini
যদি ভাষা জানেন, সুবিধা পাবেন
যে কোনো দেশে থাকতে হলে সে দেশের ভাষা জানা খুবই জরুরি৷ তা না হলে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার তেমন কোনো সুযোগই থাকেনা৷ ভাষা না শেখার কারণে খালিদ, আইচো, শিরিয়া, আরিয়ানা বা রাইসার মতো অনেকেই নিজের দেশে চেয়ার টেবিলে বসে কাজ করলেও জার্মানিতে শ্রমিকের কাজ করতে হচ্ছে৷
ছবি: Doc RaBe - Fotolia.com
সেবিকা থেকে ক্লিনার
শিরিয়া কসোভো থেকে বেশ কয়েকবছর আগে স্বামী, সন্তান নিয়ে জার্মানিতে এসেছে৷ নিজের দেশে একটি হাসপাতালে নার্স বা সেবিকা হিসেবে কাজ করতো৷ প্রথমে ভাষা শেখাটাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি বলে আর শেখাও হয়নি৷ বেঁচে থাকার জন্য এখন তাকে অন্যের বাড়িতে ক্লিনারের কাজ করতে হচ্ছে৷ জার্মান ভাষা জানা থাকলে সহজেই নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে হয়তো আবারও সেবিকার কাজ পেতে পারতো৷
ছবি: picture-alliance/dpa
খালিদের অনেক দুঃখ
খালিদ পোল্যান্ডের একটি কন্সট্রাকশন ফার্মে সুপারভাইজারের দায়িত্ব পালন করতো৷ ভাষা শেখেনি, তাই এখন নিজেকেই এ সব কাজে হাত লাগাতে হচ্ছে৷ ভাষা না শেখার কারণ জানতে চাইলে কিছুই বলেনা৷ তবে এখন বুঝতে পারছে সে ভাষা না শিখে ভুল করেছে এবং মানসিকভাবে অনেক কষ্টও পাচ্ছে৷ যদিও জার্মানিতে কম আয়ের বিদেশিদের জন্য বিনে পয়সায় ভাষা শিক্ষার কোর্স রয়েছে৷
ছবি: Kzenon - Fotolia.com
আরিয়ানা
কিন্ডারগার্টেন শিক্ষিকা আরিয়ানা প্রায় দশ বছর আগে ইউক্রেন থেকে এসেছে৷ নিজের দেশে টুকটাক জার্মান ভাষা শিখেছিলো, তবে জার্মানিতে এসে আর শেখা হয়নি কোলে বাচ্চা থাকায়৷ তবে ওর স্বামীর জার্মান ভাষা মোটামুটি শেখাতে একটি চাকরি এবং জার্মানিতে থাকার অনুমতি পেয়েছে৷ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে আরিয়ানাকেও কাজ করতে হয়৷ স্বামীর সহায়তায় অগত্যা একটি সরকারি অফিসে মেঝে মোছার কাজই করছে সে এখন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বসনিয়ার মেয়ে মারিয়ম
১৫ বছর বয়সে বাবা মায়ের হাত ধরে জার্মানিতে এসেছে মারিয়ম৷ প্রথমদিকে কিছুটা অসুবিধা হলেও বাবা মায়ের উৎসাহে এবং নিজের মনোবলের কারণে ভালোভাবেই জার্মান ভাষা রপ্ত করতে পেরেছে৷ এখন সে নিজেই চাকরির জন্য অফিসে দরখাস্ত করছে৷ ওর চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে৷
ছবি: Bilderbox
জব সেন্টারে ঘোরাঘুরি
অনেকে প্রতি সপ্তাহেই চাকরির খোঁজে জব সেন্টারে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ ভাষা না জানার কারণে ওদের জন্য তেমন কোনো চাকরির সুখবরও থাকেনা৷ তবে এরা সরকার থেকে বেকার ভাতা বা সামাজিক ভাতা পায় নিয়মিত৷
ছবি: dpa
ভাষা শিখে স্বপ্ন পূরণ
লায়লা ছোটবেলা থেকেই বাচ্চা ভালোবাসে তার ইচ্ছে বাচ্চাদের সাথে কাজ করবে৷ লায়লার জন্য ভাষা শেখা কোনো সমস্যাই ছিলোনা৷ সাধারণ স্কুলের পাশাপাশি আলাদাভাবে জার্মান ভাষা শেখার ক্লাস সে করেছে৷ যার ব্যয়ভার জার্মান সরকার বহন করেছে৷ কিন্ডারগার্টেনের ট্রেনিং শেষে পছন্দের চাকরিও সে পেয়ে গেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বখাটে তরুণ
যারা জার্মান ভাষা শেখেনা, তারা নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়৷ কোনো প্রয়োজনীয় চিঠিপত্র এলেও সেগুলো তারা পড়তে বা বুঝতে পারেনা৷ ফলে সবসময়ই অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়৷ ভাষা না জানা এই প্রজন্মের অনেক ছেলে মেয়েকে পয়সার জন্য অন্যায় পথে পা বাড়াতেও দেখা যায়৷ কেউ কেউ আবার অন্য বাড়ির দরজায় গিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করে৷
ছবি: fotolia/imageteam
জন্ম থেকে জার্মানিতে, জার্মান ভাষার প্রতি আগ্রহ নেই
জার্মানিতে প্রায় ৪০ লাখ তুর্কি রয়েছে৷ যাদের জন্ম জার্মানিতে, জার্মান স্কুলে পড়ে – তারপরও অনেকেই তেমন ভালো জার্মান ভাষা জানেনা৷ কারণ হিসেবে অনেক সময় বলা হয় জার্মান স্কুলের বাইরে অর্থাৎ নিজেদের মধ্য এরা সবসময়ই তুর্কি ভাষায় কথা বলে৷
ছবি: picture-alliance/ZB
নারীদের ভাষা শেখার আগ্রহ খুব কম
নিজ দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেকেই জার্মানিতে পাড়ি জমিয়েছেন৷ তাদের মধ্যে পুরুষরা কিছুটা জার্মান ভাষা শিখে বিভিন্ন দোকান, কারখানা, রেস্তোরাঁতে কাজ করছেন৷ এদেশে স্কুলে যাওয়া বাধ্যতামূলক বলে বাচ্চারাও স্কুলে যায়৷ তবে এসব পরিবারের খুব কম নারী জার্মান ভাষা শেখে৷ অনেক বছর থাকার পরও কথা বলতে পারেন না৷ যদিও এদেশে তুর্কি নারী সংখ্যা বেশি থাকায় তাদের জন্য আলাদাভাবে ভাষা শেখার ব্যবস্থা রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তিন বোন
পোল্যান্ড থেকে আসা এক পরিবারের তিনজন৷ ছোটবোন ভালো জার্মান ভাষা শিখেছে বলে মোটামুটি ভালো বেতনে দোকানে সেলস গার্লের চাকরি করছে৷ দ্বিতীয়জনের জার্মান ভাষার জ্ঞান আরো কম বলে সে একটি ফ্যাক্টরিতে জিনিসপত্র গোছানোর কাজ করে, যেখানে তাকে বেশি কথা বলতে হয়না৷ এবং স্বাভাবিকভাবেই বেতন বেশ কম৷ আর সবচেয়ে বড় বোন একদমই ভাষা জানেনা৷ তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কোন বাড়িতে ক্লিনারের কাজও কেউ দিতে চায়না৷
ছবি: POOSHdesign/Reza Alaeddini
11 ছবি1 | 11
প্রথমে চিকিত্সাবিষয়ক ল্যাটিন শব্দগুলির অর্থ জানা আছে কিনা পরীক্ষা করা হয়৷ দ্বিতীয় অংশ কিছুটা কৌশলপূর্ণ: এখানে রয়েছে চিকিৎসক ও রোগীর সাজানো কথোপকথন৷ এতে বোঝা যায় হাসপাতালের দৈনন্দিন কাজে কে কতটা দক্ষ৷ হার্ট অ্যাটাক, বা মেরুরদণ্ডের হাড় সরে যাওয়ার লক্ষণগুলি শনাক্ত করতে হয়৷
পরীক্ষার শেষ অংশে রোগ নির্ণয়ের লিখিত পরীক্ষায় ধকল যায় বেশি৷ প্রতি পাঁচজনে একজন ফেল করে৷ এই তথ্য জানা গিয়েছে গত মে মাসের এক পরিসংখ্যানে৷
সমস্যা বুঝতে হলে ভাষা জানা প্রয়োজন
অন্যান্য রাজ্যও ভাষা পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরেছে৷ ডাক্তার ও রোগীর পরস্পর পরস্পরকে বুঝতে হবে৷ কেননা রোগীর সমস্যা বুঝতে হলে ভাষার ব্যবধান থাকলে চলবে না৷ বলেন বাভারিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী সিডিইউ-এর মেলানি হুমল৷ তাঁর সহকর্মী নর্থরাইনওয়েস্টফালিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী সবুজ দলের বারবারা স্টেফেন্সও একই মত পোষণ করেন, ‘‘চিকিৎসকদের জার্মান না জানাটা একেবারেই চলে না৷''
বাডেন-ভ্যুর্টেমব্যার্গ, থ্যুরিংগেন ও হেসেন রাজ্যের পাশাপাশি নর্থরাইন ওয়েস্টফালিয়াতেও বিদেশি ডাক্তারদের জন্য বিশেষ ভাষা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে এখন৷
অভিবাসী মানসিক রোগীদের চিকিৎসায় বড় বাধা ভাষা
মানসিক সমস্যায় চিকিৎসকের সাথে ভালোভাবে কথা বলা মানসিক রোগ চিকিৎসার সবচেয়ে জরুরি বিষয়৷ এই চিকিৎসায় রোগী ও ডাক্তারের মধ্যে ভাষাগত সমস্যা হলে ফলপ্রসু চিকিৎসা বাধাগ্রস্হ হয়৷
ছবি: BPtK
রবার্ট কখ ইন্সটিটিউট-এর হিসেব
রবার্ট কখ ইন্সটিটিউটের হিসেব অনুয়ায়ী জার্মানিতে প্রতি তিনজনের একজন প্রাপ্ত বয়স্ক বছরে অন্তত দুবার মানসিক সমস্যায় ভোগেন৷ তবে সবাইকেই যে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হয় তেমন নয়৷
ছবি: Fotolia/ lassedesignen
রোগী এবং ডাক্তারের সম্পর্ক
যাঁদের কষ্ট বেশি তাঁদের অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত৷ রোগীর সুস্থ্ হওয়া অনেকটাই নির্ভর করে ডাক্তার এবং রোগীর মধ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য বিনিময়ে ভাষাগত মিলের ওপর৷
ছবি: picture alliance/Klaus Rose
দোভাষী
জার্মান ভাষা খুব কম জানেন বা একেবারেই জানেন না এমন অভিবাসী মানসিক রোগীদের খুবই সমস্যায় পড়তে হয়৷ জার্মান ভাষা জানা পরিবারের কেউ সাথে থাকলেও অনেক সময় সবকিছু ঠিকভাবে বোঝানো সম্ভব হয়না৷
ছবি: DW/M. Witt
শতকরা ৯০ জন!
গেলজেন কির্শেনের গেজাম্ট স্কুলে শতকরা ৯০ জন ছাত্রছাত্রীই অভিবাসী পরিবার থেকে আসা, যাঁরা এক অক্ষরও জার্মান ভাষা জানেনা৷ বুলগেরিয়া এবং রোমানিয়া থেকে ওদের বাবামায়েরা জার্মানিতে কাজ করতে এসেছেন গত বছর৷ দুটি দেশই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য৷
ছবি: DW/S. Auer
উন্নত শিক্ষার বিশেষ ক্লাস
এরই মধ্যে গেলজেন কির্শেন স্কুলের বাচ্চাদের জন্য আলাদাভাবে ভাষা শেখার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ ছাত্রছাত্রীরা যেন তাড়াতাড়ি ভাষা শিখে স্কুলে ঠিকমতো পড়াশোনা করতে পারে সেজন্যই এই উদ্যোগ এবং প্রতিটি ক্লাসে ১৫জন শিক্ষার্থী থাকে-একথা বলেন আখিম এলভার্ট৷
ছবি: DW/S. Auer
সাহায্য সংস্থা ‘স্প্রিন্ট’
এই শূন্যস্থানগুলো কেবল বিশেষ প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত দোভাষীই পূরণ করতে পারে৷ রোগী এবং ডাক্তারের দেশের ভাষা এবং সংস্কৃতি সম্পর্কেও জানা থাকে তাঁদের৷ স্প্রিন্ট-এ এ বিষয়ে ১৮মাস প্রশিক্ষন দেওয়া হয়৷স্প্রিন্ট-এর প্রধান হাইকে টিমেন বলেন, ‘সাধারণ রোগের চেয়ে মানসিক রোগ নিরূপন করা অনেক কঠিন৷’
ছবি: picture-alliance/dpa
আরো বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন
মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সংগঠনের প্রেসিডেন্ট রাইনার রিস্টার বলেন, কোলোনের মতো বড় শহর যেখানে ৬০,০০০ জার্মান পাসপোর্টধারী তুর্কির বসবাস, সেখানে মাত্র দুজন তুর্কিভাষী মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, যা মোটেই যথেষ্ট নয়৷
ছবি: BPtK
7 ছবি1 | 7
ফেডারেল চিকিৎসক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ৩১০০০-এর চেয়েও বেশি বিদেশি ডাক্তার জার্মানিতে কাজ করেছেন৷ এর আগের বছরের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি৷ বেশিরভাগ চিকিৎসকই আসেন রোমানিয়া, গ্রিস, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া ও সিরিয়া থেকে৷ গ্রামাঞ্চল ও জার্মানির পূর্বাঞ্চলেই চাহিদাটা বেশি৷ সেখানকার হাসপাতালগুলি হন্যে হয়ে উচ্চশিক্ষিত বিশেষজ্ঞ খুঁজছে৷
চিকিত্সকদের বিদেশি ডিগ্রির ব্যাপারে এই বছরের প্রথম দিক থেকে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতিমালা চালু করা হয়েছে৷ কিন্তু ভাষা সমস্যাটি নিয়ে তেমন মাথা ঘামানো হয়নি এতদিন৷ সমালোচনা করে বলেন ইউর্গেন হফফার্ট৷ কোনো কোনো রাজ্য বিদেশি ডাক্তারদের ভাষাজ্ঞানের ব্যাপারে উদার৷ আবার কোনো কোনো রাজ্য এই বিষয়টিতে জোর দেয়৷ তাদের কাছে রোগীদের সুরক্ষার বিষয়টি মুখ্য৷
জরুরি চিকিত্সা বিভাগে অতি আবশ্যকীয়
ইন্টিগ্রেশনের প্রবক্তা রাজনীতিবিদরা বিদেশি কর্মীদের ডিগ্রিকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করার পক্ষে যুক্তি দেন৷ কিন্তু বিশেষ করে চিকিৎসকদের ভাষার ক্ষেত্রে এই যুক্তি মেনে নিতে নারাজ হফফার্ট৷ তাঁর মতে, ‘‘বিদেশি ডাক্তারদের স্বাগত জানানো ঠিক আছে৷ কিন্তু কোনো মানুষই রাত তিনটায় জরুরি চিকিত্সা বিভাগে ডাক্তারের ভাষাজ্ঞানের অভাবে অসুবিধায় পড়তে চাইবে না৷''
জার্মানিতে বিদেশি বংশোদ্ভূত শিশুরা
ফটোগ্রাফার মার্টিনা হেন্সকে ও লেখক টাটিয়ানা লাইশারিং জার্মানির বিভিন্ন জায়গা স্কুল ঘুরে বিদেশি বংশোদ্ভূত শিশুদের ছবি তুলেছেন৷ এই ছবিঘরে সেই শিশুরাই জানাচ্ছে ওরা কিভাবে জার্মানির জীবনধারার সাথে একাত্ম বোধ করে৷
ছবি: Martina Henschke
আমার দেশ খুবই সুন্দর!
লাউরা ওর নিজের দেশ পর্তুগালকে নিয়ে খুব গর্ব বোধ করে৷ ‘‘টেলিভিশনে পর্তুগালের ছবি দেখে আমার সেখানে যেতে ইচ্ছে করে৷’’ লাউরার জন্ম জার্মানিতে হলেও ও পর্তুগালে গিয়ে পর্তুগিজ ভাষা শিখেছে৷ তবে ওর বাবা ওকে পর্তুগিজে প্রশ্ন করলে লাউরা জার্মানে উত্তর দেয়৷ জার্মানিতে জন্ম নেওয়া বেশিরভাগ বাচ্চার ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য৷ ঠিক এ বিষয়টিই হিল্ডেসহাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রদর্শনীতে দেখানো হয়েছে৷
ছবি: Martina Henschke
‘সোমালিয়া আমার জীবনের অঙ্গ’
দিকার ভাষায়, ‘‘আমি সোমালীয়, ইংরেজি, জার্মান ভাষা জানি, জানি কিছুটা ফ্রেঞ্চ, আরবী এবং অল্প কিছুটা তুর্কি ভাষাও৷’’ দিকার মতে, ভাষগুলোর মধ্যে কিছুটা মিল রয়েছে৷ তাছাড়া ও এটাও লক্ষ্য করছে যে, ওর পরিবারের মানুষজন আফ্রিকান এবং আরবী – এই দুই ভাষা মিলিয়ে কথা বলে৷
ছবি: Martina Henschke
মাঝে মাঝে অসুবিধা হয়
বিভিন্ন ভাষা জানার যে বিশেষ সুবিধা রয়েছে, সে কথাই বোঝানো হয়েছে হিল্ডেসহাইম বিশ্ববিদ্যলয়ের এই প্রদর্শনীটিতে৷ ফেরিদে অনেকগুলো ভাষা শোনার মধ্য দিয়েই বেড়ে উঠছে৷ ওর ভাষায়,‘‘জার্মান এবং তুর্কি ভাষা আমি জানি আর ইংরেজি জানি সামান্য, স্কুলে শিখছি৷’’ মায়ের সাথে ফেরিদে খুব কমই তুর্কি ভাষায় কথা বলে৷ ভাই-বোনদের সাথে তুর্কি/জার্মান দুটোই আর তুর্কি বংশোদ্ভূত জার্মান বন্ধুদের সাথে শুধু জার্মান ভাষায় কথা বলে সে৷
ছবি: Martina Henschke
খেলার মাঠে ভাষা চর্চা
বাড়ির কাছেই খেলার মাঠে বিভিন্ন দেশের মানুষ একসাথে হলে তাদের নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা হয়৷ ইব্রাহিমের কিন্তু এভাবেই ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে৷ ইব্রাহিম বসনীয় এবং জার্মান – এই দুই ভাষার মধ্য দিয়েই বড় হচ্ছে৷ তবে ইটালিয়ান ভাষা শিখতে ইব্রাহিম খুবই আগ্রহী, কারণ ওর বেশিরভাগ বন্ধুই যে এই ভাষায় কথা বলে!
ছবি: Martina Henschke
‘আমি কিন্তু সুপারম্যান হতে চাই’
রামসেস বাড়িতে ওর মায়ের সাথে স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে৷ তবে ওর দুটো পাসপোর্ট – জার্মান এবং কলোম্বিয়ান৷ রামসেস-এর ভাষায়, ‘‘আমার জন্ম যেখানেই হোক না কেন, আমি মনে করি আমি জার্মানিতেই জন্মেছি, ভাষা নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই৷’’ তবে ওর সমস্ত ভাবনা জুড়ে রয়েছে শুধু একটাই, রামসেস-এর ভাষায়, ‘‘আমি সুপারম্যান হয়ে আকাশে উড়ার স্বপ্ন দেখি৷’’
ছবি: Martina Henschke
স্বপ্ন দুই ভাষায়ই দেখি
এরমালের জন্ম জার্মানির ফ্রাংকফুর্ট শহরে৷ ও এখন ক্লাস ওয়ানে পড়ে৷ এরমানের সবচেয়ে ভালো লাগে বই পড়তে আর অঙ্ক করতে৷ ‘‘আমার নিজের কোনো বই নেই, তবে আমি প্রতি সপ্তাহেই লাইব্রেরি থেকে একসাথে অনেকগুলো ডাইনোসরাসের বই নিয়ে আসি৷’’ এরমাল ওর বাবা-মায়ের সাথে বেশিরভাগ সময় আলবেনীয় ভাষায় কথা বললেও ও স্বপ্ন দেখে জার্মান এবং আলবেনীয় ভাষাতে৷ ‘‘আমি তো এর চেয়ে বেশি ভাষা জানি না’’, বলে এরমাল৷
ছবি: Martina Henschke
‘‘আমি কিন্তু কিছুটা জার্মান’’
হাজার নামের এই মেয়েটির স্বপ্ন যে, ও বড় হয়ে ডাক্তার অথবা উকিল হবে৷ হাজার ওর ভাই-বোন এবং স্কুলের বন্ধুদের সাথে জার্মান ভাষায় কথা বলেলেও বাবা-মায়ের সাথে সে কথা বলে বার্বার ভাষায়৷ স্কুলে অবশ্য ইংরেজি শিখছে হাজার৷ ওর জন্ম জার্মানিতে, তবে বাবা-মা এসেছেন মরক্কো থেকে৷ হাজার নিজের সম্পর্কে বলে, ‘‘আমি মরোক্কান হলেও এখন অবশ্যই কিছুটা জার্মান৷’’
ছবি: Martina Henschke
‘আমার বন্ধুরা টিউনিশিয়ায়’
ইহেব্স-এর বাবা এসেছে টিউনিশিয়ায় থেকে আর মা ও নানা জার্ডান থেকে৷ ইহেব্স-এর আরবী ভাষা জানা থাকায় টিউনেশিয়ায় অনেকের সাথে ওর বন্ধুত্ব হয়েছে৷ ওর ভাষায়, ‘‘আমি আসলে টিউনেশিয়ান, জার্মান নই৷’’ ওর ধারণা ও যেহেতু সবসময় জার্মান ভাষায় কথা বলে না, তাই সে জার্মান নয়৷ ভাষার মাধ্যমেই নিজের পরিচয় দিতে পছন্দ করে ইহেব্স৷ তবে ও সারা জীবন পরিবারের সাথে জার্মানিতেই কাটাতে চায়৷
ছবি: Martina Henschke
সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে
ইওয়ানে-র প্রিয় বিষয় জার্মান ভাষা আর সাঁতার কাটা৷ ওর মতে, জার্মান ভাষাটাই ও ভালো জানে৷ এর কারণ, ইওয়ানে-র জন্ম জার্মানিতে৷’’ ও কখনো থাইল্যান্ডে না গেলেও মায়ের সাথে থাই ভাষাতেই কথা বলে৷ তবে ওদের পরিবারের লোকজন বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে৷ ফলে সবার সাথে যোগাযোগ রাখাটা প্রায় সম্ভবই হয়ে ওঠে না৷ ‘‘আমার ‘কাজিন’ থাকে লন্ডনে, আর আমি জার্মানিতে৷ কাজেই আমরা একে অপরের সাথে নিয়মিত কথা বলতে পারি না৷
ছবি: Martina Henschke
জায়গা পরিবর্তন
ক্রিস্টিয়ান প্রথমে নাস্তা করে, তারপর দাঁত ব্রাশ করে তার দিন শুরু করে৷ পরে আবারো বিছানায় শুয়ে আরাম করে একটু গড়িয়ে নেয়৷ আচ্ছা, ‘‘জার্মান বলতে আসলে কাদের বোঝায়? যাঁদের জন্ম জার্মনিতে আর যাঁদের বাবা-মা জার্মান, তাঁদের?’’ প্রশ্ন তার৷ এর ব্যাতিক্রমও রয়েছে কিন্তু বলে সে৷ ক্রিস্টিয়ান লক্ষ্য করেছে, অনেকেই অন্যান্য দেশ থেকে জার্মানিতে আসেন, টাকা-পয়সা রোজগার করে ভালোভাবে জীবন কাটাতে৷
ছবি: Martina Henschke
10 ছবি1 | 10
অন্যদিকে সমালোচকরা মনে করেন ‘রোগী-সুরক্ষার' বিষয়টির সঙ্গে একটা আতঙ্ক জড়িয়ে রয়েছে৷ ধারণা করা হয় ভাষায় দক্ষতা না থাকলে সহজেই চিকিত্সায় ভুল হতে পারে৷ ‘‘প্রায়ই ভুল উচ্চারণকে ভাষায় অদক্ষতা বলে মনে করা হয়৷'' বলেন মাইনৎস বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তঃসংস্কৃতি যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বের্নড মায়ার৷
এ প্রসঙ্গে তিনি আরেকটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন৷ জানান, প্রায়ই সমস্যাটি অন্যদিকেও লক্ষ্য করা যায়৷ অর্থাৎ কোনো রোগী জার্মান ভাষায় কথা বলতে না পারলে৷ এক্ষেত্রে বিদেশি ডাক্তাররা বরং সহায়তা করতে পারেন৷ যেমন রোগী আরবি ভাষী হলে একই ভাষাভাষী একজন চিকিত্সক তাঁর সমস্যাগুলি সহজেই বুঝতে পারবেন৷ রোগীসুরক্ষার বিষয়টি শুধু একপেশে বা জার্মান রোগীদের বেলায় প্রযোজ্য হলে চলবে না, বলেন মায়ার৷
জার্মানির রাজ্য-স্বাস্থ্যমন্ত্রীদের পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদেশি চিকিত্সকদের ভাষার ব্যাপারে একটি অভিন্ন নীতিমালা তৈরি করা হবে৷ রোগীর সুরক্ষা ছাড়াও আরেকটি ইতিবাচক দিকও খুলে যাবে এতে: বিদেশি চিকিত্সকরা জার্মানভাষায় দক্ষ হলে জার্মানভাষী সহকর্মীদের কাজের ভারও অনেকটা লাঘব হবে৷ কেননা ডাক্তার ও রোগীর মধ্যে ভাষাগত ভুল বোঝাবুঝির ক্ষেত্রে তাঁদেরই মধ্যস্থতা করতে হয়৷